সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সামাজিকভিত্তি মধ‍্যযুগীয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সাম্প্রদায়িক ও জাতপাতের বিদ্বেষের রাজনীতিতে খুন এবং নারীধর্ষণ আধিপত্য বিস্তারের বৈধ ও ন‍্যায় পদ্ধতি হিসাবে গণ‍্য করা হয়। বির্ধমী নারীকে ধর্ষণের পক্ষে আজও সোশ‍্যাল মিডিয়ায় অবাধে পোস্ট করা হয়। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে বিজেপির মত একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করছে বলেই এ বছর ১৫ই আগস্ট গুজরাটে বিলকিস বানুর ধর্ষকরা ছাড়া পেয়েছে এবং হিন্দুত্ববাদীরা তাদের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানিয়েছে। ২০০২ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি গুজরাটে গোধরাকাণ্ডের পর সময় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দাহোদ জেলার রাধিকাপুর গ্রামের একুশ বছরের গর্ভবতী তরুণী বিলকিস বানুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তখন গুজরাটের যিনি মুখ‍্যমন্ত্রী ছিলেন এখন তিনিই ভারতের প্রধানমন্ত্রী – হ‍্যাঁ নরেন্দ্র মোদি। তাঁর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রধান মুখ হয়ে ওঠার সূচনাপর্বের ঘটনা এটি। লালকৃষ্ণ আদবানী মুরলী মনোহর যোশীকে এক সময় ভারতবাসী দেখেছে বাবরি মসজিদের ধাঁচা করসেবকদের হাতে ধূলিসাৎ হওয়ার সময় প্রকাশ‍্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে সমর্থন জানাতে। ২০০২ সালের পর থেকে ভারতবাসী দেখল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক‍্যের কারণে ধর্ষণকে প্রকাশ‍্যে সমর্থন জানিয়ে বিদ্বেষের রাজনীতির সপক্ষে জনমত গঠন করতে বিজেপি ও আর এস এসের নেতারা দ্বিধা করছেন না। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে ভারতবাসীর প্রাপ্তি দেশের শাসকদলের ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের উদযাপন। উত্তরপ্রদেশে যেমন গেরুয়া পোশাকের সন্ন‍্যাসী মুখ‍্যমন্ত্রী যোগী আদিত‍্যনাথের মুখে ঔদ্ধত‍্য ভরে সংবিধানকে অগ্রাহ‍্য করা ” এনকাউন্টার করেঙ্গে” এবং “বুলডোজার চালায়েঙ্গে ” ঘোষণার মতোই ইতিহাসকে অগ্রাহ‍্য করে পশ্চিমবঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী দিলীপ ঘোষদের মুখে শোনা যাচ্ছে “ডঃ শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ‍্যায় পশ্চিমবঙ্গের জনক “! সংঘ পরিবারের এই পুরো পরিকল্পনা রূপায়ণের নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রয়োগ করতে পূর্বজ হিন্দু মহাসভা এবং আর এস এসের দেখানো পথে স্বাধীনতার পরেও হাঁটছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের বর্তমান রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোও তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশ।

“স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব” – এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর পূর্তিকে। বর্তমান ভারত সরকার যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁদের পূর্বসূরিদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান নিয়ে যতই প্রশ্ন থাকুক দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের নামে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রচার করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোতে ভারতীয় জনতা পার্টির অক্লান্ত প্রচেষ্টার বিষময় ফল ভোগ করছেন ভারতবাসী। গোমাংস খাওয়া ও বহন করার দায়ে আকলাখ খান জুনেইদকে হত‍্যা করা, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে অক্ষুণ্ন রাখতে কৃত সংকল্প সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ সহ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা নরেন্দ্র দাভোলকর এবং অধ‍্যাপক এম এম কালবূর্গীকেও হত‍্য‍া করার ঘটনা প্রমাণ করছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতের সামাজিক সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যে বার বার আঘাত করে চলেছে। সবচাইতে উদ্বেগজনক হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নীরবে অথচ আদর্শগত দায়বদ্ধতার কারণে যাবতীয় অসহিষ্ণুতাকে প্রশ্রয় দেন। যে কারণে উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির সাংসদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি আন্দোলনরত কৃষকদের ” কুকুর” বলেও পার পেয়ে যান। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় না উঠলে গত বছর অক্টোবর মাসে এই নেতার পুত্র আশিস মিশ্র আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর গাড়ি চালিয়ে চাপা দিয়ে চারজনকে খুন করলেও ধরা পড়ত কিনা সন্দেহ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লীর শাহিনবাগে আন্দোলনরত সংখ‍্যালঘুদের বিরুদ্ধে “গোলি মারো শালোকো”- শ্লোগান তুলেও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান অনুরাগ ঠাকুর ও কপিল মিশ্র। ফলে অসহিষ্ণু ও হিংসার আগুনে মৃত্যুভূমির দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা ভারতে “অমৃত মহোৎসব” শব্দবন্ধ কঠিন বিদ্রুপের মতোই শোনাচ্ছে।

শুরু করেছিলাম বিলকিস বানুর ঘটনা দিয়ে। মনে করিয়ে দেওয়া যাক,এগারোজন হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডা বিলকিস বানুকে কেবল ধর্ষণই করেনি তাঁর পরিবারের সাতজন সদস্যকে হত‍্যাও করেছিল। কোন গতিকে প্রাণে বেঁচে যান শিশুকন‍্যা ও স্বামীসহ বিলকিস। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া এই অপরাধীরা গুজরাট সরকারের নির্দেশে ছাড়া পেতেই আতঙ্কে সংখ‍্যালঘুরা ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন। বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সালভি যিনি ঐ অপরাধীদের সাজা ঘোষণা করেছিলেন তিনি গুজরাট সরকারের এই সিদ্ধান্তে দৃশ‍্যতই ক্রুদ্ধ হয়েছেন। শাস্তি মকুবের এই সিদ্ধান্ত পুর্নবিবেচনার আর্জি জানিয়ে সিপিআই এম নেত্রী সুভাষিনী আলি তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র,সাংবাদিক রেবন্তী লাল অধ‍্যাপিকা রূপরেখা বর্মা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে গত ২৩শে আগষ্ট সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রামানা আইনজীবী অপর্ণা ভাট ও কপিল সিবলের সঙ্গে আলোচনা করে জানান,এ বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দেশের সর্বোচ্চ আদালত শুনতে রাজি আছেন।

এটুকুই সান্ত্বনা! কারণ ঐ জঘন্যতম অপরাধীরা মুক্তি পাওয়ার পরেই গোধরার বর্তমান এম এল এ সি কে রাউলজি বলেছিলেন,”ওরা ব্রাহ্মণ, সংস্কারি! ওদের পক্ষে এই অপরাধ করা সম্ভব নয়!”