ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মপরিচয়ই যখন মানুষের প্রথম ও প্রধান পরিচয় হয়ে ওঠার বিধিলিপি— তখন একুশে ফেব্রুয়ারি পেরেছিল ধর্মীয় পরিচয়কে দূরে সরিয়ে দিয়ে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায় বাঙালিকে উজ্জীবিত করতে।  একুশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালিকে উদ্ধুদ্ধ করেছিল জাতি-রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে। “একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারী এমনি এক যুগান্তকারী দিন।” (‘একুশে ফেব্রুয়ারী’- হাসান হাফিজুর রহমান)। প্রধানত সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও নতুন জাতীয়তার পাঠ দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিকে অভিন্ন জাতিসত্তার বাঁধনে বেঁধে দিতে পেরেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহাসিক আত্নপ্রকাশের কাল। একুশে ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানি নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধিকার ঘোষণার প্রহর, রাষ্ট্র-ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্রান্তিকাল। একুশে ফেব্রুয়ারি অবিস্মরণীয় গণ-জাগরণ ও অভুত্থানের দীপ্ত প্রহর।

একুশ থেকে উনিশে/ একুশ বনাম উনিশে

সত্তর পেরিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি এবার(২০২২) একাত্তরে পা দিল। আর কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, হীতেশ বিশ্বাসদের রক্তকে তার খোলসের আবরণে ঢেকে উনিশে মে পূর্ণ করল একষট্টি। অতিক্রান্ত এই সময়ের দূরত্বে বসে পুরানো তথ্যের কিছু ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় বইকি!  ৫২’-র পর আবার যেহেতু ’৬১, ঢাকার পর আবার যেহেতু বরাক, দৃশ্যের পর আবার যেহেতু দৃশ্যের জন্ম— ইতিহাসের পিঠোপিঠি যেহেতু ‘অপর’ ইতিহাস— কিছু তর্ক তাই স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে। উত্তর ঔপনিবেশিক কালপর্বে দাঁড়িয়ে আজ সেই পূর্বতন তথ্য, বিলীন হয়ে যাওয়া ভাষা শহীদদের রক্তের দাগ আমাদেরকে ঠেলে দেয় নতুন কিছু পরিপ্রশ্নের মুখোমুখি।

একুশে ফেব্রুয়ারি পেরেছিল বাঙালিকে তার আত্মপরিচয়ে বিশ্বাসী করে তুলতে। কিন্তু কোন বাঙালি? মুসলমান বাঙালি বা আজকের বাংলাদেশিদের? না কি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বৃহত্তর বাঙালিদের? একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যেভাবে বাঙালি তার জাতিসত্তার স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল— উনিশে মে (বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন) নিয়ে তেমন কোনো জাতীয়তাবাদী ভাবনার উৎসার আমরা প্রত্যক্ষ করি না। একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে যে আবেগ বা উন্মাদনা আমাদের মধ্যে থাকে, আছে তার বিন্দুমাত্রও থাকে না উনিশে মে কে ঘিরে। জানি, দুটি আন্দোলনের প্রেক্ষিত-প্রবর্তনা, ক্ষমতার পক্ষ-বিপক্ষ, সময়-পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। দুটি ক্ষেত্রেই সমস্যার স্বরূপ ও আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল পৃথক। সেইসব ইতিহাস আর সমস্ত ক্ষতের মুখে জমেছে সময়ের পলি। একুশ বা উনিশ-এর ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে পৃথক পৃথক আলোচনা বা গবেষণা জরুরি ছিল— যদিও তা হয়নি। একুশের-এর আগে পরে সমস্ত তথ্যের প্রধান উৎস হতে পারত যে সংবাদপত্র— তার ওপর এসে পড়েছিল সরকারি ফতোয়া। ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশে ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’ তখন বন্ধ। ‘মর্নিং নিউজ’ সাংবাদিকতার দর্শন ভুলে সীমাহীন নির্লজ্জতার সঙ্গে তখন চালিয়ে যাচ্ছিল অপপ্রচার এবং সরকারের চাটুকারিতা। ভাষা আন্দোলন বিষয়ক কোনো ফাইল বা তথ্য ‘আজাদ’ পত্রিকার নিজেদের অফিসেই এখন আর নেই। শাসকের হাত এসে সবই নেয়। সময় যত চলে যায় দূর ইতিহাসের দিকে— একুশ ততই তারুণ্য হারায়। যে একুশের চেতনা বাঙালির জাতিসত্তাকে নতুন করে উন্মোচিত করেছিল, যে একুশ ছিল প্রতিরোধের প্রতীক, যে একুশ দেখিয়েছিল ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন— মাত্র সতেরো বছরের ব্যবধানে সেই একুশকে যদি সাংস্কৃতিক ঠিকেদাররা কুক্ষিগত করেন, তবে সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা যে প্রশ্ন তুলবেন; সেটাই তো স্বাভাবিক। আরও স্বাভাবিক সেই কারণেই বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে এবং সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোতে বদরুদ্দীন উমর বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-রা হয়ে পড়বেন আরও সংখ্যালঘু।

একুশ বা উনিশের ঐতিহ্যের মধ্যে লুকিয়ে ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক জটিলতার প্রশ্নটি। একুশ পেরেছিল, বরাক বা আসামের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে উনিশে মে পারেনি নিজেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে। সেই গৌরব আদায়ের আকাঙ্ক্ষাও তার নেই। তাই আবেগ যেমন নেই, তেমনি গ্লানি বা ক্ষোভ তুলনায় কম। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাংলাদেশ যেভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণ করেছে— তেমনি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষিত হয়নি। রাজ্যস্তরে আসাম সরকারও করেনি— কেইবা নিজের অপকীর্তির ইতিহাস, অন্যায়ের ধারাবিবরণী নির্মাণ করে? আসামের বাঙালিরা নিজেদের উদ্যোগে কিছু কাজ নিশ্চয়ই করেছেন। ভাষা প্রশ্নে, আত্মসত্তা নির্মাণ ও অস্তিত্বের দায়বদ্ধতা থেকে এ কাজ তাঁদের করতেই হয়েছিল।

পদ্মাপারের বাঙালিদের একুশে ফেব্রুয়ারি আছে। আসামের বাঙালিদের আছে উনিশে মে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ভাষা আন্দোলন তবে কোনটা? একুশে ফেব্রুয়ারির যে উত্তাপ আর গতি, তাকে ঘিরে প্রচারের সবটুকু আলো— ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বরের পরে আরও বেশি করে একুশ হয়ে উঠেছে ‘অমর একুশে’। আবেগ আর আধিপত্যের প্রশ্নে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রেমীরা যদি ‘আমরা’ পক্ষ হয়, তবে পদ্মাপারের বাঙালিদের দৃষ্টিকোণ থেকে  উনিশে মে-র সমর্থকরা ‘ওরা’। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কি তবে ‘আমরা’ বা ‘ওরা’ পক্ষে ভাগাভাগি হয়ে যাবে? নাকি ভাষাপ্রেমী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তৃতীয় কোনও পক্ষ? বরকত, জব্বার, সালাম, কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাসদের রক্তমাখা মুখ আমাকে প্রশ্ন করে। শুরু হয় বাঙলা, বাঙালি ও বাঙালিত্বের নতুন সাংস্কৃতিক জটিলতা। 

প্রশ্ন করো কোন্‌ দল তুমি কোন্‌ দল  

ভাষা প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা আপাতত রয়েছেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অবস্থানে। কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে বাংলা-রাভা-বোড়ো-মেচ-খাসি ভাষার ওপর অসমিয়ার আধিপত্য, নাকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল-এ বাংলার ওপর আরবি-ফার্সি-উর্দুর আধিপত্য— এসব প্রশ্নের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে ঘটি-বাঙালের তর্ক অনেক বেশি মুচমুচে। আশার কথা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত সংস্কৃতিমনষ্ক কিছু বাঙালি ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে একুশকে ঘিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সমবেত হন, যদিও তাঁদের মধ্যে একটা অংশ উনিশ মে-র খবর জানেন না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের একটা অংশ উনিশে মে-তে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারি কোনও অফিস তা সে রেল দপ্তর হোক বা ব্যাঙ্ক, ডি.ভি.সি হোক বা কোল ইন্ডিয়া-র দপ্তর— সেখানে গেলে কয়েকটি লাইন দেখা যায়: “হিন্দি কা জ্ঞান নহী জিসকো/ যো জন অজ্ঞানী হ্যায়।/ হিন্দি হী রাষ্ট্রভাষা হামারা/ য় হী হিন্দ কী রাণী হ্যায়।।” হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়, তবু কৌশলে সেই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালানোর চেষ্টা চলছে। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান পন্থীদের ভাষা আগ্রাসন যে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে, দৈনিক খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। এরকম অযৌক্তিক সরকারি ঘোষণার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালিকে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করতে হবে। মাতৃভাষা আক্রান্ত হলেই আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে—সমস্ত রকম আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আমাদের প্রতিটি দিন হয়ে উঠুক ভাষাদিন। ‘সর্বভারতীয় বাংলা ভাষামঞ্চ’, ‘বাংলা ভাষা সমিতি’, ‘ভাষা-সংস্কৃতি স্বাধিকার মঞ্চ’, ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি’, ‘আমরা বাঙালি’ বা ‘বাংলা পক্ষ’-এর কিছু সংগঠন আছেন, যাঁরা বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ভাষা আন্দোলনে রক্ত না ঝরালেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তাঁদের মতো করে প্রতিবাদ করেছেন, করে যাচ্ছেন আজও।

‘গ্লোবাল বাঙালি’ আর ‘লোকাল বাঙালি’র সংকট এক নয়। প্রবাসী বাঙালিদের ভাষা সংকট ভিন্নতর, বিষয়টি তাঁরা মোকাবিলা করেন তাঁদের মতো করে। পয়লা বৈশাখ বা বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে তাঁরা বাঙালি পোষাকে কিংবা বাঙালি খাদ্য, বাংলা কথা-বার্তা কিংবা বাংলা গানে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শেকড়ের কাছে ফিরতে চান।

মূল তর্কটা আসলে রাজনৈতিক— ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু বাঙালির স্বার্থে আঘাত লেগেছিল বলে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে হিন্দু বাঙালি লড়েছিলেন। কী আশ্চর্য— রাখিবন্ধন উৎসব উপলক্ষে মহাজাতি সদন থেকে আপার সার্কুলার রোড ধরে পঞ্চাশ হাজার জনতা শোভাযাত্রা করে বাগবাজার পশুপতিনাথ বসুর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। (‘রবিজীবনী’কার প্রশান্তকুমার পাল ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ও সজনীকান্ত দাসকে উদ্ধৃত করেছেন তাঁর গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডে)। কিন্তু প্রশ্ন হল—পঞ্চাশ হাজার মানুষের মধ্যে একজনও মুসলমান বাঙালি নেই? শেষে কিনা একজন কন্‌স্টেবল আর একজন গাড়োয়ান— হাত জোড় করে কন্‌স্টেবল অবশ্য কাকুতিমিনতি করেছিলেন— রাখি থেকে অবশ্য তাদের ছাড় ছিল না। কেননা ‘মুসলমান’ চাই যে। তা না হলে সম্প্রীতির অনুষ্ঠান সবটা হচ্ছে কই! পাঠক জানেন বঙ্গে সেদিন মুসলমান ‘কম পড়ে নাই’। আসলে ইংরেজদের সঙ্গে মুসলিম নেতৃত্বের বৈঠক অনুযায়ী মুসলমান বাঙালি বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে আংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। অন্যদিকে, আরবি-ফার্সি-উর্দুর আধিপত্য ও পাকিস্তানি শাসকদের নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ মুসলমান বাঙালির স্বার্থে আঘাত দিয়েছিল— তাই মুসলমান বাঙালি সেদিন (১৯৫২) প্রতিরোধে সামিল হয়েছিলেন। সেদিন রক্ত দিয়ে তাঁরা কেবল ভাষার জন্য লড়াই করেননি একই সঙ্গে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন।  

ওরা আমার মুখের কথা/কাইড়া নিতে চায়

আজ থেকে সত্তর বছর আগে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রাজপথে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর দুটোয় বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনে শহিদ হন কয়েকজন বাঙালি তরুণ— রফিকউদ্দীন আহমদ, আব্দুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুল সালাম, শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ, আব্দুল আওয়াল। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ঠ্যাঙারে পুলিশবাহিনীর অ্যাসফেল্ট রাইফেলের সামনে কয়েকজন ভাষা শহিদের লুটিয়ে পড়ার প্রায় অর্ধশতাব্দী ব্যবধানে ঐ দিনটিকে রাষ্ট্রসংঘ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ (১৭ নভেম্বর ১৯৯৯) -এর স্বীকৃতি দিয়েছে। বিলম্বে হলেও এই স্বীকৃতি একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনকে জাতীয়তা থেকে আন্তর্জাতিকতায় উত্তীর্ণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি (১৯১৩) বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার পরিচয় ঘটিয়েছিল আর একুশের এই স্বীকৃতি বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন সংগঠিত করে তুলেছিল।  

আমরা যদি একুশে ফেব্রুয়ারির পূর্বাপরকে সংক্ষেপে বুঝে নিতে চাই তাহলে দেখব— দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে নির্মিত একটি রাষ্ট্র-ধারণার প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ এই একুশে ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসের একটি সনাতন প্রবর্তনায় যে আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছিল ধর্মের মধ্যে দিয়ে নয়, ভাষা বন্ধনেই গড়ে ওঠে একটি রাষ্ট্র ধারণা, জাতীয়তার ভিত্তি। একুশে ফেব্রুয়ারি-কে বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে ভারত-ইতিহাসের কিছুটা অতীতে—১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন বা ১৯০৬-এ মুসলিম লিগের সূচনার মধ্যে নয়, তারও কিছুদিন আগে ১৮৬৬-তে প্রশাসনিক সুবিধা ও সুবিচারের জন্য তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা স্যার স্টাফোর্ড নর্থকোট, স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড, স্যার হেনরি কটন, অ্যান্ড্রু ফ্রেজার হয়ে যে ভাবনাটা লর্ড কার্জনের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর কার্যকর হবার কথা হয়। কংগ্রেস দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করে। রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবে পালিত হয় রাখিবন্ধন উৎসব। ১৯০৫-এর ৭ আগস্ট টাউন হলের ঐতিহাসিক সমাবেশে সেদিন জনসমুদ্রে নেমেছিল জোয়ার। ২৬ আগস্ট ১৯০৫, ধর্মীয় প্রভেদ ভুলে হিন্দু মুসলমান ঢাকার প্রতিবাদী সমাবেশে সকলেই এগিয়ে এসেছিলেন। সেদিন লড়াইটা যতটা বাঙালি হিন্দুর অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ছিল— বাঙালি মুসলমানের ততটা ছিল না, এমন কি সুযাোগ সুবিধার প্রশ্নে বাঙালি মুসলমান নেতৃত্বের অধিকাংশই সেদিন বঙ্গভঙ্গ চেয়েছিলেন। আন্দোলনটি যে শেষ পর্যন্ত স্বদেশী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল— সেটাই ছিল তার সার্থকতা। ব্যর্থতা এখানেই যে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন অবিভক্ত বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ ছিন্নভিন্ন করে মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে মহাত্মা গান্ধির কংগ্রেসে যোগদান এবং লিয়াকত আলি খানদের বিশেষ অনুরোধে বিলেতের আইন ব্যবসা মুলতুবি রেখে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ফিরে এসে ১৯৩৪-এ মুসলিম লিগের দায়িত্বভার গ্রহণ ও ১৯৪০-এ লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় রাজনীতির খল-নলচে বদলে দেয়। অবিভক্ত বাংলার ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি সংকট শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আবুল হাসেমদের যেভাবে আলোড়িত করেছিল— পরাধীন অখণ্ড ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধি, জিন্নাহ-র কাছে সেই সংকট এসেছিল তার সমগ্রতা নিয়ে। ফজলুল হকের মতো কেউ কেউ বাংলার মানুষের স্বার্থবিরোধী লাহোর প্রস্তাব-কে সরাসরি ধিক্কার জানিয়েছিলেন। স্মরণীয় ২০ জুন ১৯৪২-এ Hindu-Muslim Unity Conference-এ ফজলুল হকের ভাষণ। ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে’র ভিত্তিতেই হোক বা ‘মুসলিম প্রধান ও হিন্দুপ্রধান অঞ্চল’ নীতির ভিত্তিতেই হোক-  ভারত ভাগ বিশেষত বাংলা ভাগ চাননি শরৎ বসু-কিরণশঙ্কর রায়-ফজলুল হক-এর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। অসমের স্বতন্ত্র ও অখণ্ডতা রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছিলেন গোপীনাথ বরদলই-এর মতো নেতা। যথার্থ বলেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান: “দুটো ঘটনা প্রায় সমান্তরালভাবে ঘটেছিল। একদিকে রাজনীতিক্ষেত্রে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের পথ হয়ে যাচ্ছিল আলাদা, অন্যদিকে বাঙালি মুসলমান সমাজে বাংলাভাষার প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও ঐতিহ্যপ্রীতি প্রবল হয়ে উঠছিল।” (‘ভাষা আন্দোলন: কিছু কথা’)

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা যত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের ইসলামি রাষ্ট্রের দিকে, ভাষা প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমানদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানদের দূরত্ব বাড়ছিল তত। মুসলিম লিগ পাকিস্তান চেয়েছিল কিন্তু লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০) থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা (১৯৪৭) পর্যন্ত সময়ের মধ্যেও তারা পারেননি পাকিস্তানি জাতীয়তার প্রকৃত স্বরূপ নির্ধারণ করতে। লাহোরের দেড় হাজার মাইল দূরে প্রকৃতি-আবহাওয়া-ভাষা-সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য পৃথক পূর্ব পাকিস্তানের জন্যও ছিল না পাকিস্তানি জাতীয়তার কোনো সহানুভূতি। যদিও ১৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ মুসলিম লিগের করাচি অধিবেশনে জিন্নাহ ঘোষণা করেছিলেন “এ কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, পাকিস্তান হতে যাচ্ছে ইসলামি আদর্শভিত্তিক একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে না। ইসলামে নাগরিকতার ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই।” বাঙালি মুসলমানদের জন্য এ বক্তব্যের মধ্যে সান্ত্বনা ছিল না কোনও, কেননা পাকিস্তান রাষ্ট্র উদ্ভবের আগেই মুসলিম লিগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান ১৭মে ১৯৪৭ হায়দরাবাদে উর্দু-সম্মেলনে প্রথম ঘোষণা করেন— “পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে উর্দু।” বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৭ নভেম্বর ১৯৪৭ পাঠানো হয় একটি সই সম্বলিত স্মারকপত্র ! ২৫ মার্চ ১৯৪৮ গণপরিষদের অন্যতম ব্যবহার্য ভাষারূপে বাংলাকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি তখন স্পষ্ট ঘোষণা করেন— “দশ কোটি মুসলমানের ভাষা উর্দুই হবে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাষা।” লিয়াকত আলির মতো ঘোষণা না করলেও ঢাকায় এসে জিন্নাহ ঐ একই ভাষা প্রশ্নের সম্মুখীন হন। প্রশ্নকারী, আন্দোলনকারী আর উন্মুখ জনতা ছাত্রদের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা বিদ্রোহের অভিমুখকে তিনি ঘুরিয়ে দেন ‘মুসলমান ঐক্য’ ও ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে’র প্রসঙ্গ তুলে। ‘মুসলমান ঐক্য’, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রে’র প্রশ্নে যাদেরকে ভোলাতে চাইছেন— ভাষা প্রশ্নে তাদেরই উপর চাপাতে চাইলেন বিদেশি (আরবি-ফার্সি-উর্দু) ভাষার ভার। লিগ জিন্নাহকে ক্ষমতা দিয়েছিল— বৃহত্তর উর্দুভাষীদের স্বার্থে, হয়তো ক্ষমতার স্বার্থেও নিজে উর্দু না জেনেও জিন্নাহ ‘অপর’ ভাষার দাসত্ব করে গেছেন। মুসলমান বাঙালি তো ক্ষমতার কাঙালি নয়, সে কেন উর্দু ভাষার ভার বইতে যাবে? লিয়াকত আলিদের এই ইসলামীকরণে মুসলমান বাঙালিরা সহমত পোষণ করতে পারেননি স্বাভাবিক কারণেই। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫২ ঢাকার পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করেন— “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তখন ভাষা আন্দোলন পুনরায় উজ্জবিত হয়ে ওঠে। ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রায় ৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন। সেদিনই তারা ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। খাজা নাজিমুদ্দিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে সেই সাধারণ ধর্মঘটকে ব্যর্থ করতে চান। ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরের আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”, “ভাষার উপর হামলা করা চলবে না”, “বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ” স্লোগানে স্লোগানে তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ মুখর। দুপুর দুটো— মিছিলের গতি রোধ করে দাঁড়ায় নাজিমুদ্দিনের পুলিশবাহিনী। ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল দেবেন না তারা। ছাত্র-ছাত্রীর রাস্তায় বসে পড়ে। অবশেষে চারজনের এত একটি না এগোতে থাকে। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ হঠাৎই তখন কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে, লাঠি চালায়। প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন ছাত্ররা। ছাত্র-পুলিশের সেই লড়াই-এ রণক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা। তখনই গুলি চালায় পুলিশ— অ্যাসফেল্টের সামনে তখন লুটিয়ে পড়েন রফিকউদ্দিন, আব্দুল জব্বার, বরকতরা— অ্যাসফেল্ট রাইফেল কী বরকতদের স্লোগানে চেয়েও শক্তিশালী?

ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি আত্মসত্তা নির্মাণের যে প্রাথমিক পর্বটা সংগঠিত হয়ে উঠেছিল— মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ হয়েছিল তার আত্মপ্রতিষ্ঠা। সেদিক দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি নিছক ভাষা-আন্দোলন ছিল না, একই সঙ্গে তা ছিল ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি থেকে নিজেকে মুক্ত করে আপন ভাষা-সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি উত্তাপ ও গতি’ প্রবন্ধে বিশিষ্ট আখ্যানকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যাকে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে “২১ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় যতটা তার চেয়ে তার অনেক বড় গৌরব ইতিহাস নির্মাণে। ১৯৫২ সালে এই ইতিহাস নির্মাণের সূত্রপাত এবং আজ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত তা ইতিহাস নির্মাণ এবং সৃষ্টি করেই চলেছে। … যে বিপুল সম্ভাবনা ও স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম, জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার নিদারুণ বিনাশে মানুষ যখন হতাশ ও বিচলিত, ২১ ফেব্রুয়ারির স্ফুলিঙ্গই তখন তাকে ফের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি দেয়।” (‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’)।

একটি ভাষা, একটি রাষ্ট্র— বাংলা ভাষা— বাংলাদেশ, এই সরল সমীকরণের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ তার সমকালীন সমস্যা মিটিয়ে ছিল বটে, ৫২-র ভাষা আন্দোলনও খুঁজে পেয়েছিল তার কাঙ্ক্ষিত পথ। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন “বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।” জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গটি অবশ্য পরে যুক্ত হয়। এ ঘোষণা বাঙালি মুসলমানের সমকালীন সংকটের সমাধান হলেও ‘বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট বাংলাদেশ’-ঘোষণায় বাঙালি হিন্দুর সংকট ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকে। নিজ ভূমে তারা হয়ে যান পরবাসী। ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে বাঙালি হিন্দুকে সেদিন চলে আসতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে, অসমে— সীমান্তবর্তী জনপদ থেকে শহরের অলিগলি-রাজপথে। তারাও কিন্তু বলতেন, বলে আজও ‘আমরা জয়বাংলার লোক’। চলে আসার পঞ্চাশ বছর পরেও যারা এখনও বেঁচে— তাদের মন পড়ে আছে খুলনা, বাগেরহাটে কিংবা নাটোর, ময়মনসিংহে। সংখ্যায় সীমিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের চাক্‌মাদের সংকটকেও অস্বীকার করা যাবে না। চাক্‌মারা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। বাংলাদেশে তারা সংখ্যালঘু। চাকমা ভাষা-ভাষী ছাড়াও বাংলাদেশে আছে মিজো, খুমিচিন, বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ, গারো, সিলেটি, রাজবংশী, কুরুখ, মুন্ডারি, সাদরি ভাষাভাষী মানুষ। বাংলাদেশে তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষার যথার্থ অধিকার পান তো? নাকি তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় সংখ্যাগুরুর ভাষিক আধিপত্য? বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি প্রবন্ধের কথা মনে পড়ছে: “বাঙালি মুসলমানরা যত না বাঙালি তার চেয়ে বেশি মুসলমান।… বাংলাদেশে একটা আইডেন্টিটি সংকট চলছে। দেশের নাম বাংলাদেশ, ভাষার নাম বাংলা, অথচ রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম। এর তাৎপর্য হলো ইসলাম যাদের ধর্ম নয় তার বাঙালি হলেও তাদের অধিকার ও মর্যাদা মুসলমানের সমান নয়।…. ইতিমধ্যে হিন্দুরা শতকরা তেত্রিশ থেকে শতকরা এগারোতে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে তাদের মনে একটা অসহায় ভাব জন্মাচ্ছে। একথাও আমার কানে এল যে হিন্দুকে মুসলমান করা কোনও কোনও স্থানে চলছে। মৌলবাদীরা নাকি বলেছে তারা শতকরা তিনজন মাত্র হিন্দুকে রাখবে। আর সবাইকে মুসলমান করবে কিংবা দেশছাড়া করবে। মৌলবাদীদের ধারণা হেসে উড়িয়ে দিতে পারতুম, কিন্তু পারছিনে। তার কারণ বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে মৌলবাদীদেরই দাপট বেশি।” (‘বাঙালি হিন্দু বাংলাদেশে পরবাসী’: ‘নব্বই পেরিয়ে’)। এ ভাষা এক রাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে সমাধানের রাস্তা খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশ আসলে বহুস্বরকে অস্বীকার করেছিল— তার ঐতিহাসিক ফলশ্রুতিকে যে আজ তাকেই ভোগ করতে হবে।

তুমি সেই পীড়িত কুসুম

ভাষা প্রশ্নে আসামের সংকট ভিন্নতর। বরাক ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের মতো বহুচর্চিত নয়। আসামে সরকারিভাবে এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রশ্নে উনিশে মে ব্রাত্যই। উনিশে মে-র একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে— যে ইতিহাসটি বেশ জটিল।

শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৪-এ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে বিভক্ত করে শ্রীহট্ট ও কাছাড় জেলাকে জুড়ে দেয় আসামের সঙ্গে। রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর জন এই কলোনি পলিসি ‘সুরমা ভ্যালি ডিভিশন’ নামে একটি প্রশাসনিক ইউনিট গঠন করে। ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গের সময় এই ডিভিশনকে ঢুকিয়ে দেওয়া হল ‘পূর্ববঙ্গ ও অসম’ প্রদেশে। ১৯১১-এর বঙ্গভঙ্গ রদ হলে সুরমা উপত্যকাকে আবার সংযুক্ত করা হয় আসাম প্রদেশের সঙ্গে। ১৯৪৭-এর পর শ্রীহট্ট জেলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে একটা অংশ যায় তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানে, অপর অংশ করিমগঞ্জ চলে আসে অসমে। অন্যদিকে ত্রিপুরা, কোচ, ডিমাসা রাজশক্তির হাত ফেরতা হয়ে পার্বত্য কাছাড় এবং সমতল কাছাড় চলে আসে অসমে। যা পূর্বে ছিল বঙ্গ সমতটের অংশ। এই করিমগঞ্জ, কাছাড় ও হাইলাকান্দি নিয়ে আজকের ‘বরাক উপত্যকা’। এই বরাক উপত্যকা ছাড়াও অসমের গোয়ালপাড়া জেলাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালি এবং বাংলাভাষী। দেশবিভাগ ও স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে কাছাড় এবং গোয়ালপাড়ার বাঙালিরা তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সংযুক্তির দাবি তোলেন। অসমিয়ারাও চেয়েছিলেন এই দুটি প্রদেশকে আসামের বাইরে রাখতে। কার্যত তা আর সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পরে আসামে বাঙালিদের সংকট আরও জটিলতর হয়ে ওঠে। বাঙালিদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিভাগ পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দুদের আশ্রয়ের খোঁজ অসমের বাঙালিদের সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গৌহাটি শহরেই শুরু হয় বাঙালিদের উপর আক্রমণ। সঙ্গে হুমকি এবং নির্যাতন চালানো হয়।

ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য অসম প্রথম থেকেই বহুভাষিক। অসমিয়া, বাঙালি, খাসি, জয়ন্তিয়া, বোড়ো, রাঙা, ডিমাসা, মেচ, মিকির, মিসিং, কাৰ্বি, নাগা, মণিপুরি, সাঁওতাল, বিহারী, ভোজপুরী— প্রভৃতি জনগোষ্ঠী ও ভাষাগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে অসমে বসবাস করেন। এদের মধ্যে অনেকেই অসমের আদি বাসিন্দা। অনেক উপজাতি ও জনজাতিও আছেন— যাদের নিজস্ব ভাষা এবং লিপি আছে। এই জনগোষ্ঠী ও ভাষাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসম সরকার ও উগ্ৰ অসমিয়া জাতীয়তাবাদ আধিপত্য কায়েম করে। ‘আসাম ফর আসামিজ’ এমনতর গৃহীত সরকারি নীতিকে আঁকড়ে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালপাড়া জেলায় হয় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। তার ঠিক দশ বছর পরে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ১৯৬০-এর ২১-২২ এপ্রিল অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য সে প্রস্তাবে সিলমোহর পড়ে এবং সরকারি ভাবে কার্যকর করার জন্য মন্ত্রিসভাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সরকারি সিদ্ধান্তে অসম অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। নতুন করে সরকারি মদতে ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান শুরু হয়। বাঙালিরা আসামে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ— স্বাভাবিক ভাবে অন্য ভাষাভাষী বা জনগোষ্ঠী অপেক্ষা বাঙালিরাই ছিলেন অসমিয়াদের আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য।

এই ভাষার রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদী তর্কের মধ্যেই ২-৩ জুলাই, ১৯৬০ স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনায় শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’। ঠিক তার পরের দিন থেকে বরাক-উপত্যকায় শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা চল্লিশ, দশ হাজারের বেশি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছিল পরবর্তী একমাসে, পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ নিরাশ্রয়-বাস্তুহীন। কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, গোয়ালপাড়া, বরাকের বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত । পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার মাত্র তেরো বছর ব্যবধানে ধর্মের ইস্যুতে নয়, ভাষার ইস্যুতে অসমিয়ারা মেতেছিলেন ‘বঙ্গাল খেদা’-ও অভিযানে এভাবেই ইতিহাসের সুরমা উপত্যকা ধীরে ধীরে পরিণত হয় মৃত্যুর উপত্যকায়— এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না।

‘সরকারি ভাষা আইন ১৯৬০’-এর মধ্যে দিয়ে ১৯৬০ সালে আসাম সরকার— ‘অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে অসমিয়া’ প্রস্তাব গ্রহণ করে। সে প্রস্তাব বাঙালিরা মানবে কেন? বোড়ো, রাভা, খাসিরা কেন নিজস্ব ভাষায় লিখতে পারবেন না? সরকারি এই আইনের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র আসাম। অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে সেদিন নওগাঁও জেলার হেজাইতে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল অসম বঙ্গ ভাষাভাষী সম্মেলন, কাছাড়ের হাফলং-এ পার্বত্য আদিবাসী মানুষদের সম্মেলন। বরাক উপত্যকা, শিলচর, করিমগঞ্জ মিছিলে-মিছিলে, শ্লোগানে-স্লোগানে, হরতাল ধর্নায় উত্তাল হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে অসমের সর্বত্র। এগিয়ে আসে মণিপুরি ছাত্র সমাজ, ডিমাসা ভাষা পরিবারের সবাই। খাসি, জয়ন্তিয়া, রাভা, বোড়ো, কাৰ্বি, নাগা সমস্ত স্তরের ভাষাভাষি মানুষ।

একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই উনিশে মে-র ভাষা আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্ত গণজাগরণ ঘটে। সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, আব্দুর রহমান চৌধুরী, নলিনীকান্ত দাস এবং বিভুভূষণ চৌধুরির নেতৃত্বে জেলা ওয়ারি ‘গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয় ১৯৬১-র ৫ই ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জের গণ সমাবেশে। আইন-এর বিরুদ্ধে এই গণসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বরা শহর ও গ্রামে জনসচেতন ও জনসংযোগ গড়ে তুলতে থাকে। এই সময় লোকসভা সদস্য দ্বারিকানাথ  তেওয়ারি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সে সময় সরকারি মদতে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো হচ্ছিল— আব্দুল জলিল চৌধুরী, আব্দুল হামিদ চৌধুরী বা মৈনুদ্দিন চৌধুরীর মতো মুসলমান নেতারা তা রুখে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে গণসংগ্রাম পরিষদের উপর অসম সরকারের প্রবল চাপ তৈরি হয়। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিল ১৯ মে আন্দোলন শুরু হবে। যদিও রাষ্ট্রশক্তির চাপে সংগ্রাম পরিষদের মহকুমা কমিটি ১৭ মে একেবারে ভেঙে পড়ে। ভয়ংকর সেই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পরিতোষ পাল চৌধুরী নেতৃত্ব দেন।

রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ সে বছর। উপত্যকায় মিছিল, উনিশে মে আইন অমান্য করতে হাজার হাজার মানুষ নেমে পড়ে করিমগঞ্জের রাজপথে। অসম সরকারের পুলিশবাহিত নিরস্ত্র ভাষা সংগ্রামীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পুলিশের বুলেটের সামনে লুটিয়ে পড়েন— কমল ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, শচীন্দ্র দাস, সত্যেন্দ্র দেব, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কুমুদ দাস, সুকমল পুরকায়স্থ, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথরা। বহুধর্ম, বহুভাষা-র স্বাধীন গণতন্ত্র ভারতবর্ষে এত রক্তপাত— ঐতিহ্যের পরিপন্থী হলেও ভারত-ইতিহাসকেই তো তা মেনে নিতে হয়েছে। অসমের রাজনীতি সাংস্কৃতিক ঐতিহে এই আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

একুশে ফেব্রুয়ারির ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে নির্মিত একটি ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান ও তার রাষ্ট্র ভাষা উর্দু-র বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলমানের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। অন্যদিকে উনিশে মে-র আন্দোলন একের আধিপত্যের বিরুদ্ধে অনেকের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির সে আধিপত্যবাদের শেষ হয়নি আজও— ফলে সংগ্রামও প্রবহমান। এন.আর.সি-র জুজু দেখিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে বাঙালি বিতাড়ন।

  ১৯৭২-এ শহিদ হলেন বাচ্চু চক্রবর্তী, ৮৬-তে জগন ও যিশু, ৯৬-এ মণিপুরি ভাষায় শিক্ষার দাবিতে সুদেষ্ণা সিনহা! এত রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের সুরমা উপত্যকা বরাক আজ ভাষা শহিদের মৃত্যুর উপত্যকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এ মৃত্যুর উপত্যকা আমার দেশ না— বলে হয়তো প্রত্যাখান করতে পারতাম—কিন্তু পারি না, বাংলাভাষী একজন মানুষ হিসেবে অপেক্ষা করি কোনো এক সূর্যকরোজ্জ্বল ভোরের:

“এসো কিংবদন্তীর ভোর, আহির ভৈরবী নিয়ে

ব্রাত্য জীবনের কথকতা ঢেকে দাও

আলোর সংকেতে।”                                    (‘কিংবদন্তীর ভোর’: তপোধীর ভট্টাচার্য)

প্রেক্ষিত পটভূমি স্বতন্ত্র হলেও তামিলনাড়ুর ভাষা আন্দোলন বা মানভূম ভাষা আন্দোলনের ভাষা শহিদরা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। সে বিষয়ে কথা বলার অবকাশ এখানে মিলবে না।  

এই একুশই শক্তি দিল / উনিশে মে-র হাতে

২০ ফেব্রুয়ারি সারারাত জেগে একটি প্রভাতের ইশারায় শাহবাগ থেকে টি.এস.সি, মিল্কক্ষেত থেকে আজমপুর হয়ে ফুলে-ফুলে মোড়া ঢাকার শহিদ সদন চত্বরে আমরা যদি পৌঁছোতে পারি, একুশের কোনো এক প্রত্যুষে— তাহলে লক্ষ জনতার সম্মিলিত গানে কখন সুরহীন আমি, আমরাও যে গলা মেলাই, খেয়াল থাকে না নিজেরও:

