গত১৪ই অক্টোবর ভোর থেকে কলকাতা মহানগরীর ব‍ৌবাজারের   ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর  টানেলের ভেতরে ঝরণার মতো জল পড়ছিল । ফাটল ধরেছিল মদন দত্ত লেনের পাঁচ ছয়টি বাড়িতে। চলতি বছরের মে মাসের ১১ তারিখ একই ঘটনা ঘটেছিল  পাশের পাড়া দুর্গা পিতুরি লেনে। তারও আগে ২০১৯ সালে প্রথম নিজেদের কয়েক পুরুষের  বসত বাড়িতে ফাটল ধরার অভিজ্ঞতা হয়েছিল দুর্গা পিতুরি লেনের বাসিন্দাদের। বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন হোটেলে থাকতে হয়েছিল তাঁদের। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো যাঁরা রূপায়ণের দায়িত্বে সেই কলকাতা মেট্রো রেলওয়ে কর্পোরেশন তাঁদের জন‍্য হোটেলে থাকা ও বাসগৃহ মেরামতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তখন থেকেই  উদ্বেগে ছিলেন তাঁরা। ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে এমন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে বোধহয় ভাবতে পারেন নি কলকাতার পুরোন এই এলাকার আদি বাসিন্দারা। অনেক স্বর্ণশিল্পীর কারখানাও এই বাড়িগুলির মধ‍্যেই। রুটিরুজি হারানোর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন তাঁরাও। ২০১৯ সালের বিপর্যয়ের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সহায়তা নিয়ে কেএমআরসি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভূগর্ভের সুড়ঙ্গের দেওয়ালের   যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের ব‍্যবস্থা করে আবার কাজ শুরু করার দু বছরের মধ‍্যে পর পর দু বার একইভাবে বাড়িতে ফাটল ধরার ঘটনা ঘটায় দুর্গা পিতুরি লেনের পাশাপাশি এবার মদন দত্ত লেনের বাসিন্দারাও আতঙ্কিত। মদন দত্ত লেনের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাসিন্দাদের হোটেলে রাখার ব‍্যবস্থা হলেও নিজেদের বসতবাড়িতে ভবিষ্যতে তাঁরা কতটা নিরাপদে থাকতে পারবেন সেই দুর্ভাবনাই প্রকাশিত হচ্ছে তাঁদের ক্ষোভ বিক্ষোভ। ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্কেও এই ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। ১০টিবাড়ি খালি করা হয়েছে। ১৩৬ জন বাসিন্দাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হোটেলে।  স্থানীয় কাউন্সিলর বিশ্বরূপ দে,বিধায়ক নয়না ব‍্যানার্জি এবং সাংসদ সুদীপ ব‍্যানার্জী সবাই সংবাদ মাধ‍্যমের সামনে মুখর হয়েছেন কলকাতা মেট্রোরেল কর্পোরেশনের গাফিলতির বিরুদ্ধে। কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম একধাপ এগিয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন প্রকল্পের কাজ চলাকালীন বিপজ্জনক বাড়িগুলিকে চিহ্নিত করে ভেঙে ফেলা হোক।

বাসিন্দাদের অস্থায়ীভাবে কোথাও সরিয়ে রেখে পরে নতুন করে বাড়ি বানিয়ে তাঁদের  ফিরিয়ে আনা হবে। তৃণমূল কংগ্রেসের চার গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধির বক্তব্য শুনে বোঝার উপায় নেই যে প্রকল্পের সূচনাপর্বেই  ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো রুটের গতিপথ পাল্টে দিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতি করা তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রীমো মমতা ব‍্যানার্জী নিজের অহংকার ও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বৌবাজার এলাকার বাসিন্দাদের চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। রেলমন্ত্রী থাকার সময় শুধুমাত্র তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প রাজ‍্য সরকারের হাত থেকে কেড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন মমতা ব‍্যানার্জীর ছিল তেমনি ২০১১ সালে  পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে মুখ‍্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই মমতা ব‍্যানার্জীই রুট পাল্টে দেন।  কলকাতা হাইকোর্টে আদালতে হলফনামা দিয়ে বৌবাজার স্ট্রীটের পরিবর্তে দুর্গা পিতুরি লেনের নীচে মেট্রো রেলের টানেল করা সম্ভব বলে জানায় রাজ‍্য সরকার। ফলে মহাত্মা গান্ধী রোডে ও সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনে মাঝে দেওয়াল ভেঙে দুই মেট্রোরেলের লাইন মেলানোর ব‍্যবস্থা, সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনে একটি অতিরিক্ত প্ল‍্যাটফর্ম তৈরি করার উদ‍্যোগ মাঠে মারা যায়। অথচ নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই দুর্গাপিতুরি লেনের নীচে টানেল করা বিপজ্জনক বলে রাজ‍্য সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু নিজেদের পছন্দসই সংস্থাকে দিয়ে ফিজিবিলিটি রিপোর্ট তৈরি করে এই এলাকা দিয়ে টানেল করা সম্ভব বলে আদালতকে নিশ্চিত করা হয়েছিল। অগ্রজতুল‍্য নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ দীপংকর সিংহকে প্রশ্ন করে জেনেছিলাম ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ করার জন‍্য বৌবাজার এলাকার এই ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় মাটি পরীক্ষা সম্ভব নয়। তাই ঠিকঠাকভাবে পরীক্ষা না করেই যে সেই সময় ফিজিবিলিটি রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল এমন ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। দীপংকরদা আমাদের বলেওছিলেন এবং সম্প্রতি তিনি সামাজিক মাধ‍্যমে মনেও করিয়ে দিয়েছেন ২০০৯ সালে বৌবাজার এলাকায় চলমান ফুটপাথ বা ট্রাভোলেটার গড়ার কাজ স্থগিত করে দিতে হয়েছিল শুধুমাত্র ঐ এলাকার ঝুরো ঝুরো মাটির কারণে যার ভার বহন করার ক্ষমতা অত‍্যন্ত কম। নিঃসন্দেহে দুর্গা পিতুরি লেনের বাসিন্দাদের ভুল বুঝিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন‍্য এই এলাকা দিয়ে মেট্রো রেলের টানেল নিয়ে যাওয়ার হঠকারী  সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের সর্বময়ী কর্ত্রীর অঙ্গুলিহেলনে।  

  সল্টলেক ওরফে বিধাননগর থেকে হাওড়া পর্যন্ত মেট্রোরেলওয়ের পরিকল্পনা ২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফেই নেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ‍্য সরকার যৌথভাবে এই প্রকল্প রূপায়ণ করবে এমন ভাবনা চিন্তা থেকেই  কেএমআরসি গঠন করা হয়। প্রকল্পের ব‍্যয় কেন্দ্রীয় নগর উন্নয়ন দপ্তর ২৫ শতাংশ,রাজ‍্য সরকার ৩০ শতাংশ এবং জাপান ব‍্যাঙ্ক ফর ইন্টারন‍্যাশানাল কোঅপারেশন এর হাতে ৪৫ শতাংশ বহন করবে বলে স্থির করা হয়।  কিন্তু ২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী হওয়ার পরেই প্রায় জোর করেই  রাজ‍্য সরকারের অংশ রেল দপ্তরের হাতে তুলে দেওয়ার জন‍্য জোর জবরদস্তি করতে থাকায় রাজ‍্য সরকার প্রকল্পের স্বার্থেই তা মেনে নেয়। আরও একটি বড়ো কারণ ছিল রেলমন্ত্রীর তরফ থেকে  হুমকি দেওয়া হয় যে তা না করলে শিয়ালদহ আর হাওড়া স্টেশন চত্বরে মেট্রো স্টেশন করতে দেওয়া হবে না । মজার ব্যাপার হলো ২০১১ সালের আগে যে অংশে পিলার গাঁথার কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ হয়ে গিয়ে ছিল, সেটুকু অংশেই মেট্রোর উদ্বোধন হয়েছে ২০২০ সালে এসে।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর  জমি অধিগ্রহণ নিয়ে একের পর এক বাধা তৈরি করেছিলেন মমতা ব‍্যানার্জী।  দত্তাবাদ এলাকায় লোক খেপিয়ে জমি অধিগ্রহণ এর কাজ সাত বছরের বেশী সময় ধরে আটকে রেখেছিলেন তিনি। ২০১২ সালে রুট বদলে দেন ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর। ফলে ব‍্যয় বেড়ে যায় ভারতের সর্বপ্রথম নদীর নীচে টানেল করে মেট্রোরেল প্রকল্পের। বৌবাজারের এখনকার অবস্থা দেখে আশঙ্কা হচ্ছে ২০২৩ এ আদৌ এই প্রকল্প রূপায়ণ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করা যাবে কি?