ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া সিংহমুখি কলে অবিশ্রান্ত গঙ্গা বইছে। বনমালী সরকার স্ট্রীটে তখন উড়িয়া বিজু ফুলরির ব্যাসনে জল ঢেলেছে। কড়াইতে তেল ফুটছে। রাস্তায় কাপড় কাচতে কাচতে পাশের বাড়ির নতুন বউ এর গল্প সারছেন মালতি কাকিমা। রেডিও টা একটু বাড়িয়ে দিয়ে গতকালের ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের খবর বুঝতে চাইছে ঘনা। রুহিনী বাবুর চা দোকানে সবে তখন দুধে এলাচ পড়েছে।  আর টিভি এন্টেনায় একটা ছেঁড়া ঘুড়ি লটকে, সেখানে আবার কাকেদের হৈচৈ। জিভটা একটু এদিন বেশিই ছুলে ফেললেন লোকনাথ বটব্যাল। সকালের প্রাতকরমের লাইনে দাঁড়িয়ে তখন রফির গান গাইছে বুদ্ধ।

ক্যালকাটা ফাইভে অনেকটা ওপেন টি বায়োস্কোপের সেকেন্ড সিন!

গিঁটে বাত, রসে বাত, সাইটিকা বাত, হাঁড়ে ব্যাথা, কোমরে ব্যাথা, জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথা? উঠতে গেলে লাঠী, আর বসতে গেলে মাটি?স


বকিছু সারবে একটাই তেলে। আয়ুর্বেদিক মহাশক্তি ম্যাজিক মাস্টার অয়েল। দাদারা, বৌদিরা, জ্যেঠিমা - কাকিমার এগিয়ে আসুন আমাদের প্রচার গাড়ির দিকে!

মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল, বসতির পাশের ঘরেই থাকে বান্ধবী রমা। চোখটা কোনরকমে কচলে, জলটল দিয়ে দুই বন্ধু ছূটল। গোসাঁই পাড়া লেন, হাটখোলা, পূর্ণ চন্দ্র সুরাই এর দোকান, ট্রাম লাইন পেরিয়ে হাতিবাগান - রূপবাণী সিনেমা হল। ততক্ষনে টিকিটের লাইন প্রায় আশি জনের পিছনে। সেযুগে লেডিস টিকিট ছিল পঁয়ষট্টি পয়সা। ব্যালকনি এক টাকা চল্লিশ। ছবির মুক্তি তখনও পাঁচ দিন বাকি। চারপাশে জলজল করছে তাপস পাল, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়ের ছবি। আশি জন পেরিয়ে টিকিট যখন পাওয়া গেল ততক্ষনে সকাল দশটা বেজে গিয়েছে। গোলাপি রঙের সে টিকিটের গায়ে লেখা ম্যাটিনি শো। দুপুর আড়াইটে। দাদা ইতিমধ্যে জানতে পেরে গিয়েছে সিনেমার টিকিট কাটতে যাওয়ার খবর। ফলত বাড়ি ফিরেই জুটল উত্তম মধ্যম মার। যদিও টিকিটগুলো কোনোপ্রকার আড়াল করা গেল, কারণ মায়ের আস্কারা ছিল তার মেয়েদের প্রতি।

সদ্য ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া দুটো তাদের মায়ের মত শুধুই রান্নাঘরে কাটাতে চায়না। চালতার চাটনি, মাছের মাথা দিয়ে গোবিন্দভোগ চালের মুড়িঘন্ট, মাছের ডিমের চচ্চড়ির গন্ডি পেরিয়ে ওরা সিনেমা শেষে অনামিকায় মোঘলাই পরোটা খেতে শিখেছে, আর শিখেছে ফাউল কাটলেট। 

দাদা ওই সময়টায় কুমোরটুলিতে কাজে যায়। দুপুরে তার টিফিনটা একটু আগেভাগেই পৌঁছে দিয়ে কল্পনা আর রমা মুখে বসন্ত মালোটি মেখে বেরিয়ে পড়ল। দর্শকে টইটুম্বুর ম্যাটিনি শোয়ে সেদিন গোটা রূপবাণী কেঁদেছিল সিনেমার দু ঘন্টা চোদ্দ মিনিট পেরোতেই। বাঙালি তার নতুন নায়ক পেয়েছিল, তাপস পাল। রবীন্দ্র সংগীতের এক অমোঘ ব্যবহারে সেবছর পুজোর মাইকে বেজেছিল 'চরণ ধরিতে দিওগো আমারে'। স্বয়ং অনুপ কুমার এসেছিলেন সেবছর কুমোরটুলি পার্কের পুজোয়। দর্শকের আবদারে শুনিয়েছিলেন, 

 কে যায় হেথায়? 

 -সন্দীপ রায়। 

 অত তাড়াতাড়ি ছুটছিস কেন? 

-পুরুত মশাই আসেনি এখনও। 

  সেকি? 

 -যাই। দেখি…

সিনেমাটা ছিল দাদার কীর্তি। পরিচালক তরুণ মজুমদার।

আর গল্পটা আমার মায়ের। সেযুগে তনুবাবুর সিনেমা দেখতে পাচ-সাত দিন আগে থেকে টিকিট কাটতে হোত, পাছে ব্ল্যাকে টিকিট কাটতে হয়। নুন, ম্যাটিনি, ইভিনিং সমস্ত শোতেই হাউসফুল লেখা বোর্ড ঝুলত সকাল থেকে মিনার, উত্তরা, শ্রী, রুপবানীতে। আমার অবশ্য এসবের কিছুই দেখা হয়নি, আমার যখন ম্যাট্রিকুলেশন ততদিনে বাঙালির টিভি এন্টেনায় মরচে ধরেছে। ইন্টারনেটে খাবার অর্ডার করে তারাশঙ্কর-প্রফুল্ল চাকির উত্তরসূরিরা লড়াই করে চলেছে ফেসবুকে লাভ রিয়েক্টের। তাই চাইলেও চাক্ষুশ হয়নি হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া লালরঙা দোতলা বাস, গৌতম চট্টপাধ্যায়ের লাইভ শো, সলিল চৌধুরির রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা, হলভর্তি দাদার কীর্তি, ভালোবাসা ভালোবাসার উৎপল দত্ত।

বাংলা তথা দেশের প্রথম মহীলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী বিহারের ভাগলপুরে জন্মেছিলেন, সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীও তাই, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনের বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন পাটনা শহরে। সেযুগে ভাগলপুরে ছিল বাঙালির আড্ডা, মুঙ্গেরে স্টেশন মাস্টারির চাকুরী নিয়ে যেতেন ঢাকুরিয়ার ম্যাট্রিক পাশ ছেলে। গত কয়েক বছরে যেভাবে উচ্চ মধ্যবিত্ত যেভাবে শনিবারের টিকিটে শান্তিনিকেতন যাওয়া শিখেছে, সোনাঝুরির হাটকে বাড়ির ড্রয়িং রুমে তুলে এনেছে, আবার রিটায়ারমেন্টের পর করে কিছুটা সবুজের টানে জমি বাড়ি বানিয়ে শেষ জীবন কাটাতে চাইছেন। ঠিক তেমনই সাত-আটের দশকে এক শ্রেণীর বাঙালি ছুটি কাটাতে বিহারের

ভাগলপুর, শিমুলতলা, দেওঘর, মুঙ্গের, পূর্ণিয়া এসব জায়গায় যেতেন। আজও এসব স্থানে বাঙালির পোড়ো বাড়ির নিদর্শন মেলে। সেখানকার জলহাওয়া এতটাই ভালো যে বেশ কিছুদিন গিয়ে থাকা যেত। হেঁটে চড়া যেত লাট্টু পাহাড়। পাতকুয়োর জলে রান্না হোত। বিউলির ডাল আর আলু পোস্ত মিশে যেত লিট্টি, আলু টিকিয়ায়। পূজোর ছুটি, কিংবা অসুখে সেরে উঠে কলকাতা, শিলিগুড়ি, বহরমপুর থেকে বাঙালি বিহার যেত চেঞ্জে। ১৫ দিন - ১ মাস, লম্বা ছুটি। নিজেরাই রান্না বান্না করে খাওয়া, তোষোক-বালিশ রোদে দেওয়া, অধুনা হোটেল ব্যাবস্থা ছিলনা সেযুগে।

আবার অনেকে ওকালতি, ডাক্তারির প্র্যাকটিস করতেও বিহারে গিয়ে সংসার পেতেছেন। কলকাতায় যেমন একটা বিরাট অংশের বিহারি শ্রমিক শ্রেণীর কর্মসংস্থান ছিল, তেমনি সেরাজ্যে প্রবাসী বাঙালিও কম ছিল না। সম্ভবত তরুণ মজুমদারই সেলুলয়েডে ধরলেন প্রথমবার এই মানুষগুলোর গল্পটাকে। বনেদী কায়দায় শিমুলতলাকে ডাকলেন পশ্চিম। সন্তুর ফেলদা কলকাতা থেকে সেই পশ্চিম পৌঁছল খারাপ রেজাল্ট আর একরাশ  সরলতা নিয়ে। বাঙালি তার সংসার সীমান্ত পার করল ফুলমতিয়ার মছলি ভাজায়।

কিন্তু দাদার কীর্তি ছবিতে এই দাদাটি যে আসলে কে সেটা আজ অব্দি বোঝা হয়নি এই লেট নাইন্টিজদের। কীর্তিতে ভোম্বল এবং কেদার কেউই পিছিয়ে নেই যদিও। তবু কেদারের অমন আপোষহীন সরল মানুষের জীবনবোধটাই সিনেমার নামকরণের সাথে মিলে  গেলে মন্দ হয়না। আর এখানেই ভালোবাসার সাথে শরতের মেঘের তুলনা টানলেন তরুণ মজুমদার। পিয়ালি নদীর ধারে, সেই চরুইভাতির জায়গাটায় গত শতাব্দির প্রেমগুলো আজও জীবন্ত এই সিনেমা পাড়ায়।

সমাজের যে বাস্তব চিত্রে আজকাল আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তার একেবারে উল্টো ছবি দাদার কীর্তি।

যেখানে ভালোবাসা সরলরেখা বরাবর চলে, সম্পর্কের ন্যূনতম মারপ্যাাঁচ নেই। নেই একজনের চাইতে অন্যজনের এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতাও। এখানে প্রেমিকা প্রেমিকের বাড়ি থেকে কলম চেয়ে নিয়ে যায়, আবার সেই কলমেই সদ্য বিবাহিতা চিঠি লেখে তার কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকা স্বামীকে। ঠাকুরপোর সাথে বোদির সম্পর্কে এখানে 'দুপুরে' বদলে যায় না। এখানে পাড়ার ভোম্বলদার কাছে অনায়াসে দায়িত্ব দেওয়া যায় তিন তিনবার ফেল করা কেদারের। টোনিদার মত গোটা পাঁঠা একা খাবার ক্ষমতা না থাকলেও এখানে ভোম্বল ভট্টাচার্যই পাড়ার ছেলেদের জিও সি সি আর। সে পদ্য লেখে, ইয়াং জেনারেশনকে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে  শেখায়। না পাড়লে নম্বরও যায় কাটা। বিহারের বুকে অমন একটা উত্তর কলকাতা কি সত্যিই ছিল? বনামালী সরকার স্ট্রীট, রাজবল্লভ পাড়াটা কি বাক্স প্যাট্রা বেধে সিমুলতলা বেড়াতে গিয়েছিল?

একটা মস্ত ক্লাবঘর। নাম ছন্দবাণী। সেখানে সন্ধ্যে হলেই চলছে পুজোর আগের রিহার্সাল। আট থেকে আশি, কে নেই সেখানে! মেয়েরা নাচের প্র‍্যাক্টিস করছে একদিকে, একটু প্রবীণরা নাটকের মহড়া সারছেন। মা - কাকিমারা একের পর এক কাপ চায়ের জোগান দিয়ে চলেছেন। ভোম্বলের দলবল লাস্ট মিনিট পুজোর প্রিপারেশন বুঝে নিচ্ছে। প্রবাসী বাঙালিকে এভাবে দাদার কীর্তি ছাড়া আজ অব্দি কোনো সিনেমা ধরতে পেরেছে বলে মনে পড়েনা। যেন গত শতাব্দীতে কোন জাতির ছেড়ে যাওয়া একটা মলাট বিহীন ইতিহাস বই। যে বইয়ের পাতায় বাড়ির ছোটরা জামাইবাবুর পকেট কেটে ষষ্ঠীর দিন সিনেমা দেখতে যেত, মেয়েরা শিবরাত্রির নির্জলা উপোষ নিয়েই রাত বাড়লে সিনেমা হলে যেত, যাতে ঘুম ভেঙে না যায়। আজকের অধুনা বাঙালীর কাছে এসব তাজ্জব মনে হলেও, একদিন এই রঙিন পাতাগুলো আমাদেরই মহাকাব্যের অংশ ছিল। সজনী গো সজনী, দেয়া নেয়া, নিশিপদ্ম, শ্রীমান পৃথিরাজ শেষে মেয়েরা বেলতলায় গিয়ে শিবের মাথায় জল ঢেলে হয়তো বা হয়তো কেদারের মত স্বামী চাইত।

