সত্যেন সরদার

MANIPUR IS BURNING

মনিপুর জ্বলছে।

গোষ্ঠীর হিংসায়। জাতি বিদ্বেষের ভয়ঙ্কর বিষে। মনিপুর জ্বলছে সেখানকার বীরেন সিং সরকার, শাসক দল বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবারের পান্ডা আরএসএস, দেশের ও রাজ্যের গোটা রাষ্ট্র-ব্যাবস্থা এবং কর্পোরেট পুঁজির যৌথ ষড়যন্ত্রে।   

আজ নয়, গত ৩রা মে মনিপুরে প্রথম এই ষড়যন্ত্রের আগুন জ্বলে। তারপর আড়াই মাসের বেশি সময় কেটে গেছে, সেই আগুন নেভার কোনো নামগন্ধ নেই। বরঞ্চ সেই আগুন আরো ছড়িয়েছে। জাতি হিংসার আগুন নেভানোর কোনো রকম উদ্যোগ কোনো তরফেই নেই। না মনিপুরের বীরেন সিং সরকারের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের তরফে কোনো উদ্যোগ আছে। না কোনো উদ্যোগ আছে দেশের নরেন্দ্র মোদী সরকারের তরফে। বরঞ্চ এই হিংসার আগুন আরো উসকে দেওয়ার কূট-কৌশল আছে। রাজ্য আর কেন্দ্র, দুই সরকারের তরফেই।

গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে মণিপুর জুড়ে জাতি-হিংসার যে আগুন জ্বলছে তাতে এখনো পর্যন্ত দেড়শর বেশি মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে। আহত প্রায় এক হাজার। ৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২০০টি গ্রাম। এরমধ্যে প্রায় ৬০টি গ্রাম পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। তাঁদের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে নিজের রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্যে চলে গেছেন।

গত আড়াই মাস ধরে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র, বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার এবং কর্পোরেট পুঁজির যৌথ ষড়যন্ত্র আর মারন-তান্ডবে মণিপুর ছারখার হলেও তার দিকে গোটা দেশের নজর সেভাবে ছিলো না। মণিপুরের খবর প্রচারে কর্পোরেট পুঁজির দাসত্ব করা গোদী মিডিয়ার চরম অনিহার কারনেই ছিলো না। আমাদের রাজ্যে একসাথে তৃণমূল এবং বিজেপির হয়ে ভাড়া খাটা মেন স্ট্রিম মিডিয়াতেও মণিপুর নিয়ে এতদিন ধরে এক লাইনও খবর বেরোয়নি। কোনো মিডিয়া মাতব্বরের তৈরি ন্যারেটিভের ভিত্তিতে টিভির পর্দায় ঘন্টা খানেক কারো সঙ্গে কোনো আলোচনাতেও বিভিন্ন চ্যানেলের স্বঘোষিত পান্ডারা একটি বারের জন্যও মনিপুরের কথা তোলেননি। আর এরমধ্যেই মণিপুরে ঘটে গেছে আরো একটি ঘটনা। যা আসমুদ্র হিমাচল সমস্ত মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে সব মিডিয়া তা নিয়ে খবর করতেও বাধ্য হলো। এই সময় আমাদের রাজ্যেও ঘটে গেলো আরো একটি গা শিউড়ে ওঠা ঘটনা। তৃণমূল-বিজেপির মেকি বাইনারি তৈরিতে ব্যস্ত আমাদের রাজ্যের মিডিয়াও যা নিয়ে খবর করতে বাধ্য হয়েছে। খবর হয়েছে সর্বভারতীয় মিডিয়াতেও।

দুই খবরে দুই দৃশ্য। সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে আপাদমস্তক তীব্র ভাবে ঝাঁকিয়ে দেওয়া দুটি ভিডিও।

 

