বিবিসি তথ্যচিত্র, বিলকিস বানো এবং জনসমাজ 

মালিনী ভট্টাচার্য

                        

বিবিসি-র তৈরি তথ্যচিত্র ‘দি মোদি কোয়েশ্চেন’ – যা নাকি ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার পরে তারা বানিয়েছিল—বর্তমানে জনসমক্ষে আসার ফলে মোদি সরকার ঈষৎ বিপন্ন বোধ করছে।  ছবিটি ভারতের সম্মান ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী, ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন ইত্যাদি অজুহাত দিয়ে ছবিটি যাতে কেউ দেখতে না পায় তারা সেই বন্দোবস্ত করেছিল; যারা সরকারি চোখরাঙ্গানি সত্ত্বেও ছবিটি দেখেছে বা তা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে তাদের নানাভাবে প্রশাসন ও তার মাস্তানদের সাহায্যে হয়রানি করা হয়েছে, সবশেষে দিল্লির বিবিসি অফিসে আয়কর হানার জুজু নামিয়ে দেশেবিদেশে ধিক্কার অর্জন করেছে মোদি সরকার। বিজেপি-র পক্ষে আরেকটু অসুবিধার কথা যে, ঘটনাটি ঘটেছে এমন এক সময়ে যখন আদানি-কেলেংকারির পর্দাফাঁস করেছে আমেরিকার একটি ছোট্ট গবেষণাসংস্থা শেয়ারমার্কেটের তথ্য যাচাই করতে গিয়ে। যে আর এস এস নিজেদের একটি অরাজনৈতিক সমাজসেবী সংগঠন বলে বড়াই করে তাদেরও এবার প্রকাশ্যে মোদি তথা দেশের সম্মানহানিকর বৈদেশিক ষড়যন্ত্রের জিগির তুলে বাজারে নামতে হয়েছে।

এতদিন পরে ঠিক এই সময়েই বিবিসি-র তথ্যচিত্রটি কীভাবে জনসমক্ষে আসতে পারল সেই প্রশ্ন আমি এখানে তুলতে চাইছি না। বরং আমি প্রশ্ন করব, এতদিন ব্রিটিশ সরকার এটিকে কেন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। বিশেষত ২০০২এর ঘটনাবলী সম্বন্ধে বিবিসি-র অনুসন্ধিৎসার একটি কারণ ছিল ব্রিটেনে বসবাসকারী এক মুসলিম ভদ্রলোকের এই অভিযোগ যে তিনি ঐ সময়ে আমেদাবাদে গিয়ে খুনোখুনির ঘটনার মধ্যে পড়ে যান, তাঁর দুই আত্মীয়কে সেসময়ে হারিয়ে ফেলে একা ব্রিটেনে ফিরতে বাধ্য হন এবং অনেক চেষ্টা করেও তাদের আর কোনো খোঁজ পাননি। এক ব্রিটিশ নাগরিকের অভিযোগের সূত্র ধরে বিবিসি-র ২০০২এর ঘটনাবলী নিয়ে অনুসন্ধান, অন্তত এই যুক্তিতেও তথ্যচিত্রটির বহুল প্রচার হবার কথা ছিল। বস্তুত এই গণহত্যায় গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদির ভূমিকা এবং ভারতীয় মুসলিমদের সম্বন্ধে তার ঘোষিত মনোভাব জেনেশুনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বেশ কয়েকবছর মোদিকে সেদেশে প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিও তার থেকে রাজনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখেছিল।

অথচ বিবিসি-র স্বাধিকার এবং তাদের সংগৃহীত তথ্যের যাথার্থ্য এবং নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত হলেও  তথ্যচিত্রটি কিন্তু তাদের মহাফেজখানায় ধুলো খাচ্ছিল। এইসময়ে বা তার পরের কয়েকবছরের মধ্যে তা প্রকাশ পেলে আরো বহুবিধ তথ্যপ্রমাণের পাশাপাশি এই ছবির কিছুটা তাৎপর্য হয়তো এদেশেও থাকত। মোদি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হবার পরে ‘যো জিতা ওহি সিকন্দর’ এই আপ্তবাক্যের অনুসরণ করে তার বিদেশসফরে আন্তর্জাতিক স্তরে যাবতীয় আপত্তি প্রত্যাহার করা হয় এবং আরো সম্প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত মোদি এবং তার ক্ষমতাসীন সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে গুজরাটের গণহত্যায় লিপ্ত থাকার যথেষ্ট প্রমাণ খুঁজে না পেয়ে তাদের মামলা থেকে খালাস করায় সর্বত্রই প্রধানমন্ত্রী মোদির বিশ্বাস্যতায় সীলমোহর পড়ে।  তারপরে বিবিসি-র তথ্যচিত্র কি পুরনো কাসুন্দিতে পরিণত হয়নি? বড়জোর তা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই কথাগুলিই যা আমরা অনেক আগেই শুনেছি বা জানতাম। এই উদ্ঘাটনের পরে আমরা তথ্যগুলিকে মনে করার আরেকটি সুযোগ পাচ্ছি, ছবিটি দেখাও একধরনের প্রতিবাদে পরিণত হয়েছে বটে, কিন্তু তার ফলে মোদি অস্বস্তিবোধ করলেও এখন আর এটুকুতে তার আসন টলবে না।

