৭ জানুয়ারির ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের ডাকা নজির ভাঙা ভিড়ে উপচানো ইনসাফ ব্রিগেড বাজারি মিডিয়ায় ব‍্যাপক প্রচার পেয়েছে,কারণ পশ্চিমবঙ্গের টিভির দর্শক,খবরের কাগজের পাঠক তৃণমূল বিজেপির ” তুই বড় চোর না মুই বড় চোর “- এর দ্বন্দ্ব এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নবীন বনাম প্রবীণের চাপান উতোরের নামে গলা ছেড়ে নাক অবধি দুর্নীতিতে ডুবে থাকা অভিষেক ব‍্যানার্জীর থেকে মমতা ব‍্যানার্জীর দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টার খবরে বিশেষ আগ্রহী হচ্ছেন না। টি আর পি তোলার জন‍্য বামমনস্ক দর্শক পাঠকদের আগ্রহ বাড়ানোর জন‍্য তাই ইনসাফ ব্রিগেডকে গুরুত্ব দিতেই হয়েছে। গুরুত্ব দিতে হয়েছে রুটি রুজি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার দাবিকে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সর্বাত্মক বিরোধিতায় সোচ্চার প্রচারকে এবং অবশ‍্যই ডিওয়াইএফআই এর রাজ‍্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জীর বক্তব্যের স্মরণীয় অংশ,” রাজনীতি মানে ৭৫ ২৫ এর ভাগাভাগির অঙ্ক নয়”-কে।

পড়তে হয় নয়ত পিছিয়ে পড়তে হয়- বিজ্ঞাপনের দৈনিক পত্রিকার শিরোনামকে চাপা উদ্বেগ না তীর্যক বিদ্রুপ বলা হবে তা অনুমানের বিষয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে, উদ্ধৃতি বন্ধনী ছাড়াই দুটি শিরোনাম,”খেটে খাওয়া মানুষের ভিড় ” এবং “ভিড়ের ছাপ ভোটের বাক্সে চায় ব্রিগেড।’
যে পত্রিকা গোষ্ঠীর মালিক সর্বভারতীয় মঞ্চে প্রকাশ‍্যে ঘোষণা করেছিলেন,তাঁরা জনপ্রিয় সরকারকে সমর্থন করার পক্ষপাতী তাঁদের বাংলা পত্রিকায় তাঁরা স্বাভাবিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ‍্যমন্ত্রীকে “দিদি” হিসাবে উল্লেখ করেই সংবাদ শিরোনাম করতে অভ‍্যস্ত। সেখানে অভিষেক ব‍্যানার্জীর সভার খবর প্রথম পাতার প্রধান খবর হিসাবে দেখা গেলেও প্রথম পাতার ডানদিকে জনসমাগমের প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে লেখা হয়েছে দুই ফুলের পাপড়ি ঝরানোর ভার তরুণ ব্রিগেডকে এবং ভিতরের পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে ইনসাফ ব্রিগেডের সাফল্য কামনা ডিওয়াইএফ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রাক্তন মুখ‍্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাঠানো বার্তায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার লাইন ” যেখানে ডাক পড়ে জীবন মরণ ঝড়ে আমরা প্রস্তুত!” এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্রের কার্যনির্বাহী সম্পাদক হিসাবে যুক্ত থাকা পত্রিকা যাকে অনেকেই ” তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ‍্যসভার প্রাক্তন সাংসদদের পত্রিকা ” বলেই অভিহিত করেন,সেখানে ইনসাফ ব্রিগেডের জনসমুদ্রের ছবি ছেপে ওপরে লেখা হয়েছে,ভিড়ে লোক মন্দ নয় – “ভোট ফেরা নিয়ে সেই সংশয়”! অর্থাৎ জনসমাগম নিয়ে কোন সংশয় নেই পত্রিকার,কিন্তু আঠারো বছর আগে সিঙ্গুরের মোটরগাড়ির কারখানা প্রকল্প নিয়ে কুৎসা শুরু করে সেই পত্রিকার যে সাংবাদিক পরবর্তীকালে প্রথমে তৃণমূলের টিকিটে রাজ‍্যসভার সাংসদ হয়ে চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জেলখেটে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র হিসাবে বেলাগাম বক্তব্য রাখার জন‍্য প্রায়শই মিডিয়ার খবর হন সেই ভদ্রমহোদয় সাতাশ হাজার মানুষের জমায়েতের কথা বলে হাসির খোরাক হয়েছেন।

মোট কথা বাম বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বাজারি মিডিয়াও এখন তৃণমূল বিজেপির ওপর তিতিবিরক্ত মানুষের একটি বড়ো অংশের আগ্রহ ও প্রত‍্যক্ষ সমর্থনের স্রোত বামপন্থীদের দিকে ঘুরে গেছে এই সত‍্য অস্বীকার করতে পারছে না।

কারণ শুধুমাত্র ব্রিগেড সমাবেশের প্রচার করে ৭ জানুয়ারির এই বিপুল জনসমাবেশ যুব ফেডারেশনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। পঞ্চাশ দিন ধরে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপের যে দীর্ঘ পদযাত্রা ডিওয়াইএফআইয়ের পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্যকমিটির সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা ও সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জীর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল তা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। তাঁরা বিশ্বাস করতে পেরেছেন,এই আদর্শবাদী ঝকঝকে পরিশ্রমী যুবনেতা নেত্রীরা পারবেন তাঁদের সঙ্গে হওয়া বঞ্চনার প্রতিকার করতে।

মমতা অভিষেক সুকান্ত শুভেন্দুর বাগাড়ম্বরের বাইরে মীনাক্ষী ধ্রুবদের বক্তব্য ও আন্তরিক আলাপচারিতা ছিল একঝলক টাটকা বাতাসের মতো। আর এস এস বিরোধী একাধিক প্ল‍্যাকার্ড পোস্টারও বুঝিয়ে দিয়েছে ব্রিগেড আসলে কাদের মোকাবিলা করার ডাক দিয়েছে।

ফলে গত পঞ্চাশ বছরে অধিকাংশ শহীদ মিনার ও ব্রিগেড সমাবেশে যোগ দেওয়া পশ্চিম বর্ধমানের প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা মনোজ মুখার্জীর চোখে ধরা পড়েছে ৭ জানুয়ারির সমাবেশের স্বতঃস্ফূর্ত মেজাজ। তিনি স্পষ্ট বললেন,”মানুষের সঙ্গে মিশে সুখদুঃখের সঙ্গী না হলে এই সাড়া পাওয়া যেতো না। ” প্রশ্ন করেছিলাম,নির্বাচনী রাজনীতিতে বামপন্থীদের প্রতিকূল সময়ে জেলার প্রায় অনালোচিত একটি এলাকা থেকে উঠে আসা এক নেত্রীকে বহুদিন পরে ব্রিগেড সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসাবে দেখে কি বাড়তি উৎসাহ পেয়েছে মানুষ? ব‍্যক্তিগত জীবনে তরুণ প্রজন্মের বামপন্থী জননেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জীর পিতা মনোজ মুখার্জী বললেন, “কোন নির্দিষ্ট ব‍্যক্তিকে কেন্দ্র করে নয়,আসলে অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণের বিরুদ্ধে রাজ‍্যের মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে; ইনসাফ অর্থাৎ ন‍্যায় বিচার চাওয়া একটা সময়োপযোগী ডাক,আর তাতেই সাধারণ মানুষ সাড়া দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেছেন। নইলে ব্রিগেডে পরিযায়ী শ্রমিকরা যোগ দিতে আসবেন কেন?” মনে পড়ে গেল শহীদ পরিবারের সদস্যদের ইনসাফ যাত্রায় পা মেলানোর খবর। বীরভূমের লাভপুরে লাল পতাকা তোলার “অপরাধে ” নিহত শহীদ বাদল শেখের ইনসাফ যাত্রায় সুদীপ্ত গুপ্ত মইদুল ইসলাম মিদ‍্যা আনিস খানের পাশাপাশি ষোল বছর আগেকার শহীদ স্বপন কোলের কথাও উঠে এসেছিল। ইনসাফের ব্রিগেডে যেমন শালকু সোরেনের মা ছিতামণি সোরেন উপস্থিত ছিলেন তেমনি আনিস খানের বাবা সালেম খানও উপস্থিত ছিলেন। শহীদ প্রদীপ তা ‘র মেয়ে পৃথা তা এখন ডিওয়াইএফ আই এর নেত্রী ইনসাফযাত্রায় সামিল হয়েছিলেন প্রথম থেকেই। কথোপকথনের সময় মনোজ মুখার্জীর একটি স্মরণীয় উক্তি উদ্ধৃত করেই প্রতিবেদন শেষ করা যাক, বামপন্থীদের মানুষ যেভাবে দেখতে চায় ইনসাফযাত্রায় ছেলেমেয়েদের তেমনিভাবেই দেখতে পেয়েছে মানুষ। তাই ভরসা পেয়েছে।