
“এম এম মনসুর আলি জেলে পাকিস্তানের শাসকদের হাতে শাহদাত বরণ করেছিলেন জানেন তো? এই মঞ্চটা ওঁর নামেই।” মমিন ভাই বলেছিলেন। মঞ্চ মানে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের আস্ত অডিটোরিয়াম একটা। জাতীয় শিল্পকলাকেন্দ্রও বটে। একতলা দোতলা মিলে শ পাঁচেক আসন। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিকায় নাটক এই বাংলা থেকে গিয়ে অভিনয় করব সেই মঞ্চে ভেবেই শিহরণ জেগেছিল। আমাদের “বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম” মার্কা ঠাট্টার অভ্যাসের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে সেই প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চের সামনের আসনের একটি সারি “বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত”। বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের কাছে তো বটেই সাধারণ মানুষের কাছেও “মুক্তিযুদ্ধ” ও “স্বাধীনতা” দুটো শব্দই আবেগময়।

মঞ্চে দাঁড়িয়ে এখানকার সংস্কৃতিকর্মী মমিনভাই অর্থাৎ বাংলাদেশের খ্যাতনামা নাট্যাভিনেতা ও পরিচালক মমিন বাবু- স্পষ্ট উচ্চারণ করেন,” পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের ভাষা এক সংস্কৃতিও এক মাঝখানে কেবল কাঁটাতারের বেড়া “! নিজের কানে শুনে প্রত্যয় হোল, আমাদের এই বাংলায় ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা নেত্রীরা বিদ্বেষপ্রসূত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রয়োজনে ঠিক কতটা আবোলতাবোল বকেন।

মমিন বাবু
নিজের চোখেই দেখেছি সিরাজগঞ্জের কালিমন্দির, শিব মন্দির, শ্মশান যত্নে রাখা। কোভিড মরশুমে চাকরি হারানো তরুণ নাট্যকর্মী সুমন চক্রবর্তী নিজের রোজগার করেন টিউশনি করে এবং পুজো করে। কতগুলো সরস্বতী পুজো হয় এখানে? উত্তর পেলাম “অনেক গুলো। বাড়ি বাড়িতে হয়,স্কুল কলেজেও হয়। “

মাত্র আড়াইদিনে একটা দেশকে কতটুকুই বা চেনা যায়? প্রতিবেশী দেশ হলেও বোধহয় সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাংলাভাষী বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু কিছুটা অন্যরকম হয় কারণ ভাষা ও সংস্কৃতির সামঞ্জস্য! ওপার বাংলার প্রকৃতিও পশ্চিমবঙ্গের মতোই যদিও দেখলাম, সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে সেখানকার শিক্ষিত সচেতন মানুষ দলমত নির্বিশেষে আমাদের চেয়ে অনেকবেশি পরিবেশ সচেতন অন্তত প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার বিষয়ে।

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের এই তুচ্ছ সদস্যকে গড়িয়া একত্রে নাট্যদল উৎপল দত্তের ঠিকানা নাটকে অভিনয়ের সুযোগ না দিলে থিয়েটার কর্মী হিসাবে আমার সংক্ষিপ্ত বাংলাদেশ সফর সম্ভব হতো না। অনুজপ্রতিম দুই সহযোদ্ধা দক্ষ পরিচালক-অভিনেতা ভাস্কর সান্যাল এবং আলোকশিল্পী বাবলু সরকারের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।

মমিন বাবুর সঙ্গে গড়িয়া একত্রে র পরিচালক ভাস্কর সান্যাল এবং উদিচীর আঞ্চলিক সংগঠক হীরক গুণ

বাবলু সরকার
বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত উৎপল দত্তের ঠিকানা নাটকটি আমাদের সাহেবের নিজের দল পিএলটি খুব বেশি মঞ্চস্থ না করলেও গত গড়িয়া একত্রে কিন্তু গত তিন বছরে প্রায় ঠিকানা নাটকটির প্রায় ছাব্বিশটি শো করেছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মমিন বাবুর জন্য সাতাশতম শো এর সুযোগ এল মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম এম মনসুর আলি অডিটোরিয়ামে নাট্যালোক গোষ্ঠী তাঁদের দলের তেইশতম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে পাঁচদিনের নাট্যোৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে। মমিন বাবু নিজে একজন নাট্য সংগঠক শুধু নন বাংলাদেশের তিনশোটি নাট্যদলের যে সম্মিলিত মঞ্চ রয়েছে তার অন্যতম নেতা। গ্রুপ থিয়েটারের নিবেদিত প্রাণ একজন মানুষ যিনি প্রধানত মঞ্চ নাটকে ছাড়া ক্বচিৎ কদাচিৎ টেলিভিশন চ্যানেলের কাজ করেন এবং চলচ্চিত্রে কখনও কাজ করেননি সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা দেখার মতো ! গত তেইশ বছর ধরে কোন সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজেরা চাঁদা তুলে এই উৎসব সংগঠিত করেছেন। দূর থেকে আসা আমন্ত্রিত নাট্যদলগুলির থাকা খাওয়ার খরচের অনেকটাই মমিন ভাই নিজেই বহন করেন। আমরা গড়িয়া একত্রের বাইশ জনের টিম তিনদিন দুপুরে মমিন ভাইয়ের বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করেছি নাট্যালোকের স্বেচ্ছাসেবকবন্ধু এবং বাংলাদেশের অন্যান্যপ্রান্ত থেকে আসা নাটকের দলের কর্মীদের সঙ্গে। ভাবীজান অর্থাৎ মমিন ভাইয়ের জীবনসঙ্গিনী নিজেই হেঁসেল সামলেছেন, যেন তাঁরই পারিবারিক আনন্দানুষ্ঠান।
বেনাপোল থেকে যশোর রোড ধরে বাস ধরে সিরাজগঞ্জে পৌঁছতে সময় লাগে কমবেশি সাড়ে ছয় ঘন্টা। বাবলু এবং মমিন ভাইয়ের দৌলতে বাসের “পেটে” আমাদের ব্যক্তিগত লাগেজ ও গড়িয়া একত্রের প্রপ এবং কস্টিউমের ট্রলি ব্যাগ ঢুকে পড়েছিল ট্যাগ ছাড়াই। আমরা দুপুরে বাসে উঠে দু-পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সিরাজগঞ্জে যখন পৌঁছলাম তখন রাত আটটা চল্লিশ। সরাসরি বাস দাঁড়িয়েছিল শহীদ এম এম মনসুর আলি অডিটোরিয়ামের সামনেই। সেখানে তখন সবে শেষ হয়েছে নাট্যোৎসবের আয়োজক দল নাট্যালোকের নিজস্ব প্রযোজনা শেক্সপিয়রের “মিড সামার নাইটস ড্রিম “অবলম্বনে ডঃ মাহফুজা হিলালি রচিত নাটক ” পূর্ণিমা রাতের মুখগুলি “। পরিচালনা আমাদের কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী দেবাশিষ ঘোষের। মমিনভাইকে ফোন করা হলে জানা গেল, রাজা র চরিত্রের অভিনেতা তখন কষ্টিউম পাল্টাচ্ছেন। আলো ঝলমল সুসজ্জিত অডিটোরিয়ামের গাড়িবারান্দায় দেখা হোল বাংলাদেশের প্রবীণ আলোকশিল্পী জীবন সাহার সঙ্গে নাট্যালোকের প্রযোজনাতে তো বটেই এই নাট্যোৎসবে সব নাটকেই ওঁর পরিকল্পনার আলো। বাবলুর নিজের দাদার মতো। জানা গেল আমাদের শো য়ে বাবলুকে সহায়তা করবেন জীবনদার সহকারীরাই। বাবলুর মেয়ে আমাদেরও কন্যাসমা দেবলীনা এইসময়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চের একমাত্র মহিলা আলোকশিল্পী। সদ্যবিবাহিতা দেবলীনাও গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে ওর জীবনসঙ্গী ছন্দমকে নিয়ে। ” ঠিকানা” নাটকে আলোকসম্পাতে বাবাকে সহায়তা করে দেবলীনা।
জীবনদার সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকেই চলে এলেন মমিনভাই। হাসিমুখে যেভাবে হাত মেলালেন মনে হল কতদিনের চেনা। অডিটোরিয়াম থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথে হোটেলের রাস্তার দূরত্ব টের পেলাম না গল্পে গল্পে। হোটেলের খাবার নয় আমরা পেলাম আয়োজকদের খাবার। নিয়ে এলেন নাট্যালোকের তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা। তেরাত্তিরে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। দেখলাম, আমাদের এই বাংলার মতোই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, বিভিন্ন পেশায় যুক্ত নানা বয়সের নাট্যপ্রেমী মানুষ হাসিমুখে পরিশ্রম করছেন নাট্যোৎসবকে সফল করার জন্য। আমাদের চেনা ছবি। মনে হলো সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উর্ধ্বে শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চার ধর্ম যা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “কোথা বিচ্ছেদ নাই!”
(পরবর্তী পর্বে )