বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বামফ্রন্ট বিধানসভা নির্বাচনে  পর পর সাতবার সংখ‍্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়লেও গরীব ও নিম্নবিত্ত মানুষের স্বার্থে  মসৃণভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবে অতিবড়ো বামসমর্থকও  এমন আশা করেন নি। আমূল ভূমি সংস্কার, গ্রামে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব‍্যবস্থার মাধ‍্যমে জনজীবনের মানের  উন্নয়ন  ,উচ্চমাধ‍্যমিক স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ‍্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রভৃতি সাফল‍্যের কারণে    গ্রাম বাংলার বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থনের ভিত্তিতে সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্ট নির্বাচনে সফল হয়েছিল। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই হতদরিদ্র অংশের মানুষও বামপন্থী জনপ্রতিনিধি হিসাবে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এলাকার রাস্তা,জলসরবরাহ, বিদ‍্যুতায়নের উন্নয়নের পরিচল্পনা রূপায়ণ করেছিলেন। বলাবহুল‍্য কায়েমীস্বার্থের পক্ষে রাজনীতি করা নেতা নেত্রীদের এই পরিবর্তন মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রথমে রাজনৈতিক সংঘাত পুরোন জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে সরাসরি ক্ষুদ্র কৃষক ও খেতমজুরদের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামের কিছু গরীব মানুষ নানা কারণে বঞ্চিত হলে তাদের মধ‍্যে ক্ষোভ দানা বাঁধে। বামফ্রন্ট বিশেষত সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে শোষক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তি এই ক্ষোভকেই কাজে লাগায়। সত্তরের দশকে পাড়ায় পাড়ায় যে লুম্পেন মস্তানবাহিনী পার্টিকর্মীদের খুন করেছিল, বামসমর্থকদের বাড়িছাড়া করেছিল -তারাও নৈরাজ্য ফিরিয়ে আনার সুযোগ খুঁজছিল। সিপিআই(এম) এর সমর্থনের ভিত্তিতে আঘাত করে  বামফ্রন্ট সরকার কে উৎখাত করার চক্রান্তে এই লুম্পেনদেরও সামিল করা হয়। এই চক্রান্তকে সফল করার জন‍্য একটি রাজনৈতিক মুখের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল এমন নেতা বা নেত্রীর, জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এবং  প্রতারণা করতে যার এতটুকু বিবেকদংশন হবে না।

১৯৯০ সালের পর পর্যায়ক্রমে  চারটি ঘটনা ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর রেখাপাত করেছিল। ১৯৯১ সালের ২১শে মে তামিলনাড়ুতে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার করতে গিয়ে শ্রীপেরামবুদুরে  বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থীদের হাতে কংগ্রেস সভাপতি ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী   রাজীব গান্ধী নিহত হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর  পর লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ‍্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে কংগ্রেস জয়ী হলে  প্রধানমন্ত্রী হন  পি ভি নরসিমা রাও এবং তাঁর মন্ত্রীসভায়  দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মমতা  ব‍্যানার্জী ক্রীড়া ও যুবকল‍্যাণ দপ্তর এবং নারী ও শিশুকল‍্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী হিসাবে যুক্ত হন। ১৯৯১ সালের ২৪শে জুলাই পেশ করা  নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংয়ের প্রথম বাজেটেই সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক থাকা ভারতীয়  অর্থনীতি মূলগতভাবে পরিবর্তিত হয়ে  উদার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হওয়া শুরু করে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ, ঢালাওভাবে দেশি বিদেশি কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ভারতের বাজারে  বাণিজ্য বিস্তারের  সুযোগ করে দেওয়ার নীতি প্রবর্তিত হয়। ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিপর্যয় ঘটেছে। তার আঁচ পড়েছ ভারতেও। দক্ষিণ পন্থী রাজনৈতিক শক্তি বিশেষত  সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি এদেশে  মাথাচাড়া দেয়,যার ফল স্বরূপ ১৯৯২ সালের ৬ ই ডিসেম্বর ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা লালকৃষ্ণ আদবিনির নেতৃত্বে  উত্তরপ্রদেশের অযোধ‍্যায় রামজন্মভূমিতে রামমন্দির গড়ার শ্লোগান তুলে  বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের আধিপত‍্যকামী প্রচার শুরু করা হয়। এই পরিস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় উসকানি মূলক বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছিলেন। ঘটনার দু দিন আগে পর্যন্ত  পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন  মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসু সহ সর্বভারতীয় বামপন্থী নেতা নেত্রীদের বাবরি মসজিদ ভেঙে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করার চক্রান্তের বিষয়ে বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টাকে মমতা ব‍্যানার্জী ” সিপিএমের গুজব ছড়ানোর রাজনীতি ” বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে জনৈক বিশিষ্ট সাংবাদিকের সম্পাদনায়  কলকাতা থেকে প্রকাশিত  বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র মমতা ব‍্যানার্জীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু  জ‍্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার তৎপরতার সঙ্গে এই লাজ‍্যে সাম্প্রদায়িক প্ররোচনার মোকাবিলা করেছিল। যদিও সারা ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর থেকে বিজেপি আর এস এসের মদতপুষ্ট অন‍্যান‍্য সংগঠনের সাহায্যে  হিন্দুত্বের আড়ালে  উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার শুরু করে বিশেষত উত্তর ভারত এবং মহারাষ্ট্রে মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার শুরু করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা   ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ার কারণে বিজেপি এই রাজ‍্যে তখনও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ঠিকই কিন্তু  সংঘ পরিবার কংগ্রেসী মন্ত্রীসভার সদস‍্যা হওয়া সত্ত্বেও  মমতা ব‍্যানার্জীকে ব‍্যবহার করা শুরু করেছে তা বোঝা গিয়েছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পরে বিজেপির বিরুদ্ধে কোন বিবৃতি না দেওয়ার সময়েই। ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই মমতা ব‍্যানার্জীর নেতৃত্বে  যুব কংগ্রেসের  মহাকরণ অভিযানের নামে কলকাতা মহানগরীতে যে  তাণ্ডব  চালানো হয়েছিল তখনই বামবিরোধী রাজনীতির গতিপথে পেশিশক্তি ও আদর্শবিহীন সুবিধাবাদের ছাপ পড়ছে বোঝা যাচ্ছিল। ১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনের  কংগ্রেসের আসন সংখ্যা বিজেপির তুলনায় হ্রাস পেয়েছিল । পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কোনও আসনে না জিতলেও ৬.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।  মমতা ব্যানার্জি কর্তব্য স্থির করতে দেরি করেন নি। জাতীয় রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়তে থাকা, সাম্প্রদায়িক শক্তির জনসমর্থন বৃদ্ধি এবং কেন্দ্রে সরকার গঠনে আঞ্চলিক দলগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে আর এস এসের সাহায্যে ১৯৯৮ সালের ১ লা জানুয়ারী  পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সংগঠন ভেঙে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করেন এবং সেই বছর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূল কংগ্রেস ৭ টি আসনে জয়ী হয়। প্রাপ্ত ভোট শতাংশ ২৪.৪%। কংগ্রেস পেয়েছিল ১৫.২ শতাংশ ভোট এবং বিজেপি ১০.২ শতাংশ ভোট। তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনে দমদম লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী তপন শিকদার (এখন প্রয়াত)জয়ী হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনিই প্রথম বিজেপির নির্বাচিত সাংসদ। লালকৃষ্ণ আদবানির সাহায্যে নতুন দল গঠনের পর অতি দ্রুত মমতা ব‍্যানার্জীর আঁকা ঘাসফুলের ছবি নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে পেয়ে যায় তৃণমূল কংগ্রেস। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেই  পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোট ১০টি আসন পেয়েছিল  তৃণমূল। যার মধ‍্যে বিজেপির আসন ছিল দুটি। পুরস্কার মিলল হাতেনাতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এন ডি এ  মন্ত্রীসভায় কয়লামন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছিলেন মমতা ব‍্যানার্জী। ২০০১ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্ণাণ্ডেজের বিরুদ্ধে কফিন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠায় দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করার যুক্তি দেখিয়ে মমতা ব‍্যানার্জী পদত‍্যাগ করেন এবং কি আশ্চর্য পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটে লড়েন। আসন  সংখ্যার বিচারে সেই প্রথম তৃণমূল কংগ্রেস কংগ্রেসের থেকে এগিয়ে যায়।