১৯০৫ সাল। ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ নিল। সেই সময় বাঙালি জাতি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেমে লড়াইয়ের যৌথ মুখ প্রকাশ্যে এনেছিল । ১৯৪৭ সালে নানান চক্রান্ত ও দুরভিসন্ধির ফলশ্রুতিতে ধর্মভিত্তিক দুইভাগে বিভক্ত স্বাধীনতা পাওয়া গেল । সেই স্বাধীনতা পাওয়ার এক মাসের মধ্যে বোঝা গেল শুধু ধর্মকে কেন্দ্র করে দেশভাগ করার কোন যুক্তি ছিল না। শুধু ধর্মের টান মানুষকে এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারে না । তাই পূর্ব পাকিস্থানে বাংলা ভাষাকে অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করলো । বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্বত্বেও বাংলাভাষাকে দমিয়ে রাখার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূচনা হয়ে গেল ১৯৪৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্দোলন শুরু হয়ে গেল অধ্যাপক আবুল কাসেমের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন তমুদ্দিন মজলিস এর হাত ধরেও । ১৯৪৮ সালে  পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু আর ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্থানের সংসদে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলাকেও রাখার দাবি নিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয় । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পূর্ব পাকিস্থানের সংসদে স্পষ্ট ভাবে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের ভাষা হিসাবে গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন । তার প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করা হয় । আগুনে ঘি পড়ে যায় । পূর্ব পাকিস্থানে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় । আন্দোলনকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে ২৭ ফেব্রুয়ারি  রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালেই ছাত্রদের এক সভায় জিন্না বললেন- উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা সত্ত্বেও ছাত্ররা জিন্নার এই কথা মেনে নেয় না। তার সামনেই প্রতিবাদ জানায় । জিন্নার প্রিয় ভাষায় –“নো নো” বলে তারা চিৎকার শুরু করে। বাংলা ভাষাকে ঘিরে আন্দোলনের অঙ্কুরোদ্গমের শুরু হয় এভাবেই। এই পর্বটাকে যদি আন্দোলনের প্রথম পর্ব বলা হয়, তাহলে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি আজিমুদ্দিনের ভাষণের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। উনিও জিন্নাহর সুরেই বলেছিলেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের  রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ৩০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট করে। ৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয়ভাবে সমাবেশ ও মিছিলের ডাক দেয়। এই পরিস্থিতিতে সরকারও আক্রমণমুখী ভুমিকা নেয় । সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে।  এর প্রতিরোধে প্রাণকে বাজি রেখে ছাত্রদের, মাঝি-মাল্লা, শ্রমিক, কৃষক সহ সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের গল্প সবাই জানেন । মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউর । বাংলা ভাষাকে রক্ষাকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তের বিনিময়ে বাঙ্গালীদের এই প্রতিরোধ আন্দোলনের অভিঘাত সভ্যতার ইতিহাসে চিরন্তন স্থান করে নিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই ।

১৯৫২র ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যেমন বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছেন, তেমনি ১৯৬১র ১৯ মে আসামের শিলচরে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছেন ১১ জন। এই প্রসঙ্গে ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের বক্তব্য বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন- “এটা শুধু একটি ভাষা গোষ্ঠীর কাছে তার ভাষার বৈধতা বা ভালোবাসার প্রতিষ্ঠা নয়। এইসব আত্মদান…. বুঝিয়ে দেয় যে ভাষা মানুষের কতটা মৌলিক সম্পদ। ভাষা বিপন্ন হলে কিংবা আধিপত্যের দ্বারা অপমানিত হলে সচেতন মানুষ কিভাবে প্রাণ পর্যন্ত তুচ্ছ করে তার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসতে দ্বিধা করে না। “

তবে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রাম সূচনা হয়েছিল ১৯৫২ তে তা ক্রমে ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মতন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর- যেদিন বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি বিরোধী পাকিস্তানি মৌলবাদী শক্তির হাত থেকে বাঙালি জয় ছিনিয়ে নেয় এবং বাংলাকে একটি স্বাধীন, সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় ভাষা হিসাবে প্রথম প্রতিষ্ঠা করে। আর একটি দিন বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর অন্য সব ভাষার থেকে আলাদা রূপে মহিমান্বিত করেছে । দিনটি হল ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর । এই দিন ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের সুপারিশ গৃহীত হয়।

বাংলা ভাষার বিশ্বগত মর্যাদা তৈরির ক্ষেত্রে কয়েকটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের কথা উল্লেখ করেছি। তার সাথে আরো অভিজ্ঞতা যুক্ত করা যায় নিশ্চয়ই। তবে মানতেই হবে কয়েকটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মানবিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা এমন একটা মর্যাদার অধিকারী হয়েছে যে মর্যাদা পৃথিবীর ৭০০০ ভাষার অন্য কোন ভাষার নেই, এমনকি দুনিয়ার সবচেয়ে আধিপত্যকারী ভাষা ইংরেজিরও নেই। তাই আপামর সচেতন বাঙ্গালীর কাছে সন্ধিক্ষণগুলো স্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবেও ।

একই সাথে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে দেশে দেশে মাতৃভাষা আধিপত্যবাদী শক্তির তীব্র আক্রমণের মুখোমুখি । চারদিকে মাতৃভাষা চর্চাকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হচ্ছে ঠান্ডা মাথায়। জীবনদর্শন বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে যাচ্ছে চারদিক। নির্লিপ্ততা গ্রাস করছে । মানুষের মাথা কিনে নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। তাই মাতৃভাষা চর্চার যাবতীয় ঐশ্বর্য লুট হয়ে যাচ্ছে দেখেও আমরা নির্বিকার চিত্তে জীবন উপভোগে ব্যস্ত আছি অন্য কোথাও।