ঐ তথ্যচিত্রটিতেই এমন কথা রয়েছে যে মোদি তার ঝটিকাবাহিনীর আড়ালে থেকে যেকাজে সফল হল তা হচ্ছে গুজরাটের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক বিভাজন। সেই বিভাজনের ফলে আমেদাবাদ ও অন্যত্র মুসলিম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পুরো উঠে গেল; যেসব এলাকাতে হিন্দুমুসলিম ব্যবসায়ী বহু প্রজন্ম ধরে একত্রে বাস করছিল সেখানে সব ব্যবসার মালিক হয়ে দাঁড়াল হিন্দুরা; গুজরাটের এই সামাজিক স্তরে যে সমন্বয়ী সংস্কৃতি দেখা যেত তার শ্মশানের ওপরে এক নতুন গুজরাটের উদয় হল যেখানে উগ্র সাম্প্রদায়িক এক সরকার তার অবিচ্ছিন্ন শাসন লাগু করল। দেশভাগের আগে এবং পরে বাংলাও অনেক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় কলংকিত হয়েছে, কিন্তু এত ভয়াবহ বিভাজন সেখানে ঘটানো যায়নি। ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় গুজরাট মানবাধিকার ও মানবোন্নয়নের মাপকাঠিতে সবচেয়ে পিছনে থেকেও বারংবার নির্বাচনে এই সরকারকেই ফিরিয়ে আনতে লাগল। গুজরাটে শাসকদল যতোই হিংস্র হয়েছে বিরোধীপক্ষ ততোই সংকীর্ণ পরিচিতিসত্তার রাজনীতি ও ‘নরম হিন্দুত্বে’র দাওয়াই দিয়ে হিংস্রতার প্রতি নির্বাচকমণ্ডলীর আকর্ষণের ব্যাধিকে বরং বাড়িয়েই তুলেছেন।

যে জরুরি কথাটি তথ্যচিত্রের বিশ্লেষণে আসেনি তা আমাদের অন্তত মনে রাখা উচিত। যখন খুনজখম চলছিল সেই সময়ে হয়তো আমেদাবাদের ছোট বা মাঝারি, এমনকী বড়ো ব্যবসায়ীরাও মনে করেছিলেন মুসলিমদের সরাতে পারলে তাঁদের শ্রীবৃদ্ধির পরিসর অনেকখানি বেড়ে যাবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই সাফাই অভিযানের মধ্য দিয়ে গুজরাটে এবং পরে সারা ভারত জুড়েই এক অন্য অর্থনীতির আবাহন করা হল। পুঁজিবাদের নিজস্ব নিয়মে সমস্ত ছোটো ব্যবসাকে গিলে নিয়ে যারা নয়া উদারবাদের সহায়তায় সারা দুনিয়াতে কর্পোরেট জাল ছড়ায় তাদের, শুধু তাই নয় অন্তর্ঘাতী স্যাঙ্গাতি পুঁজির তথা মোদি-বন্ধু গৌতম আদানির বাড়বাড়ন্ত ঘটল। গুজরাট শুধু হিন্দুত্ববাদের লেবরেটরি ছিল না, ছিল পুঁজিবাদের দানবের নয়া নির্মাণেরও। সেখানেই প্রথম দেখা গেল উগ্র হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে কর্পোরেট পুঁজিকে গাঁটছড়া বাঁধতে।