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলতে পারি

আমার এ সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলতে পারি।”    

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর লেখা এই গানটির মধ্যে দিয়ে আপামর বাঙালি একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। আলতাফ মাহমুদ এর সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন বাঙালি সেই খুঁজতে শুরু করেছে তার আত্মপরিচয়, দেখতে শুরু করেছে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’-র পর বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই গান। বাঙালির সেই ‘স্বতঃস্ফূর্ত স্থাপত্যকলা’, সেই ‘টলোমলো অশ্রুবিন্দু’র মুখোমুখি হলে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত, উঁচু-নীচুর সব বন্ধন গানে গানে যায় টুটে। বাঙালি জাতীয়তাবাদে তখন নব অভিষেক ঘটে আমাদের।

সুরমা উপত্যকায় কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী, হিতেশ বিশ্বাসদের স্মৃতিসৌধের সামনে নতজানু হওয়ার সুযোগ যদি আপনাদের ঘটে তাহলে দেখতে পাবেন- একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এলাহি আয়োজন, উনিশে মে-র নেই। তবু প্রতিবছর করিমগঞ্জ, কাছাড়, শিলচর, হাইলাকান্দি থেকে শত শত মানুষ সমবেত হন কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগীদের স্মৃতিসৌধের সামনে। প্রভাতফেরিতে যখন গাওয়া হয় শ্যামাপদ ভট্টাচার্যের লেখা গান:

“শোনো ডাকে ওই একাদশ শহীদেরা ভাই

আর দেরি নয় দেরি নয় দেরি নয়

সুপ্তি ভেঙে পথে ছুটে আয়

হবে জয় হবে জয় হবে জয়

আরো প্রাণ আরো প্রাণ আরো প্রাণ

ওই বেদি মূলে দিতে হবে বলিদান।”

দ্রোহের সেই আলাপন আর সুরের মোহজালে জড়িয়ে পড়তে পড়তে ভাবি কেন এই গান বরাকের বাইরে খুব বেশি শোনা যায় না? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে এ গানের সুর তেমন চেনা নয়। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”-র মতো তাই “শোনো ডাকে ওই একাদশ শহীদেরা ভাই” জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। এর মধ্যে কোনো রাজনীতি আছে কিনা জানি না।

একুশ আর উনিশের তর্ক ও তরজাতে আমাদের দিন চলে যায়। আমাদের দিন চলে যায় অসুখে ধার দেনাতে। তার মধ্যে এসে পড়ে আপাত নিরীহ একটা ছড়া:

“আমার বুকে যে বিঁধে আছে কুশ

নেয়নি তুলে তা ‘তোমার একুশ’!

মে মাসের সেই ‘আমার উনিশে’

‘ফেব্রুয়ারি’তে যায়নি তো মিশে।

আমার রক্ত গিয়েছে যে বৃথা;

আমার জননী হ’ল না অমৃতা।

তবু খুশি দেখে ‘একুশের চাঁদ’;

ঘোলেই মেটাই সে দুধের স্বাদ।”        (‘উনিশে-একুশে’: সুখরঞ্জন মুখোপাধ্যায়)

আবদুল গাফ্‌ফর চৌধুরির লেখা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” মন্ত্রের মতো সংহত হয়ে একটি জাতিকে উদ্দীপিত করেছিল। গান বা কবিতা কখনো হয়ে ওঠে এতটাই অমোঘ ও শক্তিশালী। সুখরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ছড়াকার হিসেবে দুই বাংলায় বিশেষ খ্যাতিমান কেউ নন হয়তো কিন্তু শিশুপাঠ্য এই ছড়াটি যদি ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে ছড়িয়ে পড়ে শিশুমন থেকে জনচেতনায়— সেদিন একুশ-উনিশের নতুন তর্ক, ‘আমরা’ পক্ষ বনাম ‘ওরা’ পক্ষের নতুন দ্বৈরথ আবার নতুন করে শুরু হবে না তো? একুশ, উনিশ নিয়ে তর্ক নতুন করে জমে উঠুক কিন্তু মতান্তর যেন না পৌঁছায় মনান্তরে। এও নিশ্চিতভাবে জানি বাঙালি আবার নতুন করে মাতবে না সেই আত্ন-বিভাজনের খেলায়। ছোট্ট একটা শিশুপাঠ্য ছড়ায় বাজি ধরা যেতে পারে: 

“এই একুশ শক্তি দিল

উনিশ মে-র হাতে,

ভাষায় দেখি রক্ত তিলক

বীরের রক্ত পাতে।”                      (‘একুশে’: প্ৰমোদ বসু )

এই ছড়াটির কাছে থিতু হলে আত্ম-দ্বন্দ্ব থেকে কিছুটা শান্তি পাওয়া যায়। এমনতর বোধের কাছে নতজানু হতে নিরন্তর ইচ্ছে করে।

ভাষার রাজনীতি ও ভাষা নিয়ে রাজনীতি– একুশ বা উনিশ কোনোটাই এর থেকে মুক্ত নয়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন থেকে মুক্ত হলেও ভাষার ঔপনিবেশিকতা ও ভাষা আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারেনি আমাদের নিজের নিজের মাতৃভাষা। আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা তবু জেগে আছে— “নক্ষত্র পুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।”