বিজেপিকে ধাক্কা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি কাজে লাগানো যাবে?

                            চয়ন ভট্টাচার্য

রাষ্ট্র কাঠামোর ওপর আধিপত্য কায়েম করতে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে প্রতিমুহূর্তে চ‍্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি দেশের  অর্থনৈতিক দুর্দশাকে চাপা দিতে যেভাবে একতরফা উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে,তা এক কথায় নজিরবিহীন। এই প্রথম কোন শিল্পপতির আর্থিক কেলেঙ্কারিকে রাজনৈতিক বৈধতা দিতে সংসদে বিতর্ক আলোচনার পরিসর সঙ্কুচিত করতে রাষ্ট্র পক্ষের সাংসদেরা বাজেট অধিবেশনের দিনগুলো কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীর বক্তব্যের প্রতিবাদের নামে হৈ চৈ করে পণ্ড করতে ব‍্যস্ত রইলেন। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে দেশের অন‍্যতম প্রধান শিল্পপতি হয়ে ওঠা গৌতম আদানি নিজেও কি ভারতীয় জনতা পার্টির কাছ থেকে এতটা খোলামেলা সমর্থন আশা করেছিলেন? বোধহয় না! বরং গৌতম আদানি যখন হিণ্ডেনবার্গ রিপোর্টে শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগে উত্তাল হওয়া ভারতীয় মিডিয়াকে প্রতিবাদের সুরে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক বিদেশি সংস্থা চায়না কোন ভারতীয় শিল্প সংস্থার উত্থান ঘটুক! তখন তাঁর বক্তব্যে নরেন্দ্র মোদি -অমিত শাহ দের উগ্রজাতীয়তাবাদের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। অর্থাৎ ঘুরিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সমর্থন করাকে দেশদ্রোহিতা বলে চিহ্নিত করতে চাইছিলেন গৌতম আদানি।একেই বলে কৃতজ্ঞতা। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ‍্যমন্ত্রী না হলে গৌতম আদানি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ‍্যের বিস্তার ঘটাতে পারতেন কিনা সন্দেহ। আদানি তাঁর বর্ষীয়ান রাজনৈতিক সহযোগীর মতোই ব‍্যবসার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ মেশাতে অভ‍্যস্ত। নরেন্দ্র মোদি যেমন ভারতে গণতান্ত্রিক পরিসর বিজেপি বিরোধীদের জন‍্য সঙ্কুচিত হয়ে আসার প্রসঙ্গ তোলা দেশদ্রোহিতা মনে করেন, গৌতম আদানিও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলাকে দেশদ্রোহিতা মনে করেন।

নিঃসন্দেহে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতার অভাব নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপির অগ্রগতির পথ অনেকটাই মসৃণ করে দিয়েছে। অথচ অর্থনীতির বেহাল দশা, মুদ্রাস্ফীতি, ধনী দরিদ্রের মধ‍্যে আর্থসামাজিক বৈষম‍্য বৃদ্ধির সমস‍্যা, রান্নার গ‍্যাস সহ নিত‍্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল‍্যবৃদ্ধির প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে ব‍্যর্থ নরেন্দ্র মোদি সরকার। বিজেপি যতই বলুক এখন ভারত পৃথিবীর অন‍্যতম সেরা অর্থনৈতিক শক্তির দাবিদার, জনগণের অভিজ্ঞতা অন‍্যকথা বলছে। এমন পরিস্থিতিতে বহুজন সমাজ পার্টি, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নেত্রীদের উচ্চাকাঙ্খা ও বাস্তববোধহীন রাজনীতি জাতীয় ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে দুর্বল করে বিজেপির হাত শক্ত করছে। বামপন্থী ও কংগ্রেসের প্রভাব যাতে না বাড়ে সে জন‍্য বিজেপি ভারতের পূর্ব, উত্তর পূর্ব এবং উত্তর ভারতে ভাষা, জাতপাতের বিভাজন কায়েম রাখার জন‍্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে  মেঘালয়ে কনরাড সাংমার ন‍্যাশানালিস্ট পিপলস পার্টিকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দল হিসাবে চিহ্নিত করেও ভোটের ফল বেরোনোর পর সেই রাজনৈতিক দলকেই সরকার গঠন করার জন‍্য মাত্র দু জন বিধায়ক নিয়ে সমর্থন জানাতে শিলং পৌঁছে গেলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি।  সরকারে বিজেপির অংশীদারী মানেই তো সেখানকার রাজনীতিতে অন‍্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে অস্তিত্ব বজায় রাখা। এভাবেই পূর্ব মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে বিজেপিতে ঠেলে পাঠিয়ে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নরম হিন্দুত্বের তাস খেলে সফল হয়েছে। মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী নন্দীগ্রামে নিজের পরাজয় হজম করেছেন হাসিমুখে কারণ তাঁর এবং নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহের পরিকল্পনা অনুযায়ী  বামপন্থীদের বিধানসভার বাইরে রাখা গেছে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে এবং ২০২১ এর নির্বাচনে যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের তাস খেলা হয়েছে তা স্বাধীনতার পর এই রাজ‍্যের রাজনীতিতে একেবারেই অভূতপূর্ব ঘটনা। শিক্ষক নিয়োগে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুল  দুর্নীতি সামনে আসার কারণে এবং স্বচ্ছ নিয়োগ, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন, পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র যুব সংগঠন সহ বামপন্থীদের  সংগঠিত আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় শাসকদল বেশ ব‍্যাকফুটে। অন্তর্দ্বন্দ্বে জীর্ণ বিজেপির পক্ষে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে উত্তর চব্বিশ পরগণায় সি এ এ নিয়ে মাঝে মাঝে জিগির তোলা এবং উত্তরবঙ্গে পৃথক রাজ‍্যের দাবিকে জিইয়ে রাখার বাইরে বিভাজনের তাস খেলা সম্ভব হচ্ছে না। ডি এ নিয়ে সরকারি কর্মচারিদের ক্ষোভের ফয়দা বিজেপি নেওয়ার চেষ্টা করলেও শুভেন্দু অধিকারী,সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, দিলীপ ঘোষ তিনজনেই জানেন আন্দোলনের রাশ বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ কর্মচারী সংগঠনের হাতে। ফলে সাগরদিঘীর উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর জয় আগামীদিনের জন‍্য শুধু তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে নয় বিজেপির কাছেও অশনি সংকেত।

বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর রুটি রুজির আন্দোলনকে  শক্তিশালী করার ওপর নির্ভর করছে বিজেপির উগ্রজাতীয়তাবাদী ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে ঠিক কতটা জোরালো চ‍্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। কারণ মহারাষ্ট্রে কৃষক আন্দোলনের বিপুল সাফল‍্য এবং উত্তর প্রদেশে বিদ‍্যুৎশিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বিদ‍্যুৎকর্মীদের ধর্মঘটের ওপর যোগী আদিত‍্যনাথের সরকারের নিপীড়নের নীতি (এই লেখার সময় পর্যন্ত ১৩৩২ জন ধর্মঘটি বিদ‍্যুৎ কর্মী ছাঁটাই হয়েছেন) এবং ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারী কর্মীদের আরও জোরালো হওয়া প্রতিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে শক্তিশালী করার সুযোগ নিয়ে এসেছে। ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ধাক্কা দেওয়ার জন‍্য অনুকূল রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরি করতে হবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে।