একটা চিরকুট অনেক কিছু বুঝিয়ে দিল।

গত ১৪ ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ২০২৩-২৪ সালের বাজেট বক্তৃতার সময় অর্থদপ্তরের স্বাধীন দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের হাতে তাঁর সহকর্মী বিদ‍্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস একটা চিরকুট ধরিয়ে দেন এবং সেই চিরকুট দেখেই অর্থদপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা করেন,সরকারি কর্মচারীরা এবং অবসরপ্রাপ্তরা ৩ শতাংশ হারে মহার্ঘভাতা পাবেন। এর ফলে রাজ‍্য সরকারের প্রদেয় মহার্ঘভাতা বা ডি এ র পরিমাণ দাঁড়ালো মোট ছয় শতাংশ। কিন্তু ঐ চিরকুট দেওয়ার ঘটনাটি সংবাদ মাধ‍্যমে ফাঁস হয়ে যেতেই প্রবল সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সরকারি কর্মচারিদের সংগঠনের নেতা কর্মীরা  প্রশ্ন করছেন সরকার কি আদালত অবমাননা এড়ানোর জন‍্য এই নিয়মরক্ষার ঘোষণা করলেন? মূল বাজেটের খসড়ায় নিশ্চিতভাবেই এই বরাদ্দের  ঘোষণা ছিল না। তড়িঘড়ি চিরকুট পাঠিয়ে ড‍্যামেজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা হল। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি অন্ধ অনুগত সরকারি কর্মচারিদের বাদ দিলে কম বেশি সকলেই প্রশ্ন তুলেছেন, আদৌ কি সরকার ডি এ দিতে চাইছেন? সত‍্যিই কি সরকারের রাজনৈতিক মুখপাত্ররা টেলিভিশন চ‍্যানেলে বা অন‍্য সংবাদ মাধ‍্যমে যেমনটা বলেন,” মাননীয়া মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী চাইছেন ডি এ দিতে “-সেই সদিচ্ছা বাস্তবে থাকলে বাজেট বক্তৃতা চলাকালীন চিরকুট পাঠিয়ে ডি এ দেওয়ার  কথা চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কে মনে করাতে হতো? ফলে প্রতিবাদ আন্দোলন তীব্রতর করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাঁরা।

ষষ্ঠ বেতন কমিশন অনুযায়ী কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের ডিএ-র তফাত এখন ৩৫ শতাংশ। দিনে দিনে বাড়ছে এই তফাত। অন্যদিকে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখে পেন ডাউন স্ট্রাইকের  হুঁশিয়ারি আগেই দিয়েছিলেন  সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। এই আবহে জানুয়ারি থেকে যে ডিএ দেওয়া যেত মার্চ মাসে এসে তা মাত্র তিন শতাংশ বৃদ্ধি করায় ক্ষোভে ফুঁসছেন সরকারি কর্মীরা।  এই ডিএ ভিক্ষার সামিল বলে মনে করছেন তাঁরা।

বকেয়া ডি এ র দাবিতে পঞ্চায়েত ভোট বয়কট করার ঘোষণাও করেছিলেন সরকারি কর্মচারীদের একাংশ।  আজ রাজ্য বাজেটে নতুন করে ডিএ বৃদ্ধির ঘোষণার পর তাঁদের ক্ষোভের আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়েছে।  তাঁদের পক্ষ থেকে ব রাজ্য সরকার কোন হিসেবে এই ডিএ দিলেন তা তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়। অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইজ ইন্ডেক্সের নিয়মের সঙ্গেও মিলছে না রাজ্য সরকারের হিসেব। পাশাপাশি এত বছর পরে মাত্র ৬ শতাংশ ডিএ বৃদ্ধি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে ক্রমেই বাড়ছে রাজ্যের ডি-এর তফাত। কেন্দ্র যেখানে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চার শতাংশ ডিএ বৃদ্ধি করেছিল সেখানে ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাস কোনও বর্ধিত ডিএ পেলেন না রাজ‍্য সরকারি কর্মচারিরা।

 প্রয়াত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক লেখক দেবু দত্তগুপ্তর একটি নিবন্ধে পড়েছিলাম,সত্তরের দশকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মবার্ষিকী পালন করার জন‍্য বাম মনস্ক কর্মচারিদের একটি অংশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাইলে অবাঙালি ওপরওয়ালা তাঁর অধস্তন বাঙালি অফিসার কে সুকান্ত ভট্টাচার্যের পরিচয় জানতে চাইলে সেই বঙ্গসন্তান  ইংরাজীতে এই  মর্মে কর্তৃপক্ষকে  নোট পাঠিয়েছিলেন,” সুকান্ত ভট্টাচার্য অকালপ্রয়াত একজন বামপন্থী কবি। জীবিত থাকলে তাঁর সিপিআইএম সমর্থক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। “

পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ‍্যমন্ত্রী বোধহয় ধরেই নিয়েছিলেন, সরকারি  কর্মচারিদের বড়ো অংশই চাকরির দায়ে এখন তাঁর দলের অনুগত। সে কারণেই বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁদের বকেয়া প্রাপ‍্য মহার্ঘভাতা দেওয়ার দাবি প্রসঙ্গে  সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ‍্যে গত  ২০১৭ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর  অনায়াসে “ঘেউ ঘেউ করবেন না “- বলতে  নিশ্ছিদ্র রাজনৈতিক  আনুগত্য নিয়ে সম্ভবত নিঃসংশয় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ‍্যমন্ত্রী। কারণ সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু নির্বাচনে পোস্টাল ব‍্যালটে “আঙুল সোজা করে অথবা বাঁকা করে” যেভাবেই হোক গণনার সময় দেখা গেছে তাঁরা এগিয়ে রয়েছেন। ফলে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন, আদালতে কালক্ষেপ করাতে পারলেই কেল্লাফতে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্টোটা। ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে ডি এ র দাবিতে কর্মচারিদের  এই আন্দোলন। অন‍্যরাজ‍্যের সরকারি কর্মচারীরা প্রