এএএ…বুঁধুয়া, কাঁহা যাতানি?

কাম বা।

কাম বা! কৌন কাম বা?

খাদান মা-

আরে, আজ তো খাদান বনধ্ বা!

বনধ্ বা?

হুঁ। কাল বোলাতানি?

বোলা…লেকিন, রামদেও ভাও তো কুছ অলগ হি বোলা থা!

তু রামদেও কি বাত লেকে বৈঠা রহা। ইয়ে রামভাও কা বাত না বা, ইয়ে হাম সবকা বাত বা। ইহাঁ ভাও কা বাতা না চলা, হম সব যোঁ বোলা ওহি হোগা তানি।

মুরদ চাচার কথাটা বুঁধুয়ারও মনের কথা। কিন্তু…একটা অস্থিরতা যেন ক্রমশ গ্রাস করছে বুঁধুয়াকে। বুঁধুয়াও জানে এই লড়াইটা বুঁধুয়াদের নিজস্ব লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। কিন্তু…

বুঝা…আআ? বুঁধুয়াকে প্রশ্ন করে মুরদ চাচা।

বুঝা। চাচা তু তো জানত হ্যায়, ঘরকা হালত?…অবভি মাঈ বাওজীকা রাহা দেখত হ্যায়, অউর রোঁবত হ্যায়। কোয়লাঞ্চল মে রহকার ভাও কে সাথ পাঙ্গা লিয়ে কোন রহ সকতা হ্যায়?

ইয়ে তু বোলাতানি! আপনে বাওজী কো ইঁয়াদ কর বুঁধুয়া…উও আব ভী হাম সবকে দিলো মে বসে হ্যায়-

পর হামারে ঘর মে তো ওহ্ না আবা তানি। চোখটা ছলছল করে উঠল বুঁধুয়ার। বুঁধুয়া জানে, ওর বাবা আর কোনো দিনও ফিরে আসবে না…মা মিছেই অপেক্ষা করছে…কিন্তু এই মিথ্যেটা কিছুতেই ভাঙতে পারে না বুঁধুয়া।

ধানবাদ-ঝরিয়া কয়লাঞ্চলে এভাবেই কত বুঁধুয়া হারিয়ে ফেলেছে তাঁর বাপ-কাকা-দাদাকে। কত মা হারিয়েছেন তাঁর ছেলেকে। কয়লাঞ্চল তাঁর হিসেবও রাখেনি। কত তাজা প্রাণ হটাৎ বাতাসের মতো উবে গেছে…তাঁদের দেহও খুঁজে পায়নি পরিজনেরা। ধীরে ধীরে আবার নতুন করে বাঁচতে শিখেছে শ্রমিকপট্টির মানুষরা। আর শিখেছে, ভয় পেতে। সমস্ত কিছুকে ভয় করে চলাটাই যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শ্রমিকদের জীবনে।যুগ যুগ ধরে বুঁধুয়াদের এই ‘ভয়’এরই ফায়দা তুলে এসেছে রামদেও’রা। তাঁদের পৈশাচিক অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই মেলেনি শ্রমিক পট্টির মেয়েবৌ’দেরও। বুঁধুয়াদের ‘ভয়’কে হাতিয়ার করে রামদেও ভাওরা বছরের পর বছর ধরে শ্রমিকদের মেয়েবৌদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এসেছে। হাত থেকে ফুলে পরিবর্তিত হয়েছে সরকার কিন্তু অত্যাচারের মাত্রা একই রয়ে গিয়েছে। কয়লাঞ্চলের শ্রমিকদের স্বপ্নগুলিতে আজীবনের জন্য যেন কালো রঙ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, ফল্গুর ধারার মতো কয়লাঞ্চলের বুক চিঁড়ে বয়ে গেছে কালো রক্তের ধারা। তবুও পেটের জ্বালায় এখানেই থেকে গেছে বুঁধুয়ারা। ওদের পৃথিবীটা এই কয়লাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কয়লাঞ্চলের বাইরের পৃথিবীটা যে ওদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা একটা পৃথিবী। তাই কয়লার এই কালি গায়ে মেখে, সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে ওরা ঘরে ফেরে ভয়কে বুকে নিয়ে। ভয়কে নিয়ে ওরা বাঁচতে শিখে গেছে।

কিন্তু বুঁধুয়ার বাবা শিখতে পারেনি। তাই সে প্রতিবাদ করেছিল। তুলে নিয়ে ছিল লাল ঝান্ডা। শ্রমিকদের মুখে ভাষা তুলে দিতে চেয়েছিল। সে ভাষা ছিল প্রতিবাদের ভাষা, সে ভাষা ছিল লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলনের ভাষা…সে ভাষা ছিল গোটা দুনিয়ার মজদুরদের এক হওয়ার ভাষা…সমস্ত শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তির ভাষা।

বুঁধুয়ার বাবাদের এই সাহসী লড়াইয়ের সাথী হচ্ছিল গোটা কয়লাঞ্চলের শ্রমিকরা। যে লড়াইটা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে মুরদ চাচারা।

গোটা পৃথিবীজুড়ে একদিন ঘনিয়ে এলো এক মহামারী। করোনা। ত্রাহি ত্রাহি রব পরে গেল সর্বত্র। শুরু হলো লকডাউন। প্রধানমন্ত্রী ভাষণে বললেন, সবাই ঘরে থাকুন…সেভ থাকুন…খাবার আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে…বাড়িতে বসেই মাইনা পাবেন…আমার উপর, আমার সরকারের উপর ভরসা রাখুন, বিশ্বাস করুন। প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে  পরদিন সকালে খাদানমুখে খাটিয়ায় বসে মুরদ চাচারা প্রমোদ গুনেছিল। কেননা মুরদ চাচারা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে যে, এসব কথা হলো ভাঁওতাবাজির কথা। আর মুরদ চাচারা লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই শিক্ষা নিয়েছে যে, সরকারের উপর ভরসা করে নির্ভয়ে থাকা মানেই হলো শ্রমিকদের উপর লাগামহীন বঞ্চনার খাঁড়া নেমে আসা।

লকডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল। কয়লাঞ্চলের শ্রমিকরা তখন দিশেহারা। প্রাথমিক ধাক্কায় কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিল রামদেও ভাও’রাও। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সরকারি সাহায্য আসতে শুরু করতেই আবার চেনা ছন্দ ফিরে পেয়েছিল ভাও’রা। শ্রমিকরা কয়লার কালি গায়ে মেখে পরে রইলো সেই অন্ধকারেই। পা’য়ের তলা থেকে একটু একটু করে মাটি সরতে লাগলো।

লকডাউনকে হাতিয়ার করে সরকার একদিন একচল্লিশটি কয়লাখনিকে বেসরকারী করার কথা ঘোষণা করলো। রামদেও ভাও’রা আনন্দে উল্লাস করে উঠলো। ক্ষোভে ফেটে পড়লো শ্রমিকরা। কয়লাঞ্চলের শ্রমিকরা ডাক দিলো 2-4 জুলাই কয়লা খনি ধর্মঘটের। মুরদ চাচারা লাল ঝান্ডা টাঙিয়ে দিলো খাদান অঞ্চলে। চললো ধর্মঘটের সমর্থনে মিটিং।

বুঁধুয়া দূর থেকে সে মিটিংয়ের সমস্ত কথা শুনেছিল। তারপর বাড়ি ফিরে মাকে বলেছিল, আবার লড়াই শুরু হবে।

মা আতঙ্কের সাথে বলেছিল, আবার!

পরদিন কাজে যাওয়ার পথে বুঁধুয়া দেখেছিল, জিপে করে গেরুয়া ঝান্ডা উঁচিয়ে মাইকে করে বলতে বলতে যাচ্ছে, শুনো শুনো শুনো… ইঁ রামদেও ভাওকা বাত কো আপনি দিমাগ মে ব্যায়ঠালো…কি সভী কো কাম পর রোজ আনা হি পরে গা। সমঝ লো যো না আবে উসকা কামসে ছুট্টি…অউর ইহা গলতি না করনা কি খাদান বনধ্ রহে গা, খাদান তো চলে গা…জরুর চলে গা…

বুঁধুয়াদের মনে বহু দিন ধরে লালিত হওয়া ‘ভয়’টাকে উসকে দেওয়ার জন্য এই ঘোষণাটাই ছিল যথেষ্ট। আগের দিন রাতে মায়ের চোখেমুখে বুঁধুয়া সেই চেনা ভয়টাকেই প্রত্যক্ষ করেছিল। রাতে বুঁধুয়ার স্ত্রী বলেছিল, তুম ইস লড়াই ঝগড়া মে মত রহ। ইসসে হামারা কোয়ি মতলব না। হম সব ছোটে লোগ ক্যায়সে ভাও লোগো সে পঙ্গা লেঙ্গে?

বুঁধুয়া বলেছিল, চুপ রহ। তু না বুঝি। ইয়ে ঝগড়া আগার হম মোড় না লি তো সমঝো কে হম সভী কা পেট পুরা বনধ্…সমঝ লি?

কা জানু। হমে ডর লাগা তানি।

সে রাতে অনেকক্ষণ ধরে আকাশ পাতাল ভেবেছিল বুঁধুয়া। একবার বাবার কথা ভাবছিল আর একবার ভাবছিল মা’র কথা। বাবার জন্য মা’র প্রতিক্ষার কথা। এসব ভাবতে ভাবতেই ক্লান্ত দেহে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ভয়। পরম্পরার পর পরম্পরা বেঁচে রয়েছে এই ভয় নিয়ে। সরকারকে ভয়, সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয়, রামদেও ভাও’দের ভয়…আর ভয় কালো রক্তের। তাই ভয়ে ভয়েই রোজকার মতো চলেছিল খাদানের দিকে। মাঝপথে মুরদ চাচার কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেল বুঁধুয়া। নাঃ। আর না। আর সে ভয় করবে না। সমস্ত ভয়কে এবার সে জয় করতে পেরেছে।

কা হোই? ভৌ-চক্কে খা গায়ে কা? মুরদ চাচার ঝাঁকুনিতে ঘোর কাটলো বুঁধুয়ার।

কলের পুতুলের মতো বুঁধুয়া ফিরে তাকালো মুরদ চাচার দিকে, দৃঢ় কন্ঠে বললো, হাম ভি আপ কে সাথ হ্যায় মুরদ চাচা।

ইঁ হুই না কমরেড বালি বাত। লি পাকড় অপনে লাল ঝান্ডা…ইঁ ঝান্ডা আজ সে তেরা হুয়া।

ঝান্ডাটা হাতে নিতেই আচমকা একটা বিদ্যুত তরঙ্গ যেন বয়ে গেল বুঁধুয়ার শরীর জুড়ে। এক ঝটকায় মনে পরে গেল বাবার কথা…সেই লড়াই সংগ্রামের কথা। খাদানের সমস্ত শূন্যতাকে খানখান করে দিয়ে বুঁধুয়া শ্লোগান তুললো-

ইনকিলাব –

কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা আন্দোলনকারীরা একসাথে জবাব দিলো–

জিন্দাবাদ…