ফলাফল ও আগামী

এ যেন ঠিক রুপকথা!

আরেকবার বামপন্থীদের পুনরুত্থান ব্রাজিলে । লুলা’র হাত ধরে । একইসাথে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এটাও বুঝিয়ে দিল যে, ফ্যাসিস্তদের বিকল্প হতে পারে একমাত্র লাল ঝাণ্ডাই । লড়াইটা অসম্ভব কঠিন ছিল , লুলা পেরেছেন ব্রাজিল সহ গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি প্রগতিশীল ও বামপন্থী মানুষকে সেই লড়াইয়ে জিতে স্বস্তি দিতে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বামপন্থী লুলার পক্ষে সমর্থনের হার ৫০.৯০ শতাংশ। বর্তমান উগ্র দক্ষিনপন্থি রাষ্ট্রপতি বোলসোনারোর পক্ষে ৪৯.১০ শতাংশ। লুলার জয়ের ব্যবধান ২১,৩৯,৪৩৬ টি ভোট । আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী ১ জানুয়ারি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেবেন লুলা।

দ্য গার্ডিয়ান বলছে , দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই লুলাকে প্রধানত দারিদ্র্য, আবাসন ও আমাজন – এই তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। দেশের পুনর্গঠন ও দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে তাঁকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত বলসোনারোর চার বছরের মেয়াদে ব্রাজিলে যে বিভাজন দেখা দিয়েছে, তার ক্ষত সামলাতে হবে বামপন্থী লুলাকেই। আর লুলা নিজে তার বিজয়ী ভাষণে বলেছেন, ‘আমি আজ বিশ্বকে বলতে চাই, ব্রাজিল আবার ফিরে এসেছে । জলবায়ু–সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রাজিল তার অবস্থান ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত রয়েছে । বিভক্ত জাতিতে যুদ্ধের আবহে কেউ বাঁচতে চায় না’। লুলার পরিস্কার উক্তি – শুধু নিজের ভোটার নয়, ব্রাজিলের ২১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জন্যই তিনি কাজ করবেন ।

বর্তমান রাষ্ট্রপতি বলসোনারোর আমলে ৩ কোটির বেশি ব্রাজিলবাসী চরম খাদ্যসংকটের ঝুঁকিতে পড়েছে। দরিদ্র হয়েছে ১০ কোটি মানুষ। এ জন্য বলসোনারোর নীতিগত ব্যর্থতাকেই দায়ী করা হয়। বিশেষত আমাজন বন উজাড় করে দেওয়ার বলসোনারোর নীতি বিশ্বজুড়ে ব্রাজিলকে সমালোচিত করেছে। নির্বাচনী প্রচারে লুলা এ বিষয়গুলোকে দেশবাসীর সামনে তুলে এনেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতা নেওয়ার পর ব্রাজিলের দরিদ্র মানুষের ভাগ্য ফেরানো তাঁর অগ্রাধিকার হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের লাখ লাখ নারী–শিশু–পুরুষ পর্যাপ্ত খাবার পান না, এটা সাধারণ কোনো বিষয় হতে পারে না। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম খাবার উৎপাদনকারী দেশ ও বৃহত্তম প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে প্রতিদিন ব্রাজিলের প্রত্যেক মানুষের পাতে তিন বেলা খাবার তুলে দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান আমাদের কর্তব্য।’

আমাজন জঙ্গলের আয়তন প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার। ব্রাজিলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেশির ভাগ এলাকা, কলম্বিয়া, পেরুসহ দক্ষিণ আমেরিকার ৯টি দেশে বিস্তৃত এই বন। তবে এই বনের সিংহভাগ পড়েছে ব্রাজিলে। জঙ্গলের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্রাজিলে। তবে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ক্রমাগত আমাজন জঙ্গল ধ্বংসের হার বাড়তে দেখা গেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর বলসোনারো ব্রাজিলের পরিবেশের সুরক্ষাজনিত পদক্ষেপগুলো কমিয়ে ফেলেন, বিজ্ঞান ও পরিবেশগত সংস্থাগুলোতে খরচ কমিয়ে দেন, পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের বরখাস্ত করেন এবং আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নড়বড়ে করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, বন উজাড় এবং আগুনের কারণে আগের দশকের তুলনায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গমনের হার দ্বিগুণ হয়েছে। সবশেষ একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর আমাজন জঙ্গলের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর এলাকা আগুনে পুড়ে গেছে। সেপ্টেম্বরে বনে আগুনের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

যেভাবে ফিরে এলেন লুলা

এপ্রিল, ২০১৮। কোনও তথ্যপ্রমান ছাড়াই অভিযুক্ত করা হয় লুলা দা সিলভাকে। ভুয়ো মামলায় একতরফা দোষী সাব্যস্ত। হাস্যকরভাবে মোট ২৬ বছরের জেলের সাজা । ২০১৮ তেই ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। জেলে থেকেই বরাবরেই মতই জনপ্রিয়তায় এক নম্বরে ছিলেন লুলা। ধারেকাছে কেউ নেই। জনমত সমীক্ষায় সবচেয়ে কাছের প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ব্যবধান। কিন্তু বিচারব্যবস্থার চালাকিতে প্রার্থী হতে পারলেন না । বিপর্যয় ঘটে গেল ব্রাজিলে । জিতে এলেন ব্রাজিলের ‘ট্রাম্প’ বলে খ্যাত প্রাক্তন সেনা আধিকারিক উগ্র দক্ষিনপন্থি বোলসোনারো । লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতি চলতে শুরু করল উল্টোপথে । নয়া উদারবাদের ভয়াবহ দিকটা গ্রাস করে ফেলল ব্রাজিলকে । তারপর করোনা এসে করে দিল আরও সর্বনাশ । ঠিক ট্রাম্পের মতই অযোগ্য ও অপদার্থভাবে করোনাকে মোকাবিলা করে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুকে ছুঁয়ে ফেললেন বোলসোনারো । স্বাস্থ্যমন্ত্রকের বিশেষজ্ঞদের কোনরকম পরামর্শে কর্ণপাত না করে নিজের মতো চলেছেন বলসেনারো। ব্রাজিলে মারা গেলেন সাড়ে ছয় লক্ষ মানুষ । বেকারি ও দুর্নীতির আজ চরম সীমায় ব্রাজিল ।

কোভিডের সময়ে স্রেফ দুবেলা উপোষ করেই ছিলেন দেশের মোট জনসংখ্যার নয় শতাংশ মানুষ , আর কোনরকমে একবেলা খেয়ে থেকেছেন দেশের কুড়ি শতাংশ মানুষ । দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির হার ছুঁয়েছে পনের শতাংশে । লুলা ও তাঁর ওয়ার্কার্স পার্টি ব্রাজিলকে যে সামাজিক সুরক্ষার আসনে বসিয়ে গেছিলেন , সেই ব্রাজিল আজ খাদের ধারে ।  গোটা বিশ্ব দেখেছে ট্রাম্প ও মোদীর সাথেই পাল্লা দিয়ে তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলসেনারো কিভাবে ব্রাজিলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটা দেশের সবকিছু কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়েছেন , কিভাবে নির্বিচারে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ আমাজনকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন । কিভাবে দেশের বিরোধীদের তথা বামপন্থীদের ওপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছেন , ধ্বংস করেছেন গনতন্ত্রকে , জাগিয়ে তুলেছেন বর্ণবাদকে ।

তাঁর ওপর সাজানো মামলার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলেন লুলা । কোনরকম তথ্য প্রমান না পেয়ে  স্বাভাবিকভাবেই লুলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাজা সোজাসুজি খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডসন ফাচিন। তিনি পরিস্কার ভাষায় বলেন – ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর কারিতিবার আদালত দুর্নীতি মামলায় লুলাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং জেলে পাঠিয়েছে, সেই মামলা বিচার করার তাদের কোনও এক্তিয়ারই নেই। নভেম্বর ২০১৯ । ব্রাজিল জুড়ে সেদিন উচ্ছ্বাস । কারন ঐদিনই যে আগামী নির্বাচনে লুলার প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দরজা খুলে গেছিল ।  সেদিন সাউ বার্নাদো দো ক্যাম্প শহরে এবিসি মেটাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদর দপ্তরের সামনে ভিড়ে উপচে পড়ে লুলার মুক্তির সমাবেশ। ফিরে এসেই পরিস্কার ভাষায় লুলা বলেন – ‘ব্রাজিলের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা জরুরী।  আমি এখনও লড়াই করার জন্য যথেষ্ট তরুণ আছি। রাজনীতি আমার শরীরের রক্তে মিশে গেছে। আর নতুন করে রাজনৈতিক লড়াই শুরুর একটি কারণ আছে। ১২ বছর আগে রাষ্ট্রপতির অফিস ছাড়ার পর এখন দেখছি যে, গরীবদের স্বার্থে আমি যে সমস্ত নীতি তৈরি করেছিলাম তা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্বৈরাচারী ও বর্ণবিদ্বেষী শাসকের হাত থেকে ব্রাজিলকে উদ্ধার করা জরুরী’ ।

লুলা তাঁর নির্বাচনী বক্তব্যে জোর দিয়েছেন আফ্রিকার সাথে ব্রাজিলের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের ব্যাপারেও । লুলার মতে আফ্রিকার কাছে ব্রাজিল ঋণী । এই ঋণ টাকা পয়সার নয় । এই ঋণ সংহতির । কালো মানুষদের ওপর ৩৫০ বছরের অত্যাচারের ইতিহাসের ঋণ । আফ্রিকার ইতিহাস , কালো মানুষদের সংগ্রামের ইতিহাস প্রতিটা স্কুলের সিলেবাসে থাকবে যাতে বাচ্চারা ভবিষ্যতে কখনও কোন আফ্রিকান বা কালো মানুষকে ছোট মনে না করে । আসলে এইসব প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার বিপরীত পথে হেঁটেছেন ট্রাম্পের বন্ধু বলসোনারো , ফলে আজ ব্রাজিলের সমাজে বেড়েছে ঘৃণা , হিংসা ও কুসংস্কার । যার সাথে অনেকে মিল পাবেন আজকের ভারতের । বামপন্থী লুলার লড়াই তাই এই ফ্যাসিস্ত অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধেও । লুলার নিজের মতে এই নির্বাচনে জয়ের চেয়েও বেশি ব্রাজিলের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন ।

অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে লুলা চাইছেন লাতিন আমেরিকার এক এবং অভিন্ন একটি ডিজিটাল মুদ্রা , যেটা গোটা মহাদেশের ব্যবসা বানিজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বলা বাহুল্য লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল স্বাভাবিকভাবেই তাতে নেতৃত্ব দেবে । এই অভিন্ন মুদ্রার ফলে গোটা লাতিন আমেরিকার মহাদেশের সব দেশগুলোর মধ্যে একতাও বাড়বে ।