৬০টি আসন পেয়ে তারা প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে উঠে আসে,! পিছিয়ে যায় কংগ্রেস ;তাদের হাতে আসে ২৬ টি আসন। বিজেপির ভোট শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৫.০২ %। এই ফলাফল দেখেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি তথা এনডিএ র মাথায় থাকা অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আদবানি বুঝেছিলেন  তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে  তাঁদের দলকে পরোক্ষভাবে  একধাপ এগিয়ে দিয়েছে,কারণ তিন বছরের ভধ‍্যেই পশ্চিমবঙ্গের এককালের শাসকদল কংগ্রেস তাদের জনসমর্থন হারিয়েছে।  মমতা ব‍্যানার্জী এরপরে আরও একবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিস্মিত করে লালকৃষ্ণ আদবানি ও  জর্জ ফার্ণাণ্ডেজের সঙ্গে    ২০০২ সাল জুড়েই দরদস্তুর করলেন   বিজেপি নেতৃত্বাধীন এন ডি এতে ফেরা না ফেরা নিয়ে। কিন্তু ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি- মার্চমাসে  গুজরাটে তদানীন্তন মুখ‍্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তত্ত্বাবধানে ঘটে যাওয়া সংখ‍্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নারকীরা হত‍্যাকাণ্ড-যা বিশ্বের সামনে ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল – এই ঘটনার সমালোচনা করে মমতা ব‍্যানার্জী কোন বিবৃতি দেন নি। বরং সেসময় সাংবাদিকরা বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর নীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে মমতা ব‍্যানার্জী প্রসঙ্গটি হয় এড়িয়ে যেতেন, নয়ত বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করতেন। এমনকি গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে আনা এনডিএ বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষেও তাঁর পার্টির সাংসদরা ভোট দেন নি। স্বভাবতই ২০০৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত  অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রীসভায় মমতা ব‍্যানার্জীকে খনি মন্ত্রী হিসাবে দেখে কেউ বিশেষ চমকে যান নি। সেসময়েই বোঝা গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে উত্তরভারতের মত উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা যাবে না বলেই আর এস এস তৃণমূল কংগ্রেসকে দিয়ে নরম হিন্দুত্বের প্রচার করার পরিকল্পনা করেছে।

বামফ্রন্ট সরকার ও সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে আর এস এস ও বৃহৎ কর্পোরেট প্রভুদের ষড়যন্ত্রের  সবচেয়ে নির্ভরযোগ‍্য শরিক হিসাবে মমতা ব‍্যানার্জির উত্থানের অন‍্যতম প্রধান যোগ‍্যতা ছিল তাঁর যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখলের লিপ্সা এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গরীব মানুষদের একাংশের অভাব অভিযোগকে সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিতদের রাজনৈতিক প্রতিবাদে রূপান্তরিত করে বামফ্রন্ট সরকারের সমর্থনভূমিতে ফাটল ধরানোর কাজে সফল হওয়া। বিরোধী পক্ষের আন্দোলন বলতে মমতা ব‍্যানার্জী বুঝতেন বিভিন্ন এলাকাকে উচ্ছৃঙ্খল হিংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ‍্যমে উত্তপ্ত করে তোলা। ২০০১ সাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্ররোচনায়  দুই চব্বিশ পরগণা নদীয়া  আজকের পশ্চিম মেদিনীপুর,বীরভূম জেলায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ শুরু হয় গ্রামের গরীব মানুষদের মধ‍্যে। নিঃসন্দেহে সেই সময় স্থানীয় স্তরের প্রশাসনে বামপন্থী জনপ্রতিনিধিদের এবং পার্টি নেতৃত্বের একটি অংশের নেতিবাচক ভূমিকা এই পরিস্থিতি তৈরি করার সহায়ক হয়েছিল। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির দিকে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির সমর্থনের প্রবণতাও রাজ্যকে অশান্ত করে তুলেছিল ।

কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের নগ্ন চেহারা সামনে আসে ২০০৭ সালে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়েই। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছিল,বিশেষত বিধাননগরের সেক্টর ফাইভে তথ‍্য প্রযুক্তি শিল্পের বিস্তার দেশে বিদেশে উত্সাহ সৃষ্টি করেছিল । সম্ভাবনা বাড়ছিল ইস্পাত অটোমোবাইল ও পেট্রোকেম ণিল্পে । ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরেই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন (এখন প্রয়াত)এর উদ্যোগে হুগলির সিঙ্গুরে ছোট মোটরগাড়ির কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল। রাজ্য সরকারের অধিগৃহীত জমিতে বেসরকারি কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বিরাট সংখ্যক মানুষ বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উত্সাহ জাগালেও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পরিকল্পনা অন্য রকম ছিল। একদল স্থানীয় মানুষকে অনিচ্ছুক কৃষক সাজিয়ে প্রকল্পের এলাকায়  অশান্তি শুরু করানো হয় । এর রাশ তুলে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস ,সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয় নকশালপন্থীদের একটি অংশ এবং সমাজকর্মী র মুখোশ কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ। খুন অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতামূলক কার্যকলাপও বাদ থাকে না । অবস্থান অনশনের নাটক সংবাদ শিরোনামে আসতে থাকে । ফলত কারখানার আশি শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার পরেও কারখানার মালিকপক্ষ প্রকল্প ছেড়ে চলে যান। সন্দেহ করা.হয়, বৃহত্ অটোমোবাইল শিল্পপতিদের কেউ কেউ এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিলেন। যাঁরা একটি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিকের কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যত প্রজন্মকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। রাজ্যের তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীর ভূমিকাও এই সময়েই অশান্তিতে মদত দিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট কার্যকরী ছিল।  পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে ভারত সরকারের সহযোগিতায় পেট্রোকেমিক্যালের প্রকল্প শুরুর আগেই বাতিল করে দিতে হয়” জমি কেড়ে নেওয়া”র গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে। “কৃষিজমিতে কারখানা করা যাবে না ” – এই শ্লোগান যে নেহাতই রাজনৈতিক সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে তোলা তা প্রমাণিত হয় ২০০৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি নন্দীগ্রাম ব্লকের কোথাও কোনও জমি অধিগ্রহণ করা হবে না হেড়িয়াতে জনসভায় মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরেও ১৪ ই মার্চ পরিকল্পিতভাবেই অশান্তি শুরু হয়েছিল নন্দীগ্রামে। তথাকথিত ভূমিরক্ষা কমিটির আড়াল থেকে তৃণমূল কংগ্রেস ও মাওবাদীদের যৌথ ষড়যন্ত্রে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ,যার ফলশ্রুতি শালবনীতে ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করে ফেরার পথে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ওপর মাওবাদীদের প্রাণঘাতী হামলা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয় বটে কিন্তু নৈরাজ্যবাদী ধ্বংসাত্মক রাজনীতি ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করে। পুলিশ প্রশাসনের একাংশের মদতে তৃণমূল কংগ্রেস এবং নকশালপন্থীদের কিছু গোষ্ঠী গ্রামবাংলায় সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করছিল রাজনৈতিকভাবে যার মোকাবিলা করা সিপিআই (এম) এর পক্ষে ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছিল। ঘোষিত প্রগতিশীল অবস্থানের কিছু কবি সাহিত্যিক, শিল্পী এই সময় তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকে রূপান্তরিত হন এবং এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতেই চিটফাণ্ডের টাকায় রাতারাতি গজিয়ে ওঠে কিছু খবরের কাগজ ও টেলিভিশন চ্যানেল যা সিপিআই (এম) এর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করে মমতা ব‍্যানার্জীকে  আগামী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরার কাজ শুরু করেছিল। এই চ্যানেল ও খবরের কাগজগুলোর অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরও স্পষ্ট করে বললে চিটফাণ্ডের মালিকরা আইনের ফাঁদে ধরা পড়লে বন্ধ হয়ে যায়। কি উদ্দেশ্যে এদের ব্যবহার করা হয়েছিল বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ষড়যন্ত্রের সাফল্য ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল জয়েই বোঝা গিয়েছিল। বামফ্রন্টের হাত থেকে চারটি জেলা পরিষদ চলে গেলেও অনেক বেশি সংখ্যক পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়েছিল।  তারপর ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১০ সালের কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের দেওয়ালের লিখন স্পষ্ট হয়ে যায়।