দৃশ্য ১:  মেঠো পথ দিয়ে ২ জন আদিবাসী মহিলাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজনের বয়স কুড়ি-বাইশ। অপরজন চল্লিশের আশেপাশে। তাঁদের ঘিরে কয়েকশ উন্মত্ত জনতা। বেশ কয়েকজন বিকৃত মনা যুবকের হাত নগ্ন দুই নারীর সারা শরীর জুড়ে হাতড়ে যাচ্ছে। তারপর রাস্তার পাশের মেঠো জমিতে আছড়ে ফেলে ওই দুই মহিলাকে ধর্ষণ করা হলো। দল বেঁধেই। যেদিন মণিপুরে প্রথম জাতি হিংসার ঘটনা ঘটে সেই ৩রা মে-র ধারেপাশে কোনো একদিন এই বর্বরতম ঘটনাটি ঘটলেও তা প্রকাশ্যে এসেছে এই সেদিন। জুলাই মাসের চতুর্থ সপ্তাহে। একটি ভিডিওর মাধ্যমে। কেউ বা কারা এই ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার পর। সেখানে ২ জন মহিলাকে দেখা গেলেও জানা গেছে, নির্যাতিতা হয়েছিলেন মোট তিন জন মহিলা। একজন কোনক্রমে পালিয়ে যান। খবরে প্রকাশ ওই তিন মহিলাই কুকি জনজাতি গোষ্ঠীর। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে যে দুই মহিলাকে কয়েকশ উন্মত্ত বিকৃতকাম জনতার হাতে নির্যাতিতা হতে, ধর্ষিতা হতে দেখা গেছে, তাঁদের একজন আবার প্রাক্তন এক সেনা জওয়ানের স্ত্রী। সেদিন নিজের পরিচয় দিয়েও সেই সেনা জওয়ান স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারেননি। মোদীর জমানায় ‘‘শাইনিং ইন্ডিয়া’’ এবং ‘‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’’- এর হাড় হিম করা এক ঘটনা।

দৃশ্য ২:  দুই মহিলাকে মারধর করছে আরো একদল মহিলা। টেনে ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ। দু‘হাত দিয়ে নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষার মরিয়া চেষ্টা করছেন তাঁরা। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তাঁরা নিজেদের সম্ভ্রম বাঁচাতে পারলেন না। সম্পূর্ণ নগ্ন করে তাঁদের বেধরক মারধর করা শুরু হলো। ভরা হাটের মাঝে। সবার সামনে। পাশে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের ভাড়াটে বাহিনী হয়ে ওঠা সিভিক পুলিশের দুই কর্মী। চোখের সামনে দুই মহিলাকে নগ্ন করে মারা হচ্ছে দেখেও তারা কানে ফোন গুঁজে কথা বলতেই মশগুল। ঘটনাস্থল মালদহের বামনগোলার পাকুয়াহাট। মমতার রাজত্বে কন্যাশ্রী আর লক্ষ্মীশ্রীদের চরম দুর্দশার অসংখ্য ঘটনার মাত্র একটা খন্ডচিত্র।

গা শিউড়ে ওঠা দুটি দৃশ্য। প্রেক্ষাপট অবশ্যই আলাদা। মণিপুরের জাতি হিংসার আগুন এ‘রাজ্যে জ্বলেনি। কিন্তু নারীর ওপর অত্যাচার! জান্তব হিংসায় দল বেঁধে পিটুনি। কদর্য উন্মত্ততার ‘‘মব লিঞ্চিং’’! মনিপুরে যা, বিজেপি শাসিত অন্য রাজ্যগুলিতে যা, আমাদের রাজ্যে তারই ছায়া। মালদহের এই বর্বর ঘটনার জন্য একই সাথে বিজেপি, তৃণমূল এবং শাসক দলের গোলামে পরিণত হওয়া পুলিশ-প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেছেন, মণিপুরের মতো ঘটনা এ’রাজ্যেও ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। দলবেঁধে মার বিজেপি-আর এস এসের রাজনীতি। তৃণমূল ক্ষমতায় আছে বলে এ‘রাজ্যেও সেটা সম্ভব হচ্ছে। সেলিম আরো বলেছেন, মণিপুরের ঘটনাকে যারা ধামাচাপা দিচ্ছে সেই বিজেপির মালদহের নারী নির্যাতন দেখে হটাৎ করে বিবেক জেগে উঠলো কেন? রাজ্যের তৃণমূল সরকার, জেলা পুলিশ-প্রশাসন এবং বিজেপির জন-প্রতিনিধিরা কি ঘুমাচ্ছিলেন? মালদহের যেখানে এই ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে সেখানের সাংসদ, বিধায়ক তো বিজেপির। তাঁরা কি করছিলেন ? সপাটে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন মহম্মদ সেলিম।

ঠিকই তো বলেছেন মহম্মদ সেলিম। মালদহের যে হাটে এই ঘটনাটা ঘটেছে কার্যত সেখান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে পুলিশের ঘাঁটি। পাকুয়াহাটের ফাঁড়ি ঘটনাস্থলের ১০০ মিটারের মধ্যে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, রাজ্য জুড়ে হইচই পড়ার আগে পর্যন্ত যারা ওই দুই মহিলার ওপর বর্বর অত্যাচার করলো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি মমতা ব্যানার্জির পুলিশ। উলটে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে সেই দুই মহিলাকেই, যাঁদের নগ্ন করে দলবদ্ধ ভাবে পেটানো হলো। রাজ্যের তৃণমূল সরকারের যিনি মাথা, যিনি সকাল-বিকেল দুই বেলা কন্যাশ্রী এবং লক্ষ্মীশ্রীর বুলি কপচান, যিনি নিজে মহিলা, সেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মুখে কুলুপ। আর বর্বরতার শিকার হওয়া দুই মহিলার পাশে না দাঁড়িয়ে রাজ্যের আরেক মহিলা মাথা, যিনি নাকি আবার পশ্চিমবঙ্গের নারী ও শিশু কল্যানের মন্ত্রী, সেই শশী পাঁজা বলে দিলেন, ‘‘ওই দুই মহিলা চোর ছিলেন। একটা বড় হাট। সেখানে চুরি হয়েছে। সেখানে মহিলারাই ওই দুই মহিলাকে ধরেন। ধস্তাধস্তিতে পোশাক খুলে যায়।‘‘

এমন কথাবার্তা, যেন কেউ চুরি করলে তাঁকে নগ্ন করে পেটানোটাই দস্তুর। শশী পাঁজার গলায় ঠিক আর এস এস-বিজেপির সুর। গরু খাওয়ার নাম করে বিজেপি-আর এস এস সহ সঙ্ঘ পরিবারের পান্ডারা যখন দলবেঁধে মানুষ পিটিয়ে মারে তখন তাদের মুখ থেকে ঠিক এ‘ধরনেরই কুযুক্তি ঠিকরে বেরোয়। চরিত্র বিলকুল এক।

ণিপুর ঘিরে ডবল ইঞ্জিন সরকার এবং সঙ্ঘের চক্রান্ত

সেভেন সিস্টার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য। নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং অরুণাচল প্রদেশ। এ‘তো হলো ছয় বোন। সাত নম্বর বোন মণিপুর।

জওহরলাল নেহেরু মণিপুরকে ‘ভারতের রত্ন’ বলতেন। মণিপুরের মানচিত্র দেখতে হীরের খণ্ডের মতো। জওহরলাল নেহরুই প্রথম মণিপুরকে আদর করে এই নামে ডাকেন।

মণিপুর খুবই সংবেদনশীল একটি সীমান্ত রাজ্য। এখানে মোট ৩৬টি জনজাতি আর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস। খুবই বৈচিত্র্যময় একটা অঞ্চল। মানব সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, দুই দিক থেকেই। মণিপুরে বসবাসকারী তিনটি প্রধান অংশের একটি হলো ইম্ফল উপত্যকার বাসিন্দা মেইথেই সম্প্রদায়। যাঁরা হিন্দু ধর্ম বা আদিবাসী সানামাহি ধর্মের অনুসারী। দ্বিতীয় হলো কুকি এবং নাগা জনগোষ্ঠী। যাঁরা প্রধানত খ্রিস্টান। এছাড়াও এখানে বেশ কয়েকটি ছোট উপজাতি সম্প্রদায় এবং অন্যান্য রাজ্যের মানুষজনও রয়েছেন।

উত্তর-পূর্বের সাত বোনের এক বোন, জওহরলাল নেহরুর আদরের হিরের টুকরোতে গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে জাতি হিংসার আগুন জ্বলছে। মণিপুরে এর আগেও অবশ্য এক জনজাতি গোষ্ঠীর সাথে অন্য জনজাতি গোষ্ঠীর সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। অতীতে সেই সব সংঘাত বা দ্বন্দ্বের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। সবই ছিলো জনগোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষের ঘটনা। যেমন অতীতে নাগা এবং কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ২০১৭ সালে মণিপুরে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। যদিও সেটাও এক ষড়যন্ত্র। ৬০ আসনের মণিপুর বিধানসভায় বিজেপি পায় ২১ টি আসন। কংগ্রেস তার থেকে ৭টি আসন বেশি পায়, মোট ২৮টি। কিন্তু তার পরেও ঘোড়া কেনাবেচার মতো দেদার অর্থ ছড়িয়ে অন্য দলের বিধায়কদের কিনে মণিপুরে সরকার গড়ে বিজেপি। আর বিজেপির এই ষড়যন্ত্রে তৃণমূলও শরিক। আস্থা ভোটে বিজেপিকেই সমর্থন করেন মণিপুরের তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক টি রবীন্দ্র সিং। দলের সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জির নির্দেশ ছাড়াই তিনি বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন— কেউ একথা বললে ঘোড়াতেও হাসবে।

