সেই যখন এ পাড়ার রাম আর ও পাড়ার আনসার পরিচিত হয়েছিল স্বাধীনতা শব্দটার সঙ্গে,সেই তখন থেকেই “র‍্যাডক্লিফ লাইন” এর দায় ভারতীয়রা আজও বয়ে চলি। বয়ে চলি কারণ আজ আমার গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত সরকার,বারে বারে সংবিধান অমান্য করে খুব স্পষ্ট করে বলে ” হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান”। বহুল জনসংখ্যার দেশ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় একুশ শতকের উন্নত সমাজেও দেখতে হয় ব্রাহ্মণ এর সাথে দলিতের বিভাজন, যাদব এর সাথে ঠাকুরের বিভাজন। সত্যি বলতে বর্তমান সরকারের ” হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান” নীতি  হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের দ্বন্দ্ব দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হয় উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সাথে নিম্ন বর্ণের হিন্দুর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। 


ধর্মের ভিত্তিতে যদি ইতিহাসকে ফিরে দেখি তবে দেখব ভারতে কোনো কালে হিন্দু বলে কোনো জনগোষ্ঠী ছিল না, ছিল না হিন্দু বলে কোনো ধর্ম এমনকী “গীতা” তেও হিন্দু বলে কোনো শব্দ কোথাও ব্যাবহৃত হতে দেখা যায় নি। ভারতবর্ষের মূল ধর্ম বলতে যদি কিছু থাকে তা আদতে ছিল বৈদিক ধর্মাচার । আর পূজাপদ্ধতি মূলত দু রকমের ছিল প্রাথমিক দিকে প্রকৃতি পুজা বা নারীতত্ত্বের পূজা এবং পরবর্তীতে অবতারবাদের ভিত্তিতে পুরুষত্ত্বের পুজা,যার মাধ্যমে আসলে পুরুষতন্ত্রকতার ধ্বজা ওড়ানোই হয়েছিল। সেই উড্ডীন ধ্বজার পরতে পরতে মিশে ছিল বিভাজন। অনেকে বলেন মহাভারতের সময়েও নাকি বৈষ্ণব ধর্মাচারের অস্তিত্ব ছিল। তবে সে বৈষ্ণব ধর্মচারণের ভিত্তি আসলে সাকারবাদের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া অবতারবাদ। বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র পুরাণ ইত্যাদি লক্ষ্য করলেই দেখা যায় এর অধিকাংশই রচিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক  অবতারবাদের উপর ভিত্তি করে। উদাহরণ হিসাবে শিবমহাপুরাণ ( শিব অবতার বা নায়ক), স্কন্দ পুরাণ ( কার্তিক অবতার বা নায়ক) , মুদগল পুরাণ ( গণেশ অবতার বা নায়ক), বিষ্ণু পুরাণ ( নারায়ণ অবতার বা নায়ক)। রামায়ন বা মহাভারতের মত মহাকাব্য ও মূলত অবতারবাদেরই প্রতিফলন। বাস্তবিক বিষয় হল, সকল প্রকারের ধর্মাচার, ধর্মমত প্রথমে মানবকল্যাণের কথা ভেবেই তৈরী হলেও পরে তা  নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণীর স্বার্থজনিত কারণে ক্ষমতাসীনের পক্ষে কাজ করতে শুরু করে। এবং ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারীরা ধর্ম তথা ধর্মাচারকে ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করতে থাকে। যার ফলাফল হিসাবে আম নাগরিকের জন্য শুধুই শোষণের শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকে না… 


ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারত ভূখন্ড বারে বারে মানুষের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। যেখানে ভারতে যেমন এক সুদীর্ঘকাল ধরে ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকরা শাসন করেছে,ঠিক তেমনই শাসন করেছে খ্রীষ্ট মতের পথিকরাও। আবার ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলে শাসন করেছে বৌদ্ধ ধর্মাচারী শাসক। প্রায় সব শাসকগোষ্ঠীই কোনো না কোনো ধর্মাচারের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও ধর্মকে কোনো দিন নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দেন নি। ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে রাজানুকূল্যে কিংবা সরকারি বদান্যতায় মঠ, মন্দির, গীর্জা, মসজিদ, সেনেগগ তৈরী হলেও শাসক কোনোদিন ই বলেন নি “অমুক ধর্মাচার না করলে এই দেশে থাকা যাবে না”। বরং লক্ষ্যণীয় সে সব শাসকরা অনেকক্ষেত্রে সমাজসংষ্কার এর মাধ্যমে আদপে ভেঙে দিয়েছেন ধর্মীয় কুসংষ্কার কু রীতিগুলোকে। আবার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে তাকালেও দেখব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শিখ, জাঠ এরা যেমন আছেন ঠিক তেমন করেই বহু ইসলাম ধর্মাচারণকারী আছেন যাঁরা ভারতকে ভালবেসে ভারতীয়ত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁদের লড়াই আন্দোলনের প্রতিপদে। যে ভারতীয়ত্বর মূল হল তত্ত্ব সম্প্রীতি ছাড়া কিছুই নয়। শুধুমাত্র একটি র‍্যাডক্লিফ লাইন আর কিছু ক্ষমতালোভী প্রাণীর ভাবনার নিরিখে বিচার করলে তা কখনই সঠিক নয়, আর তা উচিৎ ও নয়। 

আমার রাজ্য পশ্চিমবাংলা যেমন প্রাকস্বাধীনতা কালে বারে বারে আলাদা পথের সন্ধান দিয়েছে ঠিক তেমন করেই ধর্মভাবনার নিরিখেও বাংলা তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। বাংলায় কখনই রাজনৈতিক কৃষ্ণ পূজিত হন না, গীতাকার কৃষ্ণ চর্চিত হন না, বরং বাংলায় কৃষ্ণ চরিত্র প্রেমের প্রতীকে ব্যাপিত, এবং বাৎসল্য স্নেহের রূপকে যাপিত ও চর্চিত হন। আবার বাঙালির সবচেয়ে বড় মিলনউৎসব দুর্গাপুজোতেও দুর্গা যত না দেবী রূপে পূজিতা তার চেয়ে অনেক বেশী বাড়ির মেয়ে উমা রূপে গৃহীতা হয়ে থাকেন। এবং দুর্গাপুজো ” ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরছে” এই ভাবনাতেই আদৃত হয়। আবার বাংলাতেই সম্প্রীতি ভাবনার ফসল হিসাবেই সত্যপীরও পূজিত হন। আর বাংলায় রাম চরিত্র বেঁচে থাকেন শোক দুঃখ ইত্যাদির প্রতীক হিসাবে। কোনো দুঃখজনক ঘটনায় খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবেই বেরিয়ে আসে ”হে রাম”। 
পরিশেষে বল যায়, বর্তমান সরকার গৃহীত ধর্মের ভিত্তিতে,ধর্মাচারের ভিত্তিতে বিভাজনের নীতি বাংলা আগেও গ্রহণ করেনি,যার প্রমাণ হিসাবে বলা যায় বাংলার পূর্বতন সরকারের সেই স্তম্ভের কথা যিনি সোচ্চারে বলেছিলেন -” সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয়না” আর আগামীতেও প্রগতিশীলরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিভাজনের বিরুদ্ধে থেকেই ভারতের ভারতীয়ত্ব রক্ষা করবে এই ভিত্তিহীন বিভাজনকে গ্রহণ না করেই….