ভারতের প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্র  ৭৫ বছরে পড়ল। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান গ্রহণেরও ৭৫ বছরে পদার্পণ ঘটল। ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের সাধারণতন্ত্রের মূল নির্যাসগুলো অক্ষত আছে? নাকি যত দিন যাচ্ছে সেগুলো ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণুতার পথে এগিয়ে চলেছে? আমাদের দেশের অর্থনীতির চিত্র কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে? অর্থনীতি বলতে জি ডি পি (Gross Domestic Product) নয়,আম জনতার জীবনের মান, তাদের মাথাপিছু আয়, ক্রয়ক্ষমতা, খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ কতখানি, সেইসব বিষয়গুলিই গণনায় রাখা দরকার। মাত্র কয়েকমাস আগেই নয়াদিল্লিতে হয়ে গেল জি-২০ সম্মেলন। বিশ্বের ২০টি উন্নয়নশীল দেশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ভারত জি-২০ ভুক্ত অন্যতম বড়ো দেশ এবং আয়োজক দেশও বটে। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল বি জে পি এবং আর এস এস-এর অনেক লম্ফঝম্ফ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। বিদেশী অতিথিদের সামনে দেশের দৈন্যদশা ঢাকতে দিল্লির রাস্তার পাশের ঝুপরি ও বস্তিগুলোর বেশ কিছু বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, আর বাকিগুলো সুদৃশ্য কাপড়ের পাঁচিল তুলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পথকুকুরের সঙ্গে যেন গরীব মানুষকেও খোঁয়াড়ে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেছিল প্রশাসন! এই সম্মেলন শেষে মোদীর অনুগামীরা তাঁকে 'দেশগুরু' থেকে 'বিশ্বগুরু'র আসনে বসিয়ে দিলেন। এখন দেখা যাক এই 'দেশগুরু' তথা 'বিশ্বগুরু'র দশ বছরের নেতৃত্বে আমাদের দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। জি-২০ ভুক্ত কুড়িটি দেশের মধ্যে ভারত মাথাপিছু আয়ে ২০তম, মানব উন্নয়ন সূচকে ২০তম, শিশুমৃত্যুর হারে ১৯তম, শ্রমশক্তির ব্যবহারে ১৯তম এবং সংসদীয় ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণে ১৮তম স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। (সূত্র : দি হিন্দু, ১৩ সেপ্টেম্বর,২০২৩)। আর একটি তথ্য অনেকেই জানেন যে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭ নম্বরে। সারা বিশ্বের ৮২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ অপুষ্টির শিকার, যার মধ্যে কেবলমাত্র এই দেশেরই ২২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ রয়েছেন। বার্ষিক মাথাপিছু খাদ্য ও দানাশস্য গ্রহণের হারে আফ্রিকার দেশগুলির (১৯০ কিলোগ্রাম) তুলনায়ও ভারত পিছিয়ে (১৭১ কিলোগ্রাম)। (সূত্র : রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংক্রান্ত রিপোর্ট)। এবার আসা যাক অর্থনৈতিক অবস্থার কথায়। এই দেশে মোদীর বদান্যতায় বিলিওনিয়ারদের পোয়াবারো হচ্ছে। ২০১৯ সালে আম্বানি-আদানি সহ দেশের ১ শতাংশ ধনীর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭.৯ লক্ষ কোটি টাকা। মাত্র তিন বছরে ২০২২ সালে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১০.২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি। উল্টোদিকে ২৫ শতাংশ অতি দরিদ্র মানুষের মোট আয় ২০১৯-এর ৩.৮ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমে ২০২২ সালে হয়েছে ৩.৪ লক্ষ কোটি টাকা। হ্রাস ১১ শতাংশ। মোদীর গালভরা 'মেক ইন ইন্ডিয়া' প্রকল্পে শিল্পক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ২০১৪ থেকে ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত ৫. ৯ শতাংশ। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশ মাত্র অর্জিত হয়েছে। এই সময়কালে শিল্পে কাজের সুযোগ ১২.৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১১.৬ শতাংশ। মোদী জমানার দশ বছরে বেকারির হার হয়েছে সর্বোচ্চ। MNREGA (একশ দিনের কাজের প্রকল্প)-র বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে অস্বাভাবিক হারে। ঘটেছে পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। সব দেখেশুনে মনে হয় এই দেশে প্রজাতন্ত্র কোথায়? এ তো আম্বানি-আদানিতন্ত্র! দেশের এই দুরাবস্থা দেখে-শুনে-বুঝেও মোদী বাহিনী ভারতকে 'তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ' বলে মিথ্যা প্রচার ও প্রতারণা করে চলেছে। আর আসল সত্য ঢেকে রাখার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের আশ্রয় গ্রহণ করছে। তাই তো রামমন্দির উদ্বোধনের নামে এত হুল্লোড় আর আড়ম্বর! এত অর্থ আসছে কোথা থেকে? কর্পোরেট আর সরকারের অর্থে এই রাজসূয় যজ্ঞ। বলুন তো, এটা ধর্মীয় বিষয়? নাকি আর এস এস-বি জে পি-র রাজনৈতিক কর্মসূচি! অনেকদিন আগে থেকেই ওরা রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্ককে উপজীব্য করে ধর্মীয় উন্মাদনা ও জিগির সৃষ্টি করে ওদের শক্তি বাড়িয়েছে, সরকারি ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। এখন ক্ষমতা ধরে রাখতে রামমন্দির উদ্বোধনের ঘটায় গণ হিস্টিরিয়া তৈরি করেছে ও করছে। এছাড়া ওদের সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই। কারণ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে ওদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ওরা একটাও কার্যকরী করতে পারেনি। বরং উল্টে দেশ ও দশের বিপুল ক্ষতি হয়েছে ওদের নীতিতে। ওদের 'আচ্ছে দিন' বা 'সুদিন'-এর প্রতিশ্রুতির পরিণাম হল আম্বানি-আদানি সহ কর্পোরেট মহলের সুদিন আর আম জনতার দুর্দিন। তাই তথ্যের কারচুপি করে ঢালাও মিথ্যা আর অপপ্রচার চালাও, বিরোধী স্বর ও কণ্ঠরোধ সহ গণতন্ত্র ধ্বংসের যাবতীয় প্রয়াস চালাও, ধর্মনিরপেক্ষতার তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধর্মীয় ভাবাবেগে সাদাসিধা ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভাসিয়ে দাও---এটাই ওদের রাজনৈতিক কৌশল। সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে মন্ত্রী হয়ে সেই সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে ওদের কোনওরকম লজ্জা করেনা। তাই প্রধানমন্ত্রী চলে যান মন্দির উদ্বোধনে, তাঁর অসংখ্য কাটআউটে সেজে ওঠে অযোধ্যা। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটির অর্থ রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখা। রামমন্দির উদ্বোধনের দিনগুলিতে আর এস এস-এর ভক্তদলের ভয়ংকর উল্লাসে লুকিয়ে থাকেন অন্য ধর্মাবলম্বীরা, সাহস পান না বাড়ি থেকে বেরোতে। অযোধ্যার উপযুক্ত সাজসজ্জার প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেক গরীবের ঘর-বাড়ি ভেঙে দিয়েছে উত্তর প্রদেশের বি জে পি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন। 