এই কেদার কিন্তু তখনও পেশাদার অভিনেতা নন। চন্দননগর গামী লোকাল ট্রেনে সদ্য আঠেরো পেরোনো তাপস পালকে দেখেন তনু বাবুর সহাকরী। তখন কেদারের খোঁজ চলছিলই। অফিসের দেওয়ালে দাদার কীর্তির টাঙানো অভিনেতা-অভিনেত্রীর লিস্টে তখনও দাদার নামটাই বাদ। সহকারী  অমুক বাবুর কথায় সেদিন ডেকে তাপসকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। দু দিন ধরে টানা অবজার্ভেশনের পর, কেদারের শূন্যস্থান পূরণ হল। 

লালমুখো ফরাসিদের রেখে যাওয়া আধা মফস্বল থেকে তাপস পৌঁছল সিনেমা পাড়া। বাঙালি এমন এক নায়ককে পেল যার মুখের দিকে তাকালেই মায়া বাড়ে। যার নায়কোচিত কোনো বৈশিষ্ট নেই, যে জীবনে চলার পথে ভীষণরকম ইম্পারফেক্ট। যে বাঙালি উত্তম কুমারকে চেনে তার স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে, যে বাঙালি ইন্টারভিউতে রণজিৎ মল্লিককে পেয়েছে, অপুর সংসারে সৌমিত্রকে পেয়েছে তার কাছে এই কেদার ভীষণ অচেনা ঠেকল। চুলে টেরি না বাগিয়েও, পরীক্ষায় সকল বিষয়ে প্রথম না হয়েও, সাদা এম্বাসাডারে না চেপেও কেউ নায়ক হতে পারে শুধুমাত্র তার ভালোবেসে আগলে রাখার ক্ষমতায় তা দাদার কীর্তি প্রত্যমনার জানান দিল। ক্যামেরা ফোকাল লেন্সটা ভালোবাসার ফিতেয় মাপলেন তরুণ মজুমদার, যার ডেপ্ত অফ ফিল্ডে একটুও মারপ্যাঁচ নেই। যে সময়ের কথা বলছি সেটা উত্তম যুগ। মহানায়ক তখন তিন শিফটে শুট করেন। সুচিত্রা- উত্তম জুটি যখন বাঙালির ইন্টেলেকচুয়ালিজম থেকে শীতের সর্ষে ফুলের গন্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। অথচ প্রথম সিনেমা চাওয়া পাওয়ার পর তরুণ মজুমদার তার পরবর্তী কোনো সিনেমায় আর এই জুটিকে নিলেন না। বরং এমন সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে তুলে আনলেন সিনেমার রিলে যাদের দেখে বাঙালি গ্রামের এঁদো গন্ধটা পেল। দিয়ে গেল একরাশ মুগ্ধতা। রাঙা ফুলে ফুলে শুরে দুলে দুলে রঙ্গিলা ভ্রমরা কথা বলল হোলির দিন। লালে লাল হয়ে গেল শিমুলতলার প্রবাস থেকে তিলোত্তমার ক্যামেরাগলি। হিন্দি-বাংলার এমন সুরের আবির হেমন্ত বাবু মাখলেন দাদার কীর্তি ছবিতে, সবকি অঙ্গনা ঘুরে সেই অবিরিয়া পৌঁছল এই শতাব্দীর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। 

আমরা এই প্রজন্মে চন্দ্রবিন্দুর গানে বরদার বাতেলা শুনে ভালো হতে শিখেছি, আর পুরনোকে এভাবেই উদযাপন করেছি দাদার কীর্তির ‘কেদারে’।