এই লেখাটা যখন লেখা হচ্ছে ঘটনাচক্রে তখনো অব্ধি শেষ আদমশুমারি হয়েছে ২০১১ সালে। প্রতি ১০ বছর অন্তর হলে সেটা হওয়ার কথা ২০২১ সালে। পরবর্তী সেনসাস ২০২১ সালে হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড এর কারণে এখনও অব্ধি হয়নি। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পর তা হবে। এবার তার পদ্ধতি  নিয়ে নানা জল্পনা হচ্ছে। সরকারি তরফেও এ সংক্রান্ত  নানা কথা ঘোষনাও হয়েছে।

কিন্তু, আমাদের আলোচনার বিষয় আদমশুমারি না। আমরা তাদের নিয়ে কথা বলতে চাইছি যাদের নাম এবারের আদমশুমারি তে থাকবেই না। তাদের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা-খাদ্যাভ্যাস-পোশাক এর তারতম্য থাকলেও তাদের মধ্যে মূল মিল একটাই -তারা সকলে বিজেপির মূল সংগঠন আর এস এস এর ভারতের জন্য “আনফিট”!

২০১৪ সালে এদেশের কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত বিজেপির ভাষণে , প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা ছড়ানোর উপাদানের পরিমাণ ৬০% এর ওপর। জনসভা থেকে এরা সরাসরি ঘৃণা ছড়ায় মুসলিমদের প্রতি, সংখ্যালঘুদের বিরূদ্ধে। যার পিছনে অবশ্যই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সরাসরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংখ্যা তো বাদই দিলাম কেবলমাত্র মব লিঞ্চিং, নিখোঁজ এর মত ঘটনা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে গত দশবছরে। এরকম কয়েকটি ঘটনা আপনাদের আরো একবার মনে করিয়ে দিতেই এ লেখা।

গত আট বছর ধরে ফতিমা নাফিস তার ফোনের ব্যাটারি ফুল চার্জ করে রাখেন সর্বদা। শেষ আটবছরে একবারও তিনি ফোনের সুইচ অফ করেননি! এমনকী মোবাইল ডেটাও অফ করেননি, প্রতিটা ফোন কল তিনি রিসিভ করে গেছেন নিরলসভাবে। কারণ গত আট বছর আগে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল এর বাইরে থেকে নিখোঁজ হয় তার ছেলে এম এস সি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র নজিব আহমেদ। মাহি মাণ্ডভি হোস্টেলে মাত্র ৭ দিন ছিল নজিব, সেই সময়ের মধ্যেই এবিভিপির সাথে  ঝামেলা হয় তার, এবিভিপির দ্বারা প্রথমে শারীরিকভাবে নিগ্রহের শিকার হয় নজিব এবং তার পর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। গত আটবছর ধরে ছেলে ফোন করবে, ছেলে ফিরে আসবে, তার খোঁজ পাওয়া যাবে এই আশায় ফতিমা ফোন অফ করেননি একবারও ! সিবিআই থেকে শুরু করে নানা তদন্তকারী সংস্থা খোঁজ করার দায়ভার নিলেও আজও তাকে পাওয়া যায়নি। এবং যে এবিভিপি সদস্যদের বিরূদ্ধে পরিবারের তরফে এবং নজিবের বন্ধুবান্ধবের তরফে অভিযোগ দায়ের করা হয় তারা সবাই জামিনে মুক্ত হয়ে “খুলে আম” ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ভোটে নজীব তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। ভোটের লাইনে দাঁড়াবে না জুনেইদ, আখলাকরা। ইভিএম এর সামনে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ফেস্টিভ্যালে সামিল হতে পারবে না এরকম আরো কয়েকশো মানুষ যাদের ধর্মের কারণে,” ফ্রিজে রাখা মাংস  কোন পশুর তা বুঝতে না পেরে” (!) খুন করেছে রাষ্ট্র, খুন করেছে আর এস এস।

“আমি একজন লেখক হতে চেয়েছিলাম। কার্ল সেগান এর মতো বিজ্ঞানের লেখক। কিন্তু অবশেষে আমি একটিমাত্র চিঠি লিখতে পারছি” এটি একটি সুইসাইড নোটের অংশ। চিঠিটা লিখছেন একজন রিসার্চ স্কলার। যার এই চিঠি লিখতে লিখতেই মনে হয়েছে  “…. আমার জন্ম একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা”! শতাব্দীপ্রাচীন যুগে দাঁড়িয়ে নয়, এই সময়কালেই ভারতে দলিত হওয়ার কারণে একজন রিসার্চ স্কলারের মাসের পর মাস ফেলোশিপ বন্ধ করে দেওয়া হয়, হস্টেলে থাকার সকল সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়। তাঁবু খাটিয়ে হায়দ্রাবাদ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভেতরে থাকতে শুরু করে রোহিত ভেমুলা। তৎকালীন মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি কে বহু চিঠি লেখে রোহিত। একটাও চিঠির উত্তর আসেনা। শেষপর্যন্ত ২০১৬ সালে রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যা করে, তবে এটা কোনোভাবেই আত্মহত্যা নয়, রোহিতকে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা করা হয়। রোহিত “পিছড়েবর্গ” দলিত পরিবার থেকে উঠে আসা একজন ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার শুধু নয় একজন রিসার্চ স্কলার। বিজেপি-আর এস এস মনুবাদী দর্শনে পরিচালিত, মনুবাদ  নীচু বর্ণের লোকেদের বেদ শোনার শাস্তিস্বরূপ কানে গরম সীসা ঢালার ফতোয়া জারি করে। ফলত সেই বিজেপির পক্ষে এ ঘটনা খুবই সাধারণ একটা বিষয়। ২০১৬ সালে রোহিতের ঘটনা থেকে ইন্দ্র মেঘওয়ালের ঘটনা। কিংবা কদিন আগে উত্তরপ্রদেশের ভাইরাল হওয়া ভিডিও। দলিত এবং সংখ্যালঘুদের ওপর উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের আধিপত্য স্থাপনের নানা তরিকাতে কখনো তাদের পিটিয়ে খুন করতে, কখনো তাদের কান ধরে উঠবোস করাতে কিংবা চলন্ত ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে একটুও হাত পা কাঁপে না ধর্মান্ধ শক্তি বজরঙ দল বা বিএইচ পি র কারবারিদের ! বরং এগুলোকে তারা “পবিত্র কর্তব্য” বলেই মনে করে। গত দশবছরে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেবল লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে তা শুধু নয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মহত্যার সংখ্যা। দলিত, সংখ্যালঘু, আদিবাসী, তফশিলীদের প্রতি সংগঠিত করা হয়েছে ঘৃণাবোধ। সামাজিকভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন করে এই দেশকে কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের জন্যই নির্মাণ করা হচ্ছে।

বিজেপির আমলে আরেকটা ঘটনা এক্সপোনেনশিয়ালি বেড়েছে তা হল মহিলাদের ওপর সংগঠিত হিংসা। গার্হস্থ হিংসা থেকে ধর্ষণ। মনুবাদ বিধান দিয়েছে, একজন মহিলা শৈশবে তার পিতার, যৌবনে তার স্বামীর এবং বার্ধক্যে তার পুত্রের অধীন। রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতির (আর এস এস-এর মহিলা শাখা) মূল শ্লোগানই হল একজন মহিলার মূল কাজ হল মাতৃত্ব প্রদান। চিরকালীন পুরুষতান্ত্রিক বাসনা থেকেই মহিলারা তাই বিজেপির চোখে পণ্য, আদিমতম ভোগ্যবস্তু।

সেকারণেই কাশ্মীরের কাঠুয়াতে একজন আট বছরের শিশুকে মন্দিরে আটকে রেখে সাতদিন ধরে ধর্ষণ করা হয়। তারপর প্রমাণ লোপাটের জন্য পাথরে মাথা থেতলে দেওয়া হয়। ঘোড়া খুঁজতে বাড়ি থেকে  বেরিয়েছিল এই বাচ্চাটি। ঘোড়াটা বাড়ি ফিরে এলেও শিশুটি আর বাড়ি ফিরল না। একটা ছোট্ট শিশু, যে ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম তাকে মন্দিরে আটকে হিন্দু পুরোহিতরা, পুলিশের মাতব্বররা ধর্ষণ করার মধ্য দিয়ে তামাম ভারতবাসীকে বুঝিয়ে দেয় বিজেপির ভারতে মন্দিরে যে কাউকে ধর্ষণ করাটাও বৈধ, বোঝানো হয় মন্দির যা আসলে হিন্দুদের ধর্মচর্চার স্থান তা অন্য ধর্মের মানুষকে শোষন করার স্থানও বটে! ধর্ম-লিঙ্গ ভিত্তিক শোষণ বা ইন্টারসেকশনালিটির ওপর নির্ভর করে নির্যাতনের উদাহরণ এ দেশে এখন ভুঁড়িভুঁড়ি।  আমরা আগে জানতাম না উন্নাও বলে এদেশে কোনো জায়গা আছে, এদেশে হাথরস বলে কোনো গ্রাম আছে। মোদীর আমলে এই প্রতিটা জায়গার নাম ব্রেকিং নিউজে উঠে এসেছে ধর্ষণের জন্য, নির্যাতনের জন্য। আমরা চিনতে শিখেছি মানচিত্র ধরে নির্যাতিতার পোড়া লাশের গন্ধে দেশপ্রেমের নতুন জিগির৷ ধর্ষকদের সমর্থনে বিজেপি জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করে। স্লোগান দেওয়া হয় “ভারতমাতা কী জয়”! বিলকিস বানোর ধর্ষকরা বেকসুর খালাস হয়,  আর উমর খলিদ জেলে আটক থাকে এখন..!

এবারের সেনশাসে গণনা হবে না এই সকল নির্যাতিতার নাম, যাদের শরীর খুবলে অত্যাচার করে পুড়িয়ে চিৎকার করে বলা হয়েছে ” জয় শ্রী রাম”!

মগজকে দখল করার জন্য প্রথমে যেকোনো বিষয়ে ধোঁয়াশা তৈরী করতে হয়৷ তারপর একের পর এক ঘটনা সাজিয়ে মিথ্যা নির্মাণ করা..! তবেই ফ্যাসিস্টরা দখল নিতে পারে বৌদ্ধিক জগতের। বিনির্মাণ করা যায় সত্যের। নির্মিত হয় অন্ধবিশ্বাস। গুলিয়ে দেওয়া যায় ধর্ম আর রাজনীতিকে। হিন্দু আর হিন্দুত্ব তখন সমার্থক শব্দ লাগে… পুরাণ আর ইতিহাস কে সিনোনিম মনে হয়.. বিজ্ঞান এর থেকেও কুসংস্কারকে সত্য মনে হয়। তাই খন্ডন করতে হবে যুক্তিবাদী মননকে। মেরে ফেলতে হবে সমস্ত সুস্থ চিন্তার পরিসরকে। কার্যত মগজে কার্ফু জারি করতে হবে। হ্যালুসিনেট করাতে হবে  আদারাইজেশন (অপর) এর নামে… তাই শত্রু মনে হবে কখনো ভিন্ন জাতের লোককে, ভিন্ন বর্ণের লোককে,ভিন্ন ভাষার লোককে, ভিন্ন লিঙ্গের লোককে…!!

এই তীব্র দমবন্ধ পরিবেশে যারা সোচ্চারে সত্যি কথা বলতে চেয়েছিলেন, তাদেরকে টার্গেট করে করে খুন করা হয়েছে। গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভেলকর, এম এম কালবুর্গি,গোবিন্দ পানসারে। এনাদের মধ্যে মিল খুঁজলে পাওয়া যাবে  একটাই । এনারা প্রত্যেকে উগ্র দক্ষিণপন্থাবিরোধী এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদ বিরোধী। গৌরী লঙ্কেশ কে পাঁচ বছর ধরে খুন করার প্ল্যান কষেছিল সনাতন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। প্রায় প্রত্যেককেই একই কায়দায় খুন করা হয়। ফিল্মি কায়দায় বাইকে করে এসে “আততায়ী” রা খুন করে এনাদের!! অভিযুক্তরা সকলেই প্রায় অধরা। গোবিন্দ পানসারে শুধুমাত্র “কে ছিলেন শিবাজী?” এই বই লেখার অপরাধে খুন হয়ে গেলেন! মধ্যযুগকে অনেকেই অন্ধকারময় যুগ বলে বিদ্রুপ করেন নানা গোঁড়ামীর জন্য। নয়া ভারত নিশ্চিত তার চেয়ে উন্নত নয়!!

নাগপুরের হেডকোয়ার্টার থেকে ঘোষণা করেন বটে সারসঙ্ঘচালকরা যে আর এস এস মূল শত্রু “সাংস্কৃতিক মার্কসবাদী” রা। কিন্তু আসলে যেকোনো যুক্তিবাদী মানুষই আর এস এস এর শত্রু! তাই লেখক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাউকে খুন করতে এদের দ্বিধা হয়না। আর “হিন্দুরাষ্ট্র” গঠন করতে হলে,সংবিধানকে বদলাতে হলে আর এস এস কে সকল প্রকার প্রশ্নের মূল উৎস কে উৎখাত করতে হবে নিজের সামরিক সত্তাকে ব্যবহার করে! নাস্তিক সাভারকর তাই হয়ে ওঠেন এসময়ের হিন্দুদের মাসিহা! ‘ধর্মীয় সামাজিক সংগঠন’ আর এস এস কে তাই মিলিটারাইজ করার ব্রত পালন করতে হয়। আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করা স্ট্যান স্বামীকে জেলের ভিতর হত্যা করা হয়। আর বিপরীতে কোটি কোটি টাকা লুট করা কর্পোরেটরা জায়গা পায় মোদির সেলফিতে!!

এইবারের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না এমন বহু কন্ঠ, যাদের কলমকে, যাদের কথাকে ভয় পায় আর এস এস। এবারের আদমশুমারীতে নাম থাকবে না আমাদের এমন বহু সহনাগরিকের যাদের কে খুন করে,হত্যা করে নিজেদের হেজেমনি স্থাপন করতে চায় আর এস এস। ভারতকে বানাতে চায় হিন্দু জায়নবাদী দেশে। নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়িয়ে তাই মোদীর মুসলিমবিদ্বেষ,নারীবিদ্বেষ ছড়াতে একবারের জন্যও গলা কাঁপে না, মোদীউডের নামে একের পর এক সিনেমায় ছদ্ম শত্রুর বিরূদ্ধে ঘৃণা নির্মাণ  করতে সেন্সরের পরোয়াও করতে হয় না।সব ধরণের অন্যায়,গা জোয়ারী এখন এখানে বৈধ।

আর এর উল্টোদিকে জনমত গঠনের কাজ। প্রশান্ত কিশোরের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা ফলস প্রোপাগান্ডা গঠন না- জনমত যা নির্মিত হয় রাস্তার লড়াইয়ে। ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে সকল প্রকার আধিপত্যবাদের বিরূদ্ধে সংগ্রামী মানুষের লড়াইয়ের কথা বলতেন যারা তাদের হয়ে আমাদের লড়তে হবে। প্রতিটা ধর্ষিতার শেষ আর্তনাদের কান্না যা আমাদের গলার কাছে দলা পাকিয়ে রাখে ঘেন্নাকে, তা উগড়ে দিতে হবে এই ধর্ষকদের সোশ্যাল ভ্যালিডেশন (সামাজিক বৈধতা)দেওয়া বিজেপি আর এস এস এর বিরূদ্ধে।  আখলাক জুনেইদ রোহিত এর গোঙানির শব্দে আমাদের চোখ ভিজে আসলেও প্রত্যয়ী লড়াইয়ে এদের হত্যাকারীদের দিকে ছুঁঁড়ে দিতে হবে প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ। আমাদের মিলিত লড়াই ইনসাফ দেবে আমাদের বিচার না পাওয়া হাজারো সহনাগরিকদের!