ইতিহাসের দিকে তাকালে এদেশে হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে ছোটো মাঝারি পুঁজিপতিদের একটা সম্পর্ক দেখা যায়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই কিন্তু বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও আন্তর্জাতিক পুঁজির মধ্যস্থতায় তারা ভোল পালটিয়ে এক ঝাঁচকচকে বিশ্বায়িত রূপ নিতে শুরু করেছিল। গুজরাটে তা ২০০২-পরবর্তী পর্বে ফলিত অর্থনীতির রূপ নিল। আজ যখন কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রকের অনুমোদনে গুজরাট সরকারের সক্রিয়তায় বিলকিস বানোর ধর্ষক সাজাপ্রাপ্ত খুনে গুণ্ডাদের রেহাই মিলে যায় তখন তার পিছনে শুধু হিন্দুত্ববাদের আত্মপ্রত্যয় থাকে না, থাকে স্যাঙ্গাতি অর্থনীতির কোনোকিছুর তোয়াক্কা-না-রাখা অনুমোদনের জোরও। এখন যা শুধু গুজরাটের সরকার নয়, কেন্দ্রের সরকারকেও পরিচালনা করছে। এতে আজ আর কোনো সন্দেহ নেই যে একে ‘নরম হিন্দুত্ব’ দিয়ে ঠেকানো যাবে না, নয়া উদারবাদী উন্নয়নের মরীচিকার সাহায্যেও নয়। এই উভয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে শুধু সাম্যমুখী অর্থনীতি এবং তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কযুক্ত সমন্বয়ী সংস্কৃতি।      

বিবিসি-র তথ্যচিত্র আজ জনসমাজের একটি অংশকে আলোড়িত করছে। বিশেষত ছাত্রযুবসমাজে ব্যাপক অর্থনৈতিক হতাশার হাত ধরে সমাজের কোনো একটি অংশকে (মুসলিম/দলিত/ আদিবাসী) শত্রুহিসাবে দেখার যে প্রবণতা কাজ করে সেখানে তথ্যচিত্রটি এর রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে হয়তো আমাদের সতর্ক হতে বলে। কিন্তু আবার তার থেকে এই হতাশাতেও আমরা পৌঁছতে পারি যে অপশাসনের জগদ্দল ভারকে সরানো নেহাৎ অসম্ভব; কারণ গুজরাটে এমন সাংঘাতিক ঘটনা ঘটার পরেও এর পরবর্তী বাড়বাড়ন্তকে তো আমরা ঠেকাতে পারিনি। মোদিদের যুক্তিও কিন্তু ঠিক তাই। সাজাপ্রাপ্তদের রেহাইয়ের খবরে বিলকিস বানোর অসহায় মুখের ছবি আমাদের মনে করায় অনেকেই গুজরাট সরকারের কাজটাকে সমর্থন করেননি, কিন্তু বিলকিস বানোর মতোই অসহায় বোধ করেছেন।

তাঁদের মনে করাই, বিলকিস কিন্তু সুবিচারের জন্য তাঁর লড়াই ছাড়েননি। তিস্তা শেতলবাদকেও কিন্তু জামিন দিতে বাধ্য হয়েছে আদালত। সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার গতি সবসময়েই সমাজের ওপরতলা থেকে নীচতলায়। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খা হতাশা বিবাদ-বিসংবাদকে শাসক নিয়ন্ত্রণ করে তাকে হিংস্রতায় পরিণত করে, গুজরাটে ২০০২ সালের ঘটনাবলী তারই প্রমাণ। গোধরায় কারা ট্রেনে আগুন লাগিয়েছিল, কীভাবে আগুন লাগল তার প্রকৃত তথ্য বিবিসি-র লোকেরাও জানে না; কিন্তু এটা আমরা সবাই জানি যে করসেবকদের মুসলমানরা হত্যা করেছে এই জিগির তুলে মৃতদেহগুলিকে আমেদাবাদে নিয়ে গিয়ে তার প্রকাশ্য প্রদর্শনী করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল গুজরাটের মোদি-সরকার। ঘটনাক্রমের শুরু এখানেই। আর এর উলটো প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে নীচ থেকে ওপরের দিকেই। শুধু সংগঠিত বামপন্থীরা এলড়াই লড়তে পারে না। কিন্তু নীচুতলার খেটে-খাওয়া মানুষের ভিতর সেই আগুন তারা জ্বালাতে পারে যা অপ্রতিরোধ্য ঐক্যবদ্ধ গতিতে ওপরদিকে উঠে পুড়িয়ে ছাই করবে মোদি-আদানির স্যাঙ্গাতি আর তাদের দূষিত মতাদর্শের জঞ্জাল, আর পত্তন করবে নতুন সমাজব্যবস্থার।।