জন্ম তাঁহার হয়েছিল…। কোন সালে ? সঠিক কেউই জানেন না ! তাই, সেই যে বছর আকাল…, গোছের সব তথ্য! সবই ধোঁয়াশা যেন ! আন্দাজ, ১৫ শতকের শেষ কি ১৬ শতকের শুরুতেই ! একেক পন্ডিতের একেক মত ! আর ধোঁয়াশা শুধু তাঁর জন্মসাল নিয়েই নয়, জীবনের প্রথম পর্বেও ! তাই, বড়ই গোলমেলে তথ্যে ভরা তাঁর জীবনীও! সবই গল্পকথায়, লোকের মুখে মুখে ! তাঁকে ঘিরে গল্পের পাহাড় ! মিল হয়ত আছে কিছু গল্পের মধ্যে, তবে অমিলও কম নয় ! আসলে, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে এত লেখারও চল ছিলনা।

তাঁর বাবার নাম,নাকি, ছিল মুকুন্দ পান্ডে। আবার কেউ বলে, মুকুন্দ পাঁড়ে বা মুকুন্দ রাম ! আবার কারুর মতে, মকরন্দ ! কবিতা আর গান, তাঁর ভীষণ প্রিয় ! লেখেনও ভাল, এমনকি, সেই সব কবিতা কখন যেন তাঁর গলায় গানও হয়ে ওঠে ! বেনারসের মন্দিরে পূজো করার ফাঁকেই ! পূজারী ব্রাহ্মণ, তাই ছেলের নাম রাখলেন রামতনু।

বাবার গানের নেশা, একটু বড় হতেই ছেলের মধ্যেও ! গোয়ালীয়রের কাছে পিঠেই শুরু হল গান শেখা। হরিদাস স্বামীর এই শিষ্য প্রথম কামাল দেখালেন ৬ বছর বয়সেই ! আর তা ধ্রুপদী গানে ! বয়স যত বাড়ে, সাত সুরের আনাগোনাও তত খোলতাই হয় ! কিন্তু, বাবা মারা যাওয়ায় ফিরতে হল বাড়ী। কিন্তু, গান কি ভোলা যায় ! শিউজির মন্দিরে, তাঁকেই শোনাতে লাগলেন ! আবার যাতায়াতও শুরু করলেন সুফি সাধক মহম্মদ ঘাউসের কাছে ! ফলে, বৈষ্ণবী আর সুফি, দুই ঘরানাই তাঁর গলার সূক্ষ কাজে !

ফুল ফোটে গোপনে, কিন্তু সৌরভই জানান দেয় তার কথা। রামতনুর গানের খ্যাতিও রেওয়ার রাজা রামচন্দ্র সিং এর দরবারে পৌঁছাল ! এই দরবারে নিজেকে আরও মাজাঘষা করলেন। এমনকি, ধ্রুপদের ধীর লয়ের বদলে গাইতে লাগলেন দ্রুত লয়কারিতে খেয়াল ! খেয়াল গানের জনক রামতনুই ! আস্তে আস্তে, হয়ে উঠলেন রাজার ঘনিষ্ঠ সহচর ! কারণ, দুজনেই তো গানে মত্ত ! খেয়াল গানের দ্রুত তানকারিতে মুগ্ধ গোয়ালীয়রের রাজা বিক্রমজিৎ তো নামই দিয়ে বসলেন ‘তানসেন’!

রামতনুর খ্যাতি তখন মুঘল দরবারেও আলোচনার বিষয় ! হঠাৎই, রাজার কাছে রামতনুকে চেয়ে বসলেন সম্রাট ! স্বয়ং মুঘল সম্রাট আকবরের আব্দার, কার সাধ্য না করে ! কিন্তু, তানসেনের ইচ্ছে নয় ! তাঁর নাম আরও ছড়িয়ে পড়ুক, চাইতেন রাজা রামচন্দ্র সিং। অনেক উপহার দিয়ে, তাঁকে খানিকটা জোর করেই পাঠালেন দিল্লি, ১৫৬২ তে ! বয়েস তখন তাঁর ৬০ পার ! তারপর ?

তাঁর গানে মুগ্ধ, দিল্লীর দরবারও ! সম্রাট আকবরের ‘নবরত্ন’ সভার অন্যতম রত্ন তখন তানসেন ! স্বয়ং সম্রাট তাঁকে উপাধি দিলেন, ‘মিঁয়া’ ! পরিচিত হলেন ‘মিঁয়া তানসেন’ নামে !

১৫৮৬ সালের ২৩ এপ্রিল, পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অন্য কোন দুনিয়ায় সুরের মায়া জাল বুনতে পাড়ি দিলেন তানসেন। শেষ হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। অথচ মৃত্যুর কারণ সঙ্গীত ও স্বয়ং বাদশা আকবর ! রাগ “দীপক” শোনার জন্য ছেলেমানুষী বায়না আকবর বাদশার ! বড় ভয়ানক সে রাগ। সে রাগের শুদ্ধ সুরের মূর্ছনায় শুধু প্রদীপের জ্বলে ওঠা নয়, খোদ গায়কেরও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা পুরোমাত্রায় ! তাই প্রথমে গররাজি হলেও, পরে অন্নদাতা জালালুদ্দিন আকবর বাদশাহর আবদার রাখতে গিয়ে গাইলেন রাগ দীপক ! জ্বলে উঠল আগুন, তাঁর চারপাশে ! এমনকি তানসেনের শরীরেও ! মেয়ে সরস্বতী বাবার নির্দেশে মেঘ মলহার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে তাঁকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করলেন ঠিকই… ! কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরী হয়ে গিয়েছে! আজ সে সব কিংবদন্তি !

আশি বছর বয়সে মহাপ্রয়াণ আকবরের ‘নবরত্নসভা’র অন্যতম রত্ন মিঁয়া তানসেনের। একমাস ধরে শোকপালনের ফরমান জারি হল । কিন্তু তানসেনের শেষকৃত্য কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হল ব্যাপক বিক্ষোভ। হিন্দু সমাজ ঘোষণা করলেন, তানসেন হিঁদুর ঘরের ছেলে। নাম রামতনু মিশ্র। পিতা মুকুন্দ মিশ্র, মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষন ও সুগায়ক। মুসলিম কন্যা হুসেইনি বেগম হয়ত তাঁর স্ত্রী, তাই ধর্ম পরিবর্তন করলেও শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। তাই তার শেষকৃত্য হিন্দুশাস্ত্র মতেই হওয়া উচিৎ। কিন্তু নারাজ ইমাম আর মৌলবীরা। তাঁদের মতে, ধর্ম বদল করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তানসেন। তাই ইসলাম মতেই পালন করা হোক সুরসম্রাটের শেষ যাত্রা।

তানসেনের শেষকৃত্য নিয়ে ভারী বেকায়দায় পড়লেন আকবর। তাঁর মত, জনগণই সিদ্ধান্ত নিক এই সমস্যার। তানসেনের শেষকৃত্য নিয়ে প্রায় দাঙ্গা বাঁধার উপক্রম। তখন সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন তাঁর একমাত্র মেয়ে সরস্বতী ! তানসেনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাকি সন্তানরা হলেন হামীরসেন, সুরটসেন, তানরস খান ও বিলাস খান। প্রত্যেকেই সুরের সাধক। তবে, মেয়ে সরস্বতীর উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন তানসেন। তাই, এই সমস্যার সমাধান একমাত্র তাঁকেই বলে যান সুরসম্রাট! জানালেনও তিনি, বাবার শেষ নির্দেশ ! তাঁর মৃত্যুর পর এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা আগেই আঁচ করেছিলেন তানসেন ! তাই তাঁর শেষকৃত্য নিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এক বিস্ময়কর নির্দেশ ! আর সেই নির্দেশ হল ‘গান’! যে গায়ক তাঁর সুরের মূর্ছনায় তানসেনের মৃত শরীরে সামান্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করতে পারবেন, তাঁর ধর্ম মতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে সম্রাট আকবরের ‘নবরত্নে’র অন্যতম এই ‘রত্ন’টির।

নির্দেশ শুনে অবাক হলেন স্বয়ং আকবরও ! এ অসম্ভব ! গান গেয়ে মৃতের শরীরে প্রাণের সঞ্চার ? আশ্বস্ত করলেন তানসেন দুহিতা, হ্যাঁ সম্ভব! ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যেই আছে সেই চমৎকারী গুণ ! দরকার শুধু আধ্যাত্মিক সাধনা, সুরজ্ঞান এবং মন প্রাণ ঢেলে দেওয়া সেই গানের মধ্যেই !

অসম্ভব এই প্রস্তাবটি শেষ পর্য্যন্ত মনে ধরল সম্রাটের। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মাতব্বরেরাও একমত হলেন এই প্রস্তাবে। সংরক্ষিত করা হল তানসেনের মরদেহ।

তারপর শুরু হল সেই রুদ্ধশ্বাস গানের লড়াই !
মৃতসঞ্জীবনী সুরসুধার সন্ধান, এক কথায় ছিল অসম্ভব। কারণ তানসেনের পরে এমন কোন গায়ক সে সময় ছিল না তামাম হিন্দুস্থানে, যে এই ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। সুরের জাদুতে মৃতের শরীরেও প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে পারে !

তবু শুরু হল গান। সম্রাট আকবরের আমন্ত্রণে তামাম দুনিয়ার সেরা ওস্তাদ ও সুরসাধকদের ভীড় তখন আগ্রার দরবারে। তিনদিন, তিনরাত দেখতে দেখতে কেটে গেল ! একদিকে দিনরাত পালা করে চলছে শুধু কালোয়াতি গান ! অন্যদিকে ফুল, আতর, বরফ আর ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে তানসেনের মরদেহ। দেখে মনে হচ্ছে, পরম নিশ্চিন্তে তিনি ঘুমিয়ে আছেন ! এক্ষুনি যেন জেগে উঠে তানপুরার তার বেঁধে বসবেন রেওয়াজে। ধরবেন গুরু হরিদাস স্বামীর সৃষ্টি, ‘বৃন্দাবনী সারঙ্গ’। তিনদিন ধরে সুরের বন্যা দরবারে ! অথচ তানসেন নিস্পন্দ ! এত আয়োজন কি তবে সব ব্যার্থ ! তানসেনের সমকক্ষ কোন গায়ক কি সত্যিই নেই ভূভারতে ! এই অসাধ্যসাধন কি তাহলে অসম্ভব! হতাশ হয়ে পড়লেন সম্রাট আকবর !

২৬শেএপ্রিল, ভোরের আলো ফুটতে তখনও কিছু দেরী।একটু একটু করে সরছে রাতের পর্দা। ধীর পায়ে রাজদরবারে এসে দাঁড়ালেন এক ফকির সাহেব ! বললেন, তিনি একবার চেষ্টা করতে চান। চালচূলোহীন সেই ফকিরের কথা শুনে, হেসে কুটিপাটি সভাসদরা ! তামাম হিন্দুস্তানের নামজাদা ওস্তাদেরা ব্যর্থ, এই ফকির সেখানে কি চমৎকার দেখাবেন! ফকির কিন্তু, তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। শেষ চেষ্টা করে দেখতে তিনি যেন মরীয়া।

তাঁর উজ্জ্বল চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে সায় দিলেন সুর রসিক আকবর। তানসেনের পায়ের কাছে বসে ফকির শুরু করলেন তাঁর গান। ধরলেন তানসেনেরই সৃষ্ট ‘টোড়ি’ ! এ কি আশ্চর্য! মূহুর্তে যেন পাল্টে গেল গোটা রাজদরবারের পরিবেশ। অজানা সেই রাগের অপার্থিব সুরের অদ্ভুত মায়াজালে আচ্ছন্ন হলেন সকলে! ভোরবেলার সেই রাগের এমনই মাধূর্য, সকাল যেন এর জন্যই অপেক্ষা করে বসেছিল এতদিন! সেই রাগ কেউ কখনো শোনেনি। কেউ কখনও ভাবেনি এমনও গান হয় ! কি গায়কি! কি তালিম!কি সুর ! সুরের চলনে সবাই মুগ্ধ, বিস্মিত ! হারিয়ে ফেলেছেন মুখের ভাষাও! এমন সময় হঠাৎ, এক অদ্ভুত দৃশ্য ! বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে রাজসভায় শায়িত মিঁয়া তানসেনের নিস্পন্দ শরীরে !

ফকির ভাবলেশহীন, তন্ময় হয়ে শুধু গেয়েই চলেছেন। পরম করুনাময় ঈশ্বরের সাধনায় যেন লীন হয়ে গেছে তাঁর সকল স্বত্তা, বোধ, জাগরণ ! তারপর ! অবলীলায় একটি অসাধারণ গমক নিলেন সেই ফকির!সকলেই বিস্ময়ে হতবাক, মৃত তানসেনের ডান হাতটি কাঁপছে ! আস্তে আস্তে দেখা গেল, সেই অজ্ঞাত গায়কের দিকে তর্জনী নির্দেশ করছে তানসেনের ডানহাত ! কয়েকটি মুহুর্ত মাত্র ! সময় যেন থমকে গেল ! তারপর সব শেষ।

ধন্য ধন্য পড়ে গেল রাজসভায়। সবাই অবাক চোখে তখন সেই ফকিরের দিকে তাকিয়ে। গান শেষ করে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন ফকির। অদ্ভুত প্রশান্তি তাঁর মুখ জুড়ে। রাজসভার সবার মুখে তখন একটাই প্রশ্ন ! কে এই ফকির ? ইনি তো কোন সাধারণ মানুষ নন! খোদ বাদশাহ আকবর পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক। কিন্তু নিজের পরিচয় প্রথমে দিতে চাননি সেই ফকির। পরে উপস্থিত সকলের একান্ত অনুরোধে নিজের পরিচয় দেন তিনি।নাম তাঁর বিলাস খান, তানসেনের ছোট ছেলে ! অল্প বয়সে সুফি সাধনায় মজে ঘর ছেড়ে ছিলেন।

এদিকে অবাক কান্ড ! বিলাস খান সেদিন, তানসেনের শুদ্ধ ‘টোড়ি’ নাকি গাইতে পারেননি ! তিনি বাবার ভয়ে, বা অন্য কোন কারণে কুঁকড়ে ছিলেন সেই সময় ! ফলে, সুরের চলনে লাগল তাঁর নিজস্ব ছোঁয়া ! তৈরি হল নতুন রাগ ! নাম, তার ‘বিলাসখানি টোড়ি’।

সেদিন দরবার ছেড়ে যাওয়ার আগে বিলাস খানকে নজরানা দিতে চাইলেন সম্রাট। বিলাস খান শুধু জানান, মৃত্যুর পর যেন তাঁরও পিতার পাশেই স্থান হয় ! এই তাঁর নজরানা ! আজও গোয়ালিয়রে তাই পাশাপাশি শুয়ে আছেন পিতা আর পুত্র। সঙ্গীত সম্রাট তানসেন আর তাঁর পুত্র বিলাস খান।