নানান বৈচিত্র্যৈ সমৃদ্ধ আমাদের দেশ । উদ্ভিদকূল ও প্রাণিকূলের মধ্যে যে সম্পদ আছে তাকে এখনো রক্ষা করার জন্য চাই সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াস। কেবলমাত্র সংঘবদ্ধ প্রয়াস থাকলেই জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। সেই কারণেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে আইন ।এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ , বিজ্ঞানী, জনবিজ্ঞান আন্দোলন, কৃষক ,ছাত্র, যুব ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলির   আন্দোলনের চাপে ভারত সরকার ২০০২ সালে এই আইন করতে বাধ্য হন। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক অনুচ্ছেদটি সংযুক্ত করে বলা হয়, বর্তমান ও  ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জলাভূমি ,বন , ও  বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণও নিরাপত্তা বিধান করিবেন ।২০১১ সালে সংশোধনের মাধ্যমে এটি সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়।এই আইনে মূলত প্রধান তিনটি দিককে নির্দেশ করা হয়েছে ।১)জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ২) জীব বৈচিত্রের উপাদানগুলির দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার ৩)জীব সম্পদের ব্যবহার এবং সেই সম্পর্কিত জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত সুবিধার সমবন্টন সুনিশ্চিত করা ।আইন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই আইনকে সাধারণ মানুষের স্বার্থে সঠিকভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। উক্ত আইন মোতাবেক জীববৈচিত্র্য পর্ষদ গঠনের সরকারি আদেশনামা থাকলেও বিশেষ অগ্রগতি নেই।

এটা সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার  উপর।তার জন্যই চাই গণ – উদ্যোগ ও গণ -আন্দোলন।পশ্চিমবঙ্গে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার দ্রুত পর্ষদ গঠন করে এবং কাজও শুরু করে দেয় ।জন জীব বৈচিত্র্য নথীকরনের উদ্দেশ্যে তৎকালীন সময়ে, পর্ষদ সমীক্ষার জন্য তিনটি এলাকা বেছে নেয় । সমতল ভূমি ,পাহাড়ি এলাকা, বনাঞ্চল এলাকা’ র অন্তর্গত তিনটি জেলা। পর্ষদ উক্ত এলাকায় তিনটি জীব বৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা সমিতি গঠন করে। দার্জিলিং জেলার মাটিগাড়া পঞ্চায়েত সমিতি (চম্পাসাড়ি  গ্রাম পঞ্চায়েত) হুগলি জেলার গোঘাট দু নম্বর পঞ্চায়েত সমিতি,( পশ্চিমপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত) ,ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলার পাথরপ্রতিমা পঞ্চায়েত সমিতি ,(পাথরপ্রতিমা গ্রাম পঞ্চায়েত )প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জন-জীববৈচিত্র নথীকরনের কাজ শুরু করে।

শুরু যখন হচ্ছে তখনই সারদা নারোদার উত্থান হচ্ছে। আর এই সারদা নারদার হাত ধরেই  সমস্ত কট্টর-দক্ষিণপন্থী, অতিবাম, বিদেশী শক্তি মিলিতভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে মমতা ব্যানার্জিকে প্রোজেক্ট করে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র চক্রান্তের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন করে এবং তারপরেই সব উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়।জনবিজ্ঞান সংগঠন, যুক্তিবাদী সমিতি ও পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ এই সব বিষয়ে অনেক আগে থেকেই কাজ শুরু করে। উল্লেখ্য আমাদের দেশে এবং রাজ্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজ শুরু হয় যৌথ বন পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে।Indian Institute of Science এর Centre for Ecological Science এর বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক মাধব গ্যাডগিল  ও তাঁর সহকর্মীগণ এই কাজে প্রথম উদ্যোগ নিলেন।চার ধরনের তথ্য সংগ্রহের উপর অধ্যাপক মাধব গ্যাডগিল গুরুত্ব আরোপ করেন।১) গ্রামের ইতিহাস ২) গ্রামের মাটির রূপ ও চরিত্র ৩) জনসমষ্টি ৪) জীববৈচিত্রের তালিকাহুগলী জেলার গোঘাট এক নম্বর ব্লক ও পঞ্চায়েত এলাকায় ১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ ও বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিজ্ঞানী তখন পঞ্চায়েত সমিতি এলাকায় কাজ করছেন এবং একটি “কৃষি পরামর্শ কেন্দ্র”স্থাপনের কাজ চলছে।

ঐ সময়ে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের হুগলী জেলা কমিটির সম্পাদক ডঃ ভবানীশংকর জোয়ারদার এবং বি সি কে ভি ‘র অধ্যাপক ডঃ শান্তনু ঝা ও ডঃ প্রণব চট্টপাধ্যায় জন জীব বৈচিত্র্য নথীকরনের প্রস্তাব দিলে পঞ্চায়েত সমিতি সম্মতি জানায়। সেই মত কাজ শুরু হয়। বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ করেন। গ্রাম চিহ্নিত করা হয়,কুমুড়সা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় “তেলিগ্রাম “গ্রামটি।*জন জীববৈচিত্র নথীকরনের কাজ শুরু ( People’s Biodervisity Register — PBR )*———————————————–বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক মাধব গ্যাডগিল ও কলকাতা বিবেকানন্দ কলেজের Centre for Biodervisity Studies এর বিশেষজ্ঞ ডঃ শীলাঞ্জন ভট্টাচার্য। উক্ত বিশেষজ্ঞরা ঐ গ্রামে ( তেলিগ্রাম ) পরিদর্শনে গেলেন।ওখানে গিয়ে ঐ গ্রামের ছাত্র-ছাত্রী এবং প্রবীণ মানুষদের নিয়ে সমীক্ষক দল তৈরি করে ট্রেনিং দিলেন।আমাদের সমাজ জীবনে এই কাজটি কেন গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী তা নীচের তথ্যসমন্বিত তালিকা দেখলে সম্যক উপলব্ধি হবে। ডঃ মাধব গ্যাডগিল সহ বিশেষজ্ঞ দল এই গণ্ডগ্রামে সমীক্ষক দলের সাথে দুদিন রাত কাটিয়েছেন এবং হাতে-কলমে কাজ শিখিয়েছেন। সমীক্ষক দলের দেওয়া তথ্যই ২০০৩ সালে বেসরকারিভাবে জন জীববৈচিত্র নথি  বই আকারে প্রকাশিত হয়। 

এই তথ্যের উপরই আগামী দিনের পরিকল্পনা ,উন্নয়ন,মাটির চরিত্র নির্ণয় ও তার ব্যবহার, ফসল রক্ষা, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকে রক্ষা করা ,এই *সব বিষয়ে কিছু কাজ করা যায় ।নথির গুরুত্বপূর্ণ একটা ভাগের কয়েকটি তথ্য সকলের অবগতি ও অভিজ্ঞতার জন্য দেওয়া হলো*:–***আগে চাষ হতো (পুরানো ধানের জাত):–* শুঁয়ো কলমা, চামোরমণি,গৌরীকাজল,  কনকচুড়, কলমকাঠি, দুধ কলমা ,সীতাশাল (পুরানো দিনের সব থেকে সুস্বাদু চাল) মুশুরি, গোবিন্দভোগ ,শুঁয়োডহর ইত্যাদি, কৃষকের পরামর্শ:—পুরানো ধানের জাত যদি না থাকে, তাহলে নতুন জাত তৈরী করার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে।**প্রাকৃতিক প্রাণীকূল:–কচ্ছপ একেবারেই কমে গেছে। কাক কমেছে, চড়ুই তো প্রায় অবলুপ্তির পথে, শকুন দেখতে পাওয়া যায় না।খটাশ,ভাম –লুপ্তপ্রায়। সোনা ব্যাঙ, গুগলি-শামুক-ঝিনুক কমেছে, গ্রামে গরুর সংখ্যা কমেছে। ফলে গোবর সংগ্রহের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।ছাগল, হাঁস কিছুটা বেড়েছে। **উদ্ভিদকূল:–, জাম, আতা ভেমুচ,ডালিম, গামীর,কাঁঠাল, খেজুর, তাল, অশোক, তেঁতুল, বট, আশুদ ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। নিম, করবী, বাবলা, চালকদম, বকুল,কুল, রাধাচূড়া,সুবাউল কম।**মৎস্যকূল :–গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ লাভের দিকে নজর রেখে পুকুরে বিদেশি জাতের সংকরায়িত প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল মাছ চাষের দিকে ঝুঁকছেন।অত্যধিক রাসায়নিক সার প্রয়োগ, মাঝে – মধ্যে কীটনাশক ব্যবহার করে পুকুর পরিষ্কার করে নতুনভাবে চাষ করা হয়। ফলে দেশীয় মাছ গুলির প্রায় লুপ্তপ্রায় অবস্থা। ডেনকোনা, চিতল ,ফলুই ,ট্যাংরা (ছোট)শাল,শোল, কুঁচে, পাঁকাল বাণ, খোলসে, কই ,চাঁদা ,মৌরলা, কালবোস, মাগুর, সিঙ্গি ,পুঁটি,ইত্যাদি মাছ গুলির ছবি বইয়ের পাতাতে দেখেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষকে চিনতে হবে। বাস্তবে তাদের স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিতই থাকতে হচ্ছে আমাদের ।**পাখি:–চড়ুই– খড়ের চাল না থাকায় একেবারেই দেখা যায় না ।তাছাড়া কোকিল ,দোয়েল ,ডোমচিল ,কাঠঠোকরা, পানকৌড়ি, ঘুঘু প্রভৃতি পাখিগুলি উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাচ্ছে। কুসুমের চাষ কমে যাওয়ায় এবং গাছপালা কেটে ফেলায় টিয়া প্রায় দেখতে পাওয়া যায় না ।বাবুই ,মৌটুসি , বালিহাঁস,খড়হাঁস,শামুকখোল প্রভৃতি পাখি আর সেভাবে দেখতে পাওয়া যায় না**স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে:–খটাশ, বড় নেউল ,ছোট নেউল, কাঠবেড়ালি, বাদুড়, চামচিকি প্রভৃতি কমেছে। ভোঁদড় আর দেখা যায় না। গ্রামে জীববৈচিত্র্য  সম্পর্কিত আচার -অনুষ্ঠান- কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত -খামার পুজো অথবা বারলক্ষ্মীপূজো, গো-পার্বণ, নল- সংক্রান্তি ।”আকাশের জল –পাতালের নল /ধান ফলে গলগল”।**ছোট গাছ–গাছড়া,লতা-গুল্ম :–(গ্রামবাসী ব্যবহৃত দেশীয় ওষুধি সম্পর্কিত জ্ঞান) ভ্যারান্ডা,বেনাঝাড়, কালিন্দি, কুকসীমা ,নলসর, সুশুণি,কলসীপাতা,  কানমুগরো,পদ্ম কমেছে। বন কমে যাওয়ায় আপাং দেখা যায় না। ঘৃতকুমারী কমে গেছে,( হাত -পা মচকে গেলে পাতার শাঁস দিলে উপশম হয় )শালুক কমে গেছে ,থানকুনি কমে গেছে,( রক্ত আমাশয় হলে থানকুনি পাতার সঙ্গে চার -পাঁচটা আতপ চাল বেটে খেতে হয়। )বিষল্লকরণী কমে গেছে (কেটে গেলে রস লাগায় ),বাসক কমে গেছে (সর্দি -কাশিতে পাতা সেদ্ধ জল খুব উপকারী), কুলে শাক (কুলেখাড়া )রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়তে সাহায্য করে। ধুতুরা কমে গেছে।

ঘেঁটু ফুলগাছ কমে গেছে ।শতমূলী কমে গেছে( ওষুধ তৈরি হয়) ফনীমনসা কমে গেছে।  (শেকড় বেটে চাপান দিলে দাঁতের যন্ত্রণা কমে )প্রয়োজন হয়ে পড়েছে প্রতিটি গ্রামেও মৌজায় সম্পদ অনুসন্ধান ও নথি করনের কাজ। কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে এই কাজ এখনই শুরু করা দরকার।এই কাজে ছাত্র ,যুব সংগঠন ,বিজ্ঞান ক্লাব ও বিজ্ঞান সংগঠনকে এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে ।আমাদের দেশে পরিবেশ ,স্থিতিশীল কৃষি ব্যবস্থা ও জন জীববৈচিত্রকে এই মুহূর্তে রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। একে রক্ষা করার জন্য শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে বামপন্থীরাও  লড়াই করছে। শ্রেণীগতভাবে যে দুর্বল তাদের পাশে থাকাটাই বামপন্থীদের কর্তব্য। পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষের মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। পচা গলা পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপরই নির্মিত হবে পরিবেশ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্রের উপর যারা দখলদারির আধিপত্য বিস্তার করছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে এম দাঁড়াতে হবে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক মানুষদেরই। এগিয়ে যেতে হবে প্রকৃতি, পরিবেশ,ও জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করার সংকল্প নিয়ে।

{তথ্য সংগৃহীত}২৪।১২।,২২