আগামী বাইশে জানুয়ারি মহা সমারহের সাথে রাম মন্দির উদ্বোধন হতে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এটাকে তাদের জয় হিসেবে ব্যাপক প্রচার করছে। শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে স্থাপিত হতে চলেছে বহু আলোচিত রাম মন্দির। কিন্তু মন্দির প্রতিষ্ঠিত হলেও আদালতের রায়, হিন্দুত্ববাদীদের উল্লাস, রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা ইত্যাদি এসব নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা যে থেমে যাবে তার বিন্দুমাত্রও আভাস এখনও পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। বরং উত্তরোত্তর তা বৃদ্ধি পাওয়ারই সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন এখনও পর্যন্ত অমীমাংসিতই থেকে গিয়েছে। এখানে সেই বহু অমীমাংসিত প্রশ্নগুলির মধ্যে কয়েকটির দিকে আলোকপাত করতে চাই।

🟥কথা শুরুর আগের কথা:-

রামচরিতমানসের রচয়িতা তুলসীদাস ছিলেন রামের মাহাত্ম্য প্রচারকারীদের মধ্যে অন্যতম। তার রাম ভক্তির জন্য তাকে বাল্মীকির অবতার বলা হয়ে থাকে।
👉তুলসীদাস তার জীবনের অধিকাংশ সময়টাই বারাণসীতে কাটান। 👈
বারাণসীতে গঙ্গা নদীর তীরে তুলসীঘাট তারই নামাঙ্কিত। ⬛বারাণসীতে সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির তারই প্রতিষ্ঠিত। ⬛ ষষ্ঠদশ শতকের গোড়ার দিকেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে, হনুমান চালিশাও তুলসীদাসেরই রচনা।

⬛এক নজরে কিছু #ঐতিহাসিক তথ্য:-

🔴 তুলসীদাস জন্মগ্রহণ করেন ১১ই আগস্ট, ১৫১১ সালে আর প্রয়াত হন ৩০ই জুলাই, ১৬২৩ সালে।

🔴বাবর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লীর লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল ও লোদি এই দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম বড় সংঘর্ষ হয় ১৫২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। স্বাভাবিক ভাবেই যুদ্ধে জেতার পরেই বাবর বাবরি মসজিদ তৈরীর জন্য আদেশ দেন।

🔴বাবরি মসজিদের অভিলিখন থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশে সেনাপতি মীর বাকী ১৫২৮–২৯ (৯৩৫ হিজরি বর্ষে) এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।

♦️অর্থাৎ বাবরি মসজিদ যখন তৈরি হয়েছিল তখন রামের একনিষ্ঠ ভক্ত তুলসীদাসের বয়স ছিল সতেরো-আঠারো বছর।

🔴মীরাবাঈ (আনুমানিক১৪৯৮-১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দ)
ছিলেন তুলসীদাসের সমসাময়িক। যদিও তিনি ছিলেন কৃষ্ণ-ভক্ত কিন্তু তিনি ছিলেন বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের সন্ত ধারার প্রধান ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম। মনে করা হয়, তিনি বারোশো থেকে তেরোশো ভজন রচনা করেছিলেন।

🔴একবার মীরাবাঈয়ের অনুরোধে তুলসীদাস, তাকে কয়েকটি ছত্রে, কি ভাবে মনের শান্তি পাওয়া
যায়, সেই বিষয়ে উপদেশ দেন। সুপ্রসিদ্ধ হিন্দি কবি আবদুর রহিম খাঁ’র সাথেও তুলসীদাসের বিশেষ আলাপ ছিল। তার ভক্তি ও নিষ্ঠার জন্য সমসাময়িক অনেক দেশীয় নৃপতি তুলসীদাসের অনুরাগী হয়েছিলেন।

🔴জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, যিনি ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ অব্দি রাজত্ব করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ইনি মহান শাসকদের অন্যতম হিসেবে মহামতি আকবর নামেও পরিচিত।

🟥এবার আসা যাক মূল কথায়:-

🟩তুলসীদাসের রচিত রামচরিতমানস লেখা হয়েছিল 1574 খ্রিষ্টাব্দে। রামচরিতমানসের কবিতার মধ্যেই সঠিক তারিখটি বলা হয়েছে চৈত্র মাসের নবম দিন, যেটি রামের জন্মদিন, রাম নবমী। রামচরিতমানস অযোধ্যা, বারাণসী ও চিত্রকূটে বসে রচিত হয়েছিল। অর্থাৎ রামচরিতমানস যখন রচিত হচ্ছে ততদিনে বাবরি মসজিদ তৈরীর কাজ শেষ হয়ে গেছে। বাবরি মসজিদ যদি রাম মন্দির ধ্বংস করেই নির্মাণ করা হয় তবে তুলসীদাসের মতোন এত বড় একজন রাম ভক্ত তার রচিত রামচরিতমানসে এই ঘটনার সামান্যতম ইঙ্গিতও কেন দিলেন না❓️