আর তারপরেই মণিপুরে বিজেপি, আর এস এস, সঙ্ঘ পরিবারের অন্যান্য সংগঠন এবং গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তারা একসাথে মিলেই ষড়যন্ত্র করে এবং ধর্মীয় প্ররোচনা ছড়িয়ে খ্রিস্টান ধর্মালম্বী কুকিদের বিরুদ্ধে সুকৌশলে হিন্দু ধর্মালম্বী মেইথেইদের বিবাদ লাগিয়ে দেয়। বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের এই চক্রান্তই আজ মেইথেই-কুকি জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বকে হিন্দু-খ্রিস্টান ধর্মীয় সংঘাতের রূপ দিয়েছে। যে সংঘাত মণিপুরে কার্যত কুকি গণহত্যার চেহারা নিয়েছে। প্রতিটা ক্রিয়ার যেমন পালটা প্রতিক্রিয়া থাকে, তেমনই মেইথেই চরমপন্থী গোষ্ঠীর পালটা কুকিদের মধ্যেও কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। কুকিদের পালটা প্রতিরোধে কোথাও কোথাও মেইথেই জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষেরও জীবন যাচ্ছে। তবে সংখ্যায় তা অনেক কম। এই সংঘাত এবং জাতি হিংসার আগুনে কুকিদের জীবন-জীবিকা এবং বাসস্থানের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। গুজরাটের মতোই মণণিপুর আজ উগ্র হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া বাহিনী এবং কর্পোরেট পুঁজির সীমাহীন ধান্দার নতুন গবেষণাগার। 

কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী। মণিপুরে বীরেন সিং। বিজেপি-র এই ডাবল ইঞ্জিন সরকার মণিপুরের হিংসার জন্য কেন দায়ী ? 

প্রথম কারন: সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে মণিপুরে আসা হাজার হাজার শরণার্থীর অভিবাসনের বিষয়টিকেও কুকিদের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি করতে কাজে লাগিয়েছে কেন্দ্রের মোদী, মণিপুরের বীরেন সিং সরকার। সাথে শাসক দল বিজেপি এবং আর এস এস সহ সঙ্ঘ পরিবারের বাকি পান্ডারা সমান তালে পাল্লা দিয়ে, একের পর এক মিথ্যে গালগল্প ছড়িয়ে বাজার গরম করেছে। মেইথেই সহ মণিপুরের বাকি অংশের মানুষকে কুকিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছ। মিজোরাম এবং মণিপুর উভয় রাজ্যের ক্ষেত্রেই মায়নামার থেকে তাড়া খেয়ে আসা উদ্বাস্তুদের কুকিরা কিন্তু স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং আশ্রয়ও দিয়েছিলেন। কারন মায়নামার থেকে আসা শরণার্থীরা কুকিদের মতোই একই জনজাতি গোষ্ঠীর। কিন্তু কেন্দ্রের মোদী সরকার তাঁদের উদ্বাস্তু মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। মায়নামার থেকে আসা শরনার্থীদের কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ঘোষণা করে দেয়। এই ঘটনায় মায়ানমার থেকে আসা শরনার্থীরা একদিকে যেমন সমস্যায় পড়েছেন তেমনই বিজেপি সহ অনান্য বিভেদের শক্তির প্ররোচনায় তাঁরা কুকি ছাড়া বাকি অংশের নানা বিরোধিতা এবং হামলার মুখেও পড়ছেন। তাঁদেরকে আশ্রয় দেওয়ার কারনে কুকিদের বিরুদ্ধেও মণিপুরের বাকি অংশের মানুষকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। এরফলে দেদার হিংসাও ছড়াচ্ছে।

দ্বিতীয় কারন: রাজ্যের বীরেন সিং সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলিকে উচ্ছেদ করতে শুরু করে। মুলত কুকিদের। এর পিছনেই রয়েছে ধান্ধার ধনতন্ত্র এবং কর্পোরেট পুঁজির উদগ্র লালসা এবং ধান্দাবাজি। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। বাস্তব ঘটনা হলো, রাজ্যের বনাঞ্চল থেকে কুকিদের উচ্ছেদ করার কারনে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। বিপুল সংখ্যক কুকি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুকিরা জীবন-জীবিকার জন্য পোস্ত চাষ করে থাকেন। এটাকেও বৈরী কার্যকলাপ অ্যাখ্যা দিয়ে কুকিদের বিরুদ্ধে লোক ক্ষেপানোর কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এস এস-বিজেপি মিলে আরামবাই টেঙ্গোল এবং মেইথেই লিপুনের মতো চরমপন্থী মেইথেই গোষ্ঠীগুলিকে কুকিদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছে। বিজেপি, আরএসএস এবং চরমপন্থী মেইথেই গোষ্ঠীগুলো একসাথে মিলেই কুকিদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচারের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি মায়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের সাথে কুকিদেরও অবৈধ বহিরাগত হিসাবে স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া হয়েছে। কুকিদের টার্গেট করে ধেয়ে এসেছে একের পর এক মিথ্যা প্রচার।

মোদীর হিরন্ময় নীরবতা: মোদীর এই বিষ্ময়কর নীরবতাই হলো  কুকি-বিরোধী রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের অন্যতম উদাহরণ। সুপ্রিম কোর্টের কাছে ধ্যাতানি খাওয়ার আগে পর্যন্ত মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে একটি কথাও মোদী বলেননি। মণিপুরে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার কোনো আবেদনও তিনি করেননি। শুধু তাই নয়, মণিপুরে জাতি হিংসার আগুন যখন ছড়াতে শুরু করেছে তখন সেই রাজ্য থেকে বিজেপি বিধায়কদের একটি প্রতিনিধি দল এবং বিরোধী দলগুলি পৃথকভাবে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো। কিন্তু তাদের দিল্লিতে যাওয়াটাই সার হয়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে দেখা না করেই সেই সময় আমেরিকা পাড়ি দেন। এই ঘটনাও মণিপুরের সর্বস্তরের মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে হিরন্ময় নীরবতা পালনের পর দেশজোড়া বিক্ষোভের মুখে এবং সুপ্রিম কোর্টের ধ্যাতানি খেয়ে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে সংসদ চললেও সংসদের মধ্যে নয়। সেখানে মণিপুর নিয়ে উত্তাল বিক্ষোভে অধিবেশন ভেস্তে গেলেও মোদীর মুখ থেকে টুঁ শব্দটুকু বার হয়নি। পরে বেকায়দায় পড়েছেন বুঝে সংসদের বাইরে সাংবাদিকদের সামনে তিনি মুখ খোলেন। মণিপুরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কড়া আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন। তারপর বেশ কিছুদিন দিন কেটে গেলেও কেন্দ্রের তরফে কোনো কড়া ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। ফলে দীর্ঘ নীরবতার পর  মণিপুর নিয়ে মোদীর মুখের বচনকে সবাই কুমিরের কান্না বলেই মনে করছেন। বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবার এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মিলিত চক্রান্তে মণিপুর জুড়ে যে তান্ডবলীলা চলছে তার জন্য সে‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ দাবি করেছে সি পি আই(এম) পলিটব্যুরো। মণিপুরে যে জাতি হিংসার আগুন জ্বলছে তার বিরুদ্ধে গোটা দেশও সোচ্চার।

ধান্দার ধনতন্ত্র এবং শাসক-কর্পোরেট ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য কি?

মণিপুরের খনিজ সম্পদের বিপুল ভান্ডারই দেশ ও রাজ্যের শাসক বিজেপি এবং তাঁদের জিগরি দোস্ত কর্পোরেট পুঁজির প্রধান টার্গেট। যেখানে এই খনিজ সম্পদের বিপুল ভান্ডার সেখানেই মূলত কুকিদের বসবাস। মণিপুরের পাহাড় এবং বনাঞ্চল। তাই সেখান থেকে কুকি খেদাও, খনিজ সম্পদ হাতাও — এটাই দেশ ও মণিপুরে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার এবং কর্পোরেট পুঁজির প্রধান ধান্দা।

জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জিএসআই)-র সমীক্ষা অনুসারে মণিপুরে নিকেল, তামা এবং মহার্ঘ্য প্লাটিনাম গ্রুপের খনিজ পাওয়া গেছে। এছাড়াও আছে ম্যাগনেটাইট, আ্যজুরাইট, ম্যালাকাইট, লাইমস্টোন এবং আরো বেশকিছু খনিজ সম্পদ। মণিপুরের ২২ হাজার ৩২৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই সমীক্ষা করে জিএসআই। মণিপুরের যে এলাকাগুলোতে জিএসআই এই সমীক্ষা চালায় সেগুলি হলো— উখরুল, হুন্দুং (উত্তর), হুন্দুং (দক্ষিণ), মোভা, খাংখুই, নিউ পাওয়ি, উখরুল জেলার ফুঙ্গিয়ারের অংশ, চান্দেল জেলার নারুম এবং আরো কিছু অঞ্চল। এখানে চুনাপাথর বা লাইমস্টোনের বিশাল ভান্ডার পাওয়া গেছে। ফাংরাই এবং কোয়াথা এলাকায় পাওয়া গেছে ক্রোমাইট। ফাংরাই, উখরুল জেলার নামপিশা এবং চান্দেল জেলার কোয়াথাতে নিকেল, তামা, লিগনাইট এবং মহার্ঘ্য প্ল্যাটিনামের একটা গ্রুপের সন্ধান মিলেছে। সাথে অন্যান্য খনিজ সম্পদও আছে।

মণিপুরের ৮৯ শতাংশ জমি পাহাড় এবং বনাঞ্চল ঘেরা। মূলত এই সব খনিজ পদার্থ সঞ্চিত আছে সেখানেই। আর এখানেই কয়েকশ বছর ধরে আদিবাসী মানুষের বাস। মূলত কুকি এবং নাগা জনজাতি গোষ্ঠী। কুকিরাই সংখ্যায় বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এই খনিজ সম্পদের ওপর দেশের লুটেরাদের শকুনের দৃষ্টি। কর্পোরেট পুঁজির মাতব্বরদের বলগাহীন মুনাফার ধান্দা। আর এই মুহূর্তে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী দলটি নাম বিজেপি। যারা দেশ এবং মণিপুরে ক্ষমতায়। সুতরাং অবাধ লুটের পথ পরিস্কার।

তার জন্যও আবার দ্বিমুখী ষড়যন্ত্র। মণিপুরে মেইথেইদেরই প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি। অতীতে মনিপুরের যাঁরা রাজা ছিলেন তাঁরা এই মেইথেই জনগোষ্ঠীরই মানুষ। তাঁরা কোনো কালেই তফসিলী উপজাতির তালিকা-ভুক্ত ছিলেন না। কুকিদের বিরুদ্ধে এই মেইথেই সহ মনিপুরের অন্যান্য অংশের মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার পাশাপাশি মণিপুরের বিজেপি সরকার শিয়ালের ধূর্ততায় কূট-কৌশলের অঙ্ক কষে মেইথেইদের তফশিলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে ধান্দার ধনতন্ত্র আর কর্পোরেট পুঁজির পথ আরো চওড়া করাই লক্ষ্য। পাহাড় এবং বনাঞ্চলের জমি কেনার অধিকার এতদিন মেইথেইদের ছিলো না। এখন মেইথেইরা উপজাতি হলে সহজেই পাহাড় এবং বনের জমি কিনতে পারবে। আর সেই জমি বেচেও দিতে পারবে কর্পোরেট পুঁজির পান্ডা এবং মাইনিং কোম্পানিগুলির কাছে।

এখানেই অবশ্য ধান্দার শেষ নয়। কর্পোরেট প্রভুদের মন রাখতে মণিপুরে ক্ষমতায় এসেই ২০১৭ সালে রাজ্যের শিল্প ও বিনিয়োগ নীতি নতুন করে তৈরি করে বীরেন সিং সরকার। মাইনিং কোম্পানিগুলিকে ঢালাও ছাড় এবং আরো নানা সুবিধা দেওয়াই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। সেই লক্ষ্যে বীরেন সিংয়ের সরকার ২০১৮ সালে মণিপুরের নয়া খনিজ নীতিও তৈরি করে। তার সাথেই শুরু হয় রাজ্যের বনাঞ্চল এবং পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে কুকি পরিবারগুলিকে বেপরোয়া ভাবে উচ্ছেদ করার কাজ।

আর গত আড়াই মাস ধরে মণিপুর জুড়ে জাতি হিংসার যে মারণ-তান্ডব চলছে তা আসলে মণিপুরের বন এবং পাহাড় থেকে কুকিদের সমূলে খেদিয়ে তাড়ানোর লক্ষ্যে এক প্রাণঘাতী গণহত্যা কারসাজি। নিজভূমি থেকে তাঁদের ভিটে-মাটি চাটি করার নিষ্ঠুরতম ষড়যন্ত্র।

আমাদের রাজ্যেও একই রকম ভাবে নানা জায়গা থেকে আদিবাসী এবং গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করে সেই জমি কর্পোরেট হাঙরদের হারে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। এমনকি গ্রামের দাপুটে এবং অর্থবান তৃণমূলী পান্ডাদের খুশি করতে বামফ্রন্ট আমলের পাট্টা পাওয়া জমি থেকেও গরিব এবং প্রান্তিক মানুষকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। যাঁদের মধ্যে আদিবাসী এবং তফসিলীরাই সংখ্যায় বেশি। এইসব ঘটনা ঘটছে আমাদের রাজ্যের নানা প্রান্ত জুড়েই। দেউচা পাচামী তারই সাম্প্রতিকতম একটা উদাহরণ। সেখানকার হরিণডাঙা, চাঁচপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মথুরাপাহাড়ি, কেন্দপাহাড়ি সহ বেশকিছু জনপদ থেকে গরিব, প্রান্তিক এবং খেটেখাওয়া মানুষকে উচ্ছেদ করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। সেখানকার জমি তৃণমূলের কর্পোরেট-বন্ধু আদানিদের হাতে তুলে দেওয়ার ছক কষা হচ্ছে। সেই মণিপুরের মতোই মাইনিংয়ের নামে মানুষের জীবন-জীবিকা এবং বাসস্থানের ওপর বেপরোয়া আক্রমণ নামিয়ে আনার ঘটনা। দেউচা-পাঁচামীর আদিবাসী এবং গরিব তফসিলী মানুষের চরম সর্বনাশ করে, গায়ের জোরে তাঁদের উচ্ছেদ করে সেখানে কয়লা খনি বানানোটাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর সরকারের টার্গেট। তার বিরুদ্ধে অবশ্য তীব্র লড়াইও হচ্ছে। রাজ্যের তৃণমূল সরকার এবং তাঁদের বন্ধু আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একজোট দেউচা-পচামীর মানুষ। লালঝান্ডাও দেউচা-পাঁচামীর গরিব, প্রান্তিক এবং খেটেখাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা ও বাসস্থান বাঁচানোর মিলিট্যান্ট সংগ্রামকে জোরালো ভাবেই সমর্থন করেছে। দৃঢতার সাথেই পাশে দাঁড়িয়েছে দেউচা-পচামীর মানুষের।  

মাদের রাজ্য ঘিরেও ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে

‘‘মণিপুরের মতো ঘটনা এ’রাজ্যেও ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। দলবেঁধে মার বিজেপি-আর এস এসের রাজনীতি। তৃণমূল ক্ষমতায় আছে বলে এরাজ্যেও সেটা সম্ভব হচ্ছে।’’— একথা যাঁরা বলছেন তাঁরা কি এক বিন্দু অন্যায় করছেন?

‘‘মালদহে হাটের মাঝে, অগুনতি লোকের সামনে দুই মহিলাকে নগ্ন করে মারার ঘটনায় একসাথে তৃণমূল এবং বিজেপি দায়ী’’— একথা য়াঁরা বলছেন তাঁরা কি ভুল করছেন?

না করছেন না। এক চুলও অন্যায় কিংবা ভুল করছেন না।

আমাদের রাজ্যেও আজ মণিপুরের ছায়া। মমতার রাজত্বে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষনের ঘটনায় দেশের প্রথম দু‘তিনটে রাজ্যের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান। রাজ্যের পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে এ‘বিষয়ে কেন্দ্রকে পরিসংখ্যান দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। রাজ্য জুড়ে ক্রমাগত বেড়ে চলা নারী নির্যাতন এবং ধর্ষনের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়াই তৃণমূলের লুম্পেন-রাজের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় আজ যা মণিপুরে কাল তা যে আমাদের রাজ্যে হবে না, এটা কি কেউ দিব্যি খেয়ে বলতে পারেন? যেখানে আর এস এসের দুর্গা, তৃণমূলের দুর্বৃত্ত এবং লুম্পেন বাহিনীর পান্ডা মমতা ব্যানার্জি আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী! যেখানে কুড়মি আর আদিবাসী, এই দুই অংশের মানুষকে নিয়েই তৃণমূল আর বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে। যেখানে আরো নানা কায়দায় মানুষে মানুষে বিভাজন ঘটানোর ছক কষছে তৃণমূল এবং বিজেপি। 

মণিপুরে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের ছক মণিপুরের মতো। সেখানকার জনবিন্যাস এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে। আর এখানে বিজেপি এবং তৃণমূলের বিভাজনের রাজনীতির ছক আমাদের রাজ্যের মতো করে। আমাদের রাজ্যের জনবিন্যাস এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুসারে। মণিপুরে যেমন কুকিদের বিরুদ্ধে মেইথেইদের লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে তেমনই আমাদের রাজ্যে কোথাও পাহাড়ের সাথে সমতলের, কোথাও রাজবংশীদের সাথে বাকিদের, কোথাও মতুয়াদের সাথে সংখ্যালঘু ও অন্যান্যদের, কোথাও হিন্দুদের সাথে মুসলিমদের লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। পৃথক গোর্খাল্যান্ড, পৃথক কামতাপুরি, রামনবমীকে ঘিরে হাওড়ার শিবপুর, হুগলির রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এরকমই কিছু বিভাজনের রাজনীতির উদাহরণ। তৃণমূল এবং বিজেপির মিলিত উসকানি এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতে গরম প্রমাণ। তৃণমূলের জমানায় রামনবমীকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আঁচ কিন্তু হাওড়া, হুগলি ছাড়াও রাজ্যের অন্যান্য বেশকিছু জেলায় পড়েছে। এর আগে গোর্খাল্যান্ড এবং কামতাপুরের দাবি ঘিরে যে সংঘাতের পরিস্থিতি আমাদের রাজ্যে তৈরি করা হয়েছিলো তাতে সি পি আই(এম) কর্মীদেরই রক্ত ঝরেছে। জীবনও গেছে। এই সেদিন হাওড়াতে শান্তি মিছিল করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে হয়েছে সেই লালঝান্ডাকেই। তৃণমূল এবং বিজেপি শুধু পরিস্থিতির ফায়দা তুলতেই ব্যস্ত থেকেছে।

আর এখন নতুন করে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহল, লালপাহাড়ির দেশ এবং উত্তরবঙ্গের আদিবাসী প্রধান এলাকাগুলিতে। নানাভাবে প্ররোচনা ছড়িয়ে কুড়মিদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। সামনে অরাজনীতির পর্দা। কিন্তু চোলি ক্যা পিছে কেয়া হ্যায়? পিছনে বিজেপি এবং তৃণমূল দুই দলেরই নানা ষড়যন্ত্র। ভোট ভাগাভাগির খেলায় কে কোন অংশকে টানবে তারই নানা কূট-কৌশল। এর পাশাপাশি এইসব এলাকায় আদিবাসীদের মধ্যেও নানা বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। কূট-কৌশলের ফন্দি-ফিকির করে কুড়মিদের লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে। আর তারই ‘‘ভাইস-ভার্সায়’’ কুড়মিদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে আদিবাসীদের। চোলি ক্যা পিছে সেই বিজেপি এবং তৃণমূল। মানুষে মানুষে বিভাজন গড়ে দাও। লালঝান্ডার শ্রেণির লড়াইয়ের মূল শক্তি গরিব, প্রান্তিক ও মেহনতি মানুষের মধ্যে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে তাদের টুকরো টুকরো করে নানা ভাগে ভাগ করে দাও। ভোট ভাগাভাগির সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাশাপাশি শ্রেণির মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে লালঝান্ডাকে, সি পি আই(এম)-কে দুর্বল করাই হলো তৃণমূল এবং বিজেপির মূল টার্গেট।

আর তার জন্যই কর্পোরেট প্রভুর নির্দেশে পলিসি ঠিক করা ‘‘দিদি’’ এবং গোদী মিডিয়ায় তৃণমূল-বিজেপির বাইনারির গল্প ফাঁদা। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের এত সন্ত্রাস, এত হিংসা, এত খুন-জখম, এত ভোট লুট, এমনকি শাসক তৃণমূল-পুলিশ-প্রশাসন-নির্বাচন কমিশনের যৌথ ষড়যন্ত্রে সি  (এম)-র পক্ষে যাওয়া জনমত গণনাকেন্দ্র থেকে দেদার লোপাট করে দেওয়ার পরেও সেই বাইনারির ফানুস চুপসে বিলকুল চ হয়ে গেছে। বাম, কংগ্রেস এবং আইএসএফের মিলিত ভোট বেড়েছে ১১%। আর বিজেপির ভোট কমেছে ১৬%। পঞ্চায়েত ভোটে কোথাও লালঝান্ডার নেতৃত্বে, কোথাও বা ভোট দেওয়ার মরিয়া চেষ্টায় সাধারণ মানুষ নিজেরাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়েছেন। নিজের এবং অন্যের ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় জীবন দিতেও তারা পিছপা হননি। আবার বুথ দখল এবং ভোট লুট করতে আসা তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনীর কয়েকজনের জীবন নিতেও তাঁদের হাত কাঁপেনি।

বিরোধী দলগুলির মিলিত সমঝোতা ‘‘ইন্ডিয়া’’-তে বিজেপি যেমন ভয় পেয়েছে তেমনই পঞ্চায়েত ভোটে জনমতের এই ন্যারেটিভে তৃণমূলের মাথা মমতাও রীতিমতো আতঙ্কিত হয়েছেন।

আর তাই নতুন করে শুরু হয়েছে বাম বিরোধী নানা আক্রমণ। পাটনা এবং বেঙ্গালুরুর বিজেপি বিরোধী বৈঠক ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল অপপ্রচার। যার নেতৃত্বে সেই মোদী এবং ‘‘দিদি’’ ভক্ত কর্পোরেট মিডিয়া। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি লালঝান্ডার কর্মী বাহিনীর একাংশকে বিভ্রান্ত করার মরিয়া চেষ্টায় তারা কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মণিপুরের সাথে পশ্চিমবঙ্গের কোনো ভাবেই কোনো তুলনা টানা উচিত নয় বলে তারাও বাজার গরম করছে। তৃণমূল এবং বিজেপিও পর্দার আড়ালে নখ-দাঁত শান দিচ্ছে।

বিপদ কিন্তু ওঁত পেতে আছে। তাই যেকোনো বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে লালঝান্ডার কর্মীদেরই সতর্ক থাকতে হবে। দ্ধিধাহীন কঠোর সতর্কতা যেমন বাইরে প্রয়োজন, তেমনই ঘরেও আজ সম্পূর্ণ সজাগ থাকা দরকার।

না হলেই বিপদ গ্রাস করবে। যা অতীতেও অনেকবার বাম আন্দোলনের ক্ষতি করেছে।