সাদা ও কালোর মাঝে অনেক স্তর আছে। যার চোখ যত উন্নত, বিস্তর ফারাক তত দৃশ্যমান। শিক্ষা দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে। ম্যাঙ্গো জনতার কাছে বিষয়টি যত সাদা ও কালোর মধ্যে সীমাবদ্ধ, শাসকদের ততটা সুবিধা। যেমন মনে করুন, শিক্ষকের পদে অপ্রত্যাশিত চাকরি পেয়ে নতুন শিক্ষক খুশীতে জমি, গয়না বেচে এজেন্টদের মাধ্যমে জগদ্গুরুর প্রেয়সী জগদম্বার খাটের তলে টাকার বান্ডিল অঞ্জলি দিয়েছে। ইনি দুধ সাদা ব্যক্তি। সমাজে কালো ব্যক্তিও আছেন, যাঁরা বলছেন, দূর্নীতিগ্রস্ত মহাসচিবকে ঘুষের বিনিময়ে প্রতারকটি মেধাবীদের বঞ্চিত করেছে। শিক্ষা ও চেতনার স্তর অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্নতর দৃষ্টিকোণে বিচার করছে। ব্যালট বাক্সে রংবাহারী বোতাম নেই। সেখানে কেবল উপহারের সাদা বোতামের সাথে দুর্নীতির কালো বোতাম আছে। শেষ গ্রামীণ ভোটে ৫১% মানুষ সাদা বোতাম ছুঁয়েছেন। তাহলে ৪৯% কালো ভোটারও আছে। বিপজ্জনক। এই কালো ভোটার, যারা দুর্নীতিকে অন্যায় মনে করেন, তাদের বিভিন্ন বাক্সে আলাদা রাখতে পারলে উপহার গ্রহীতা কাঁসর বাদিকা মান্নিয়া মাতা জগদম্বা বিপদমুক্ত।

সেই সুযোগ দুর্দমনীয় বামফ্রন্টও পেয়েছে। ২০০৬ সালে ৫০%এর খানিকটা কম ভোট পেয়েও বিরোধী ভোটের বাক্স আলাদা ছিল। তৃণমূল এবং বিজেপির জোট পেয়েছিল ২৬.৬৪%, কংগ্রেস পায় ১৪.৭১%। তথাকথিত কিছু বাম-ভোট এস.ইউ.সি.আই, অতি বামেদের নর্দমা দিয়ে খালাস হয়ে যায়। ধরে নিতে হবে মানুষ শিল্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে শিল্প হয়নি। তাহলে ২০২২এ মানুষ যদি দুর্নীতির পক্ষে ভোট দিয়ে থাকে, তাহলে কি দুর্নীতি বরণের পক্ষে মতামত? মনে হয় না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যালটের বোতাম খেলা চিনেছিলেন। ২০১১তে বিজেপিকে সরিয়ে কংগ্রেসের সাথে জোট করতে ৪৮% হয়ে গেল। বিজেপি(৪.০৭%), তথাকথিত বাম, অতিবামে গোপন ধ্বসের ষড়যন্ত্রে ছিল। ফলতঃ ক্ষমতা বদলের হাতিয়ার পেয়ে গেল। বিরোধীদের সর্বাত্মক আক্রমণ করার সাহস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল। ২০১১তে যে বিজেপি ৪.০৭% ছিল, ২০১৯এ বিজেপিকে মমতা ও নরেন্দ্র মোদী ৪০.০৭%এ নিয়ে এলেন। কিন্তু মমতা যে সর্বাত্মক আক্রমণের সাহস দেখাতে পেরেছিলেন দুর্বল নরেন্দ্র মোদীর তা নেই।

সামনে বিষধর সাপ, আপনার হাতে লাঠি। আপনি ভয়ে নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন বা লাঠি দিয়ে সাপ মারতে পারেন। লাঠি ভাঙলে কিন্তু সাপ ছোবল মারতে ভুল করবে না। এই লাঠি দিয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিতে যে সাহস ও হিম্মৎ লাগে ব্যক্তি হিসাবে মমতার থাকলেও নরেন মোদীর নেই। মনে রাখবেন, তৃণমূলের সুপ্রিমো মমতা ও বিজেপির অধিপতি নরেন মোদীর পুরো আলাদা এনটিটি বা পরিচয়। ব্যক্তি মানুষের ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা ভিন্ন হতে পারে। বিশ্বমানের ফুটবলার অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের জার্সিতে বিশ্বকাপ স্পর্শ করতে পারেননি। যেমন রোনাল্ডো বা মোহম্মদ সালাহ মত অনেকে। মহুয়া মৈত্রর বহিষ্কারের বিষয়টি সামনে রেখে জোটসঙ্গীরা বিরোধী বাক্স বড় করার লোভ সামলাতে পারছে না। সাদাদের ধারণা গৌতম আদানির বিপুল সহায়তা প্রাপ্তি অনৈতিক। তাজপুর বা দেউচা পঁচামিতে বিনিয়োগের সময় ভিন্ন মমতারও তাই অভিমত। কালোদের বক্তব্য, প্রশ্নগুলো হিরানন্দানির সাথে বিভিন্ন অর্থে সখ্যতা ও পাসওয়ার্ড বিনিময়ের মাধ্যমে কেন করতে বাধ্য হবেন শিকারি সাংসদ?

এবার দেখুন, চাকরি দুর্নীতির সাদা-কালোর মত বিষয়টি সহজ নয়। প্রতিটি হতদরিদ্র মানুষ চায়, তার বড়লোক বন্ধু থাকুক। যখন জবকার্ডের অধিকারী নিঃস্ব মানুষগুলোর জন্য মহুয়া কাঁদেন, তখন তাদের চোখেও জল এসে যায়। আবার যখন শোনেন, মহুয়াদির মত মানুষের বন্ধুদের সম্পদের বিচারে বিশিষ্ট শিল্পপতি হিরানন্দানি তুচ্ছ, এমনকি তিনি নিজেও জমিদার বংশের প্রতিনিধি তখন হাভাতেরা তাঁর সানগ্লাস, ভ্যানিটিব্যাগ, জুতো, মোবাইল, বিদেশ যাত্রার জন্য সহযোগিতা করতে উন্মুখ, সেটাই সাদা মানুষদের চরিত্র। এই সাদা মানুষদের চরিত্রের কথা মাথায় রেখে মমতা লোকসভা নির্বাচনে টিকিট দেবেন। কালো মানুষরা কোন প্রশ্ন করলে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ বলে এড়িয়ে যান। কালো মানুষদের মস্ত সমস্যা আজ সাদা মানুষদের বস্ত্রহরণ করলেও আগামীকাল কালো মানুষদের অন্তর্বাস হরণ হয়ে যেতে পারে। আজ বিশ্ববাংলায় দুর্নীতির তদন্তের শ্রাদ্ধ করে গঙ্গারতি করলে আগামীকাল নরেন মোদীর দুর্নীতির তদন্তে সেই ঘাটে বিসর্জন হয়ে যেতে পারে। অপরাধের ব্যবসায়ী সুবিচার দিতে পারবেন না।

তদন্ত বামপন্হীরা মনে প্রাণে চাইছেন, বিচার ব্যবস্হা চাইছে, কালো ভোটারদের অনেকে চাইছেন এমনকি কতিপয় বিজেপি ক্যারিওকর্তাও চাইছেন। কিন্তু সেই ক্যারিওকর্তারা জানেন, মোদীর দরবারে সেই দাবী পৌঁছে দিলে মালিক এক কথায় কোতল করে দেবেন। পদ্ধতিটাও খুব সহজ। পথের ধারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবেন। লুঙ্গি পরা একজন কষিয়ে পেছনে লাথি মেরে কচুবনে ফেলে দেবেন। ভয় প্রকাশ করে নেতা উঠে দাঁড়িয়ে তৃণমূল হয়ে যাবেন। আমাকে আমার মত থাকতে দাও। মমতা-মোদীর পার্টি থেকে আরেক পার্টিতে যেতে ভিসাও লাগে না। সকালে তৃণমূলের দপ্তরে ব্রেকফাস্ট করে দুপুরে পদ্মপাতায় ভেজ লাঞ্চ, সন্ধ্যার মুখে কেএফসি চিকেনের সাথে কফি। আবার রাতে তৃণমূলে ফিরে কচি পাঁঠার হালকা ঝোল। এখানে আরেকটি চরিত্র নেপো। নরেন্দ্র মোদী কখনই সর্বস্ব বাজী রেখে মমতার সাথে সঙ্ঘর্ষে যাবেন না, পাছে নেপোয় দই মেরে দেয়। অযোধ্যার রাম মন্দির বনাম দিঘার জগন্নাথ মন্দির বাইনারি অনেক ভাল। দিদি-দাদার মন্দির-মসজিদের রাজনীতিতে নেপো পা রাখতে পারবে না।

কালো আর সাদার বাক্সে মোদী-মমতা ভাগবাটোয়ারা করে জনতাকে রাখবেন। একশ দিনের কাজের টাকা নরেন্দ্র মোদী দিচ্ছেন না। খুব ভাল কথা। মাসোহারার কপিল সিব্বাল বা মনু সিঙ্ঘভিরা রাজ্যের যে কোন ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টে হাজির হলেও এই ব্যাপারে যাচ্ছেন না। তাহলেই তো নরেন্দ্র মোদীর মুখোশ খুলে দিতে পারতেন। নরেন্দ্র মোদী যেমন মমতার মুখোশ খুলতে চাইছেন না, তেমনই মমতাও মোদী-ভাইয়ের মুখোশে যত্নশীল। যারা ভগবান ও ভূতে বিশ্বাসী নন, তারাও কিছু অলৌকিক প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইডেনে, ইন্ডোরে, টলি নায়িকাদের অন্দরে, বইমেলার কন্দরে, কাঁসরে, সাঁওতাল পরবে ভাদুর বাসরে নেচে কখনও পা ভাঙেননি। নির্বাচন আসলেই কেন পা ভাঙে? এই ভাঙা পা কাজে লাগিয়ে মিডিয়া ভোটারদের বাক্সের ব্যালেন্স বজায় রাখে। নেপোর চৌকিদার বিজ্ঞাপনী মিডিয়ার পিসি-হাসি। মোদী মাঙ্কি-বাত ঝাড়েন, কিন্তু অমিত শাহকে বলেন না, নির্বাচনের তিন মাসের মধ্যে দোষীদের কারাগারে পাঠাবার প্রতিশ্রুতির জবাবটা বিশ্ববঙ্গে বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চা বাগানে গিয়ে চায়ের পাতা তোলেন, তিনি ছাব্বিশ দিনের বার্গার, ফ্রাই অনশন করেছেন। কিন্তু কোন দিন চাকরিহারাদের অবস্হান মঞ্চে পৌঁছাবেন না। সমস্যাটা দীর্ঘ দশ বছরের। আন্দোলনকারীরাও মান্নিয়া- মান্নিয়া- বলে কেঁদে আত্মহারা। যেমন শ্রীচৈতণ্য কৃষ্ণনামে বিভোর ছিলেন। তাই তারাও অনায়াসে প্যালেস্তাইন মুক্তির আন্দোলনের পর দীর্ঘতম আন্দোলনের শরিক হতে পারছে। তারা যদি পায়ের থেকে চটিটা খুলত, তাহলে চটিচাটারা ইঁদুরের গর্তে গিয়ে আশ্রয় নিত। মোদীও বেহদিশ হয়ে যেতেন। কিন্তু ওরা নিয়ম করে রাস্তায় দন্ডী কাটে, পুলিশ ভ্যানে উঠে বাইট দেয়, কিন্তু কৃষ্ণনাম মুখ থেকে সরে না। মান্নিয়া… মান্নিয়া… ডাক। নেহাৎ আদালত ও বামপন্হী আইনজীবীরা আছেন, তাই শো এখনও চালু আছে। এত বড় দুর্নীতি, নরেন্দ্র মোদী বাচ্চাদের যাদু দেখাতে পারেন, কিন্তু ভোটারদের চাঁদু সময় করে একবারও অবস্হান মঞ্চে আসতে পারেন না। আপনি যদি কথা দেন, ব্যাপম নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না, তাহলেও আসবেন না। কুমীর পোষার গল্প সহজ, কাজে সাহস লাগে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদী জানেন বিশ্ববঙ্গে এই বাইনারিটা ধরে রাখতে পারলেই পূর্ণমান পেয়ে যাবেন। সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতের সমস্যার ছেঁড়া শতরঞ্জি বিশ্ববঙ্গের উঠোনে বিছিয়ে দিলে সেই ফুটো দিয়ে সাদা আর কালোর বাক্স ভরে ফেলবে মিডিয়া। সাদাবাবুরা দুর্নীতি করবে, সেই দুর্নীতির পাশে মমতা ও নবান্ন থাকবে এবং সিবিআই আর ইডির জনসন অ্যান্ড জনসনরা কালীঘাটের কাকুর ভোকাল কর্ডের পেছনে এক বছর ধরে ছুটতে থাকবে। নরেন্দ্র মোদীর জীবদ্দশায় কোন তদন্ত শেষ হবে না। এই বটম লাইনটা পড়ে ব্যালটের তৃতীয় বোতামে যেতে হবে, যেটা স্রেফ সাদা নয়, কালো নয়, কেবল ভালো। ১৯৭৭এ মানুষ ভোট দিয়েছিল কংগ্রেসের জরুরী অবস্হার বিরুদ্ধে, ২০১১- বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। এবার ভোট দিতে হবে মোদী ও মমতার যৌথ দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এই খানেই সাদা আর কালো পার্টি “তুই চোর না মুই চোর” করে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করবে। কেউ বলতে পারবে না, আমরা চুরি করিনি। বরঞ্চ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ডায়ালগ- “আমরা সবাই চোর, চোরেদের এই মোদীর রাজত্বে….”

আপনার ভার্চুয়াল ধারণা হতেই পারে, নরেন্দ্র মোদী আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বদা একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক। হবে না কেন? এক জনের সাথে দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ইতিহাস জড়িত, আরেকজন বিধানসভা ভাঙ্গচুর করেছেন, ভোট সন্ত্রাসে ভারত সেরা। তাঁরা দুজনে যখন গোপনে আলোচনা করছেন, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে বেরিয়ে আসার কথা। পান পরাগের একটি বিজ্ঞাপন দেয়, দুজন দুজনকে স্যালুট করে বলেন, দুজনের ভাষা যখন এক… বল ভাষা মাধুরী। সঙ্ঘর্ষের সহস্রতম দিবসে মহিলাদের মাথা ন্যাড়া করে প্রতিবাদকে সৌগত নাটক বললে, প্রকৃত নাটুকে ব্রাত্য বোসদের ছোট করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী নাটকের লোক, তবু ভাল নাটক করছেন কেউ বলতে পারছে না। সৌগতর মূ্র্খ ও অভদ্র আচরণ নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হতেই কালো শুভেন্দুর দল কুস্তির রিংএ উঠে মক্সো করতে শুরু করলেন। ওনাদের উচিৎ ছিল নরেন্দ্র মোদীর কাছা ধরে টেনে এনে তদন্ত শেষ করা। না করে সাদা-কালোর বাইনারি শুরু হল। আসলে চটি খুলে মারা উচিৎ, সাদা-কালো বিচার না করে।

একজন যখন গীতা পাঠ করবেন, আরেকজন চন্ডী। এক জন সরু পথ ধরে পাতলা হলে আরেক জন ধরবেন পাকদন্ডী। বিধানসভায় আম্বেদকার সাহেব হতভম্ব। ওয়ান টু থ্রি ফোর, তৃণমূলের সবাই চোর। পাল্টা শ্লোগান, মোদী চোর- শাহ চোর। মোদীবাবু তো প্রধানমন্ত্রী। যোগ্যতাসম্পন্ন হলে এবং আত্মমর্যাদা থাকলে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তৃণমূল কর্মী ও নেত্রীর হিস্যা সর্বসমক্ষে প্রচারিত- চারআনা খাও আর বারোআনা দাও। মমতা-মোদীর ফয়সালা হয় গোপন বৈঠকে। এমনকি মস্তি শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে কত কেজি খিস্তি পরিবেষিতে হবে, তাও সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। ওই খিস্তির সার ছাড়া বঙ্গভূমিতে গেরুয়া পোকার চাষ হবে না। মমতা বলবেন, অনেক কেঁদে এলাম। আপনি মুশকিলে পড়বেন, সাদা বোতাম না কালো বোতাম। মিডিয়া আলোচনায় বসবে, পাল্লা সাদায় না কালোতে। এবার অন্ততঃ টিভি বন্ধ করে বলুন, দুটোই চোর। এক চোরকে নিয়ে খিল্লি, আরেক চোরের বাড়ি নয়া দিল্লী। পৃথিবীটা আর কেবল সাদা কালো নয়, জীবনে রঙ আনতে ইনসাফে ফিরুন। সাদা-কালো ঘুঁটিকে বরবাদ করে দিন।