‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে,প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর-আলোক কালে অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন তুষারের মধ্যে যেমন কত শত বন্যা বাঁধা পড়িয়া আছে, তেমনই এই পুস্তাকাগারের মধ্যে মানব-হৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে?’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৃদয় ও মনের ক্ষুন্নিবৃত্তির এমন বিরাট আয়োজন আছে আর কোথায়? তাই লাইব্রেরিই হলো একমাত্র সহস্র চিত্তের তৃপ্তি সরোবর যা অমৃতের সমান। অনন্ত বিশ্বের জ্ঞানরাশি ও ভাবরাশি অফুরন্ত। বিভিন্ন ভাব ও চিন্তার বিষয়ে রচিত হয়েছে কত গ্রন্থসম্ভার। কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে সব গ্রন্থ–সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। লাইব্রেরি হলো মানুষের যৌথ প্রতিষ্ঠান। সেখানে বহু গ্রন্থ–পাঠের সুযোগ মেলে। এবং এখান থেকে আবালবৃদ্ধবণিতা তাদের ইচ্ছেমতো গ্রন্থ সংগ্রহ করে পাঠ করতে পারে।

লাইব্রেরির ইতিহাস অতি প্রাচীন। সভ্যতার আদিম প্রত্যুষেই মানুষের মনে জেগেছিল যে অদম্য জ্ঞান-পিপাসা, সেই তাগিদে শুরু হয় মানুষের একনিষ্ঠ জ্ঞান-চর্চা। ভারতের অতি প্রাচীনকাল থেকে জ্ঞান-চর্চার চিহ্ন বেদের আকারে প্রকাশ পেয়েছিলো। ‘বেদ’ কথার আক্ষরিক অর্থ ‘জ্ঞান’, অন্য অর্থ ‘শ্রুতি’। যখন লেখার অক্ষর আবিষ্কার হয়নি, আবিষ্কৃত হয়নি গ্রন্থ রচনার কলাকৌশল, তখন কেবল মানুষের স্মরণ-শক্তিকেই ভরসা করে চলত জ্ঞান-চর্চা আর তার মুল্যবান আদান-প্রদান । সেদিন শ্রুতিধরেরাই ছিলেন জ্ঞানের উন্নত প্রতিষ্ঠান। শিষ্য-পরম্পরাই সকল জ্ঞান দেশ-দেশান্তরে প্রবাহিত হত। পথের অবর্ণনীয় দুর্বিপাক তুচ্ছ করে পরিব্রাজকের দল ছুটে আসত দেশ-দেশান্তর থেকে জ্ঞান আহরণের জন্য। অতি কষ্টের মুল্যে তাঁদের সংগ্রহ করতে হত মানুষের সভ্যতার আলো। এইভাবেই লাইব্রেরির সৃষ্টি পূর্বে জ্ঞানের ধারা সীমিত হলেও যুগ-যুগান্তরে প্রবাহিত হয়ে যেত। এরপর আবিষ্কৃত হলো অক্ষর। কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে মানুষের মনে অসংখ্য ভাবধারা। রচনা হলো গ্রন্থ। প্রথমে তালপত্রে ও ভুর্জপত্রে হাতে লেখা গ্রন্থ জমতে শুরু করলো। তারপর এলো পশু চর্ম। এরপর প্রাচীন মিশর ”প্যাপিরাস্”-এ জোড়া দিয়ে কাগজ প্রস্তুত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলো করলো। জ্ঞান-সংরক্ষণের পদ্ধতি। সবশেষে চিনদেশে সর্বপ্রথম কাগজ আবিষ্কার করে আধুনিক পদ্ধতিতে রচিত হলো গ্রন্থ। এরপরই বিশ্বের জ্ঞান-ভান্ডারকে বুকে ধারণ করে ঘরের দুয়ারে স্থাপিত হলো লাইব্রেরি।

সর্বপ্রথম লাইব্রেরি স্থাপনের কৃতিত্ব রোম দেশের। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সর্বসাধারণের মধ্যে জ্ঞান বিকিরণের জন্য স্থাপন হয় লাইব্রেরির। এছাড়া ভারতবর্ষ, চিন, তিব্বত, মিশর, ব্যবিলন প্রভৃতি দেশে প্রাচীন লাইব্রেরীর নির্দশন আছে। নালন্দা ও বিক্রমশীলার লাইব্রেরি ছিলো প্রাচীন ভারতে বিখ্যাত।

বারাণসীতে ছিলো বিশাল লাইব্রেরী। বিদ্যোৎসাহী শ্রীহর্ষের ছিলো এক বিপুলাকার লাইব্রেরি। কিন্তু বহিরাগত আক্রমণে ভারতের লাইব্রেরিগুলি বিধ্বস্ত হয় এবং মুল্যবাণ গ্রন্থসম্ভার লেলিহান অগ্নিশিখায় সমর্পিত হয়। নালন্দা ও বিক্রমশীলার বিখ্যাত লাইব্রেরিগুলোও রক্ষা পায়নি। তাই বহিরাগত আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে নালন্দা ও বিক্রমশীলা মহাবিহারের ভিক্ষুকগণ বহুমূল্যবান গ্রন্থ নিয়ে নেপালে ও তিব্বতে চলে যান। নেপালের রাজার লাইব্রেরীতে সেই গ্রন্থগুলি আজও সসস্মানে সংরক্ষিত আছে। প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও সাহিত্য-সাধক প্রমথ চৌধুরীর মতে, “লাইব্রেরি” মধ্যেই আমাদের জাতি মানুষ হবে। সেই জন্য আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা লরব, দেশের তত বেশি উপকার হবে।

দিল্লীতে সম্রাট হুমায়ুনের ছিলো বিখ্যাত লাইব্রেরি। কিন্তু ভারতে আধুনিক লাইব্রেরি সূচিত হয় ইংরেজ আমলে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক স্থানে ইংরেজদের অনুকরণে লাইব্রেরি স্থাপনা হয়। সর্বসাধারণের জন্য স্থাপিত হয় লাইব্রেরিগুলির হল। রাজা রামমোহন লাইব্রেরি, চৈতন্য লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, সংস্কৃতি সাহিত্য পরিষদ, এশিয়াটিক সোসাইটি, বিশ্ব-ভারতী লাইব্রেরি বিখ্যাত। ইংরেজ আমলে স্থাপিত ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি’, স্বাধীন ভারতে ‘ন্যাশানাল লাইব্রেরি’ যা আজ ওয়ারেন হেস্টিংসের বাসভবনে স্থানান্তরিত। সুষ্ঠভাবে লাইব্রেরি পরিচালনা একটি অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কাজ। ভারতের মধ্যে বরোদা লাইব্রেরি পরিচালনায় সমধিক প্রাগ্রসর। সেখানে আছে উন্নত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। গ্রামে গ্রামে পুস্তক লেনদেনের দৃষ্টান্ত সমগ্র ভারতের অনুকরণ যোগ্য। সেখানকার পাঠকরাও অত্যন্ত দায়িত্বশীল। অতীতের কোলে যে মহাপুরুষ ও মনীষীদের কন্ঠ চিরদিনের মতো নীরব হয়ে গিয়েছে গ্রন্থরাজির মাধ্যমে আমরা তাদের আলোকিত সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। সেই জন্য শিক্ষা বিস্তারে অবিলম্বে উদ্যোগী হতে হবে। তার জন্য সমস্ত মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টায় এবং কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে দেশে লাইব্রেরির আরো জাল বিস্তৃত হওয়া উচিত, তাতে যাতে বাঁধা পড়ে গ্রাম ও শহর।