🟪রামভক্ত তুলসীদাস বারাণসীতে সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন, যদি রাম মন্দিরের ভেঙে মসজিদ করা হয়ে থাকতো তবে তিনি রাম মন্দির না করে কেন হনুমানের মন্দির প্রতিষ্ঠিত করলেন❓️

🟫যদি রাম মন্দিরের উপর সামান্যতমও আচড় পড়তো তবে কি এটাই স্বাভাবিক ছিল না যে, তুলসীদাস রাম মন্দির প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করতেন❓️

🟨অথচ তিনি তা করলেন না। এমনকি এই বিষয়ে কাউকে কিচ্ছুটি বললেন না পর্যন্ত ‼️ এটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয় কি❓️

🟥মীরাবাঈয়ের ভজন সে সময় যথেষ্ট জনপ্রিয়তালাভ করেছিলো। মীরাবাঈয়ের ভজন বা তার কোনও কথায় কখনোই মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরীর কথা শোনা যায়নি। কেন❓️

এর থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় নাকি যে, কোনও মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়নি আর অযোধ্যাতে রামের জন্মস্থান বলে যে যায়গাটা চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে আদৌ কোন রাম মন্দির ছিল না। এমনকি ওই স্থানটি রামের জন্মস্থান বলে মনেই করা হতো না। যদি ওই স্থানটি রামের জন্মস্থান বলেই মনে করা হতো তবে ব্যক্তিগত ভাবে তুলসীদাসের মতোন পন্ডিত মানুষ এবং একনিষ্ঠ রাম ভক্ত জীবনের অধিকাংশ সময় অযোধ্যা ছেড়ে বারাণসীতে কেন কাটালেন❓️

বাবরি মসজিদ যখন তৈরির কাজ চলছিল তখন তুলসীদাসের বয়স ছিল সতেরো-আঠারো বছর। সুতরাং মন্দির ভেঙেই যদি মসজিদ তৈরী হয়ে থাকতো তবে সে কথা তুলসীদাসের মতোন মানুষের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সুপ্রসিদ্ধ হিন্দি কবি আবদুর রহিম খাঁ’র সাথেও তুলসীদাসের বিশেষ আলাপ ছিল। দিল্লীর অধিকার দখল করার সাথে সাথেই মোঘলরা যদি এতবড় একটা অন্যায় করেই থাকতো তবে তিনি আবদুল রহিম খাঁ’র কাছে একবারও উষ্মা প্রকাশ করলেন না কেন❓️ শোনা যায়, তিনি মোঘলদের নিয়ে কখনোই কোনও উষ্মা প্রকাশ তো করেইনি বরং বারাণসীতে গঙ্গা নদীর তীরে তুলসীঘাট তারই নামাঙ্কিত হয়েছিল এবং বারাণসীতে সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির প্রতিষ্ঠিত করবার সময় কোনও প্রকার বাঁধা পাননি, উল্টে সরকারী সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল। অতএব যথাযথ ভাবেই এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, হিন্দুদের মন্দির ভাঙা, ভেঙে সেখানে মসজিদ স্থাপন করাই যদি মোঘলদের সরকারি নীতি হতো তবে হনুমানের মন্দির প্রতিষ্ঠিত করবার সময় সেই নীতি থেকে মুঘলরা সরে এলো কেন❓️যদি তুলসীদাস মোঘলদের প্রতি কোন বিরূপ মনোভাবই প্রকাশ করতেন তবে, তার ভক্তি ও নিষ্ঠার জন্য সমসাময়িক অনেক দেশীয় নৃপতিরা তুলসীদাসের বিরোধিতার বদলে অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন কেন❓️

ইতিহাস আর বিশ্বাসের মধ্যে ফারাক হলো এটাই যে, বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে ইতিহাসকে বিকৃত করা যেতে পারে কিন্তু তাতে ইতিহাস কখনোই পাল্টানো যায় না। ইতিহাসকে বিকৃত করে মসজিদ ভেঙে মন্দির তো তৈরি হলো বটে কিন্তু এভাবে আর যাই হোক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। মিথ্যা গল্প বলে, ধর্মের দোহাই দিয়ে মসজিদ ভেঙে মন্দির প্রতিষ্ঠিত করবার মধ্যে দিয়ে সামগ্রিক ভাবে গোটা দেশ ও জাতির মাথা উচু হতেই পারে না বরংচ, ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা একটি কলঙ্কিত অধ্যায় বলেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। যে কলঙ্ক সামগ্রিক ভাবে সমস্ত ভারতবাসীদের বহন করে নিয়ে যেতে হবে। এই ইতিহাস লজ্জার, এই ইতিহাস গ্লানির, এই ইতিহাস বিদ্বেষের। দুঃখের হলেও একথা সত্য যে, আমরা এই কলঙ্কিত ইতিহাসের নিরব সাক্ষী হয়ে রইলাম ‼️আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে তো⁉️