'রামরাজ্য'র দৃষ্টান্ত? কারণ মোদীজী-র ভাষ্য অনুযায়ী মন্দির উদ্বোধনের পরেই আসতে চলেছে 'রামরাজ্য'! এরা রামের নাম নিয়ে যারপরনাই অনৈতিক ও অধার্মিক কাজ করে চলেছে। মহাকাব্যের নায়ক রামচন্দ্র ছিলেন রাজধর্মের জন্য দায়বদ্ধ, ন্যায়নীতির প্রতীক, প্রজাবৎসল রাজা। আর এরা? হিন্দুধর্মের অবতার স্বরূপ স্বীকৃত ব্যক্তিগণ কেউ তো অন্য মত ও ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ পোষণ করেন নি। বিবেকানন্দ মুচি-মেথর-চণ্ডাল ভারতবাসীকে ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। মোদীর বাহিনী কি তা জানেনা? রামকৃষ্ণ বলেছেন, যত মত তত পথ। আর ওরা তো অন্য কোনও মতপ্রকাশকেই সহ্য করতে পারে না, দেশদ্রোহ বলে মনে করে। হিন্দুধর্মের ঠিকা নেওয়া আর এস এস হিন্দুধর্মের তথাকথিত নীচু শ্রেণি যথা তপশিলী জাতি-উপজাতি-আদিবাসী-দলিতদের সম্মান করে? মোদীর রাজত্বে কতজন দলিত-আদিবাসী মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে তার কোনও হিসাব আছে? বি জে পি শাসিত ছোট্ট রাজ্য মণিপুর মেইতেই ও কুকি দুই সম্প্রদায়ের বিরোধে বিভক্ত। সেখানে মাসের পর মাস ধরে চলছে হিংসা,অগ্নিসংযোগ, খুন,নারী ধর্ষণ, লুঠতরাজ। বি জে পি মণিপুরে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ। আর এস এস নারীদের সম্মান করে? কাঠুয়া, উন্নাও, হাথরস সহ কত নারী ধর্ষণের ঘটনা বি জে পি-আর এস এস-এর প্রত্যক্ষ যোগসাজসে গত দশ বছরের মোদী জমানায় ঘটেছে কে তার হিসাব দেবে? ওদের রাজত্বে গণতন্ত্রের নমূনা একযোগে ১৪৩ জন সাংসদকে সাসপেন্ডের ঘটনায় কিংবা অজস্র সাংবাদিককে 'ইউ এ পি এ' কালা আইনে জেলে পুরে রাখার ঘটনায় প্রতিফলিত। আর এস এস-বি জে পি-র দ্বারা দেশের সংবিধান, প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বিপন্ন। আগামী দিনে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যেই তারা সব লণ্ডভণ্ড করে দেবার পথে এগোতে চাইছে। 'হিন্দুত্ব' এই অপকর্মে তাদের হাতিয়ার, যার সঙ্গে হিন্দুধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। হিন্দু ধর্মের ধার্মিক, ধর্মপ্রাণ মানুষদের সঙ্গে প্রতারণার স্বার্থেই ওদের মুখে ধর্মের কথা,রাম ও 'রামরাজ্য'র কথা। আসল লক্ষ্য পুঁজির নিষ্ঠুর শোষণকে আরও শক্তপোক্ত করতে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম। এখন সবথেকে বড়ো প্রশ্ন এই মহাবিপদ রুখবে কারা? অবশ্যই মানুষের শক্তি। কিন্তু খেয়াল রাখা দরকার, চরম দুর্নীতিপরায়ন শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস, যাদের দুর্নীতির তদন্ত মাসের পর মাস চলে গেলেও পরিণতি পায় না কেন্দ্রীয় এজেন্সি তদন্তের দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও, তাদের সম্পর্কে। এদের কোনও আদর্শগত অবস্থান নেই, নেই কোনও দায় দেশের প্রতি। শুধু মুখে বড়ো বড়ো কথা। এরাও এরাজ্যে পাল্টা মন্দির রাজনীতি করে যাচ্ছে। আর বি জে পি বিরোধী জোটকে ভঙ্গুর ও দুর্বল করার জন্য উল্টোপাল্টা বকে যাচ্ছে। এটাই ওদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল। সুতরাং আমাদের অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষকেই আজ অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক পথে এগোতে হবে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রুখতে, দেশ বাঁচাতে, দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বাঁচাতে। আসুন সবাই মিলে শপথ ও অঙ্গীকার গ্রহণ করি। রক্ষা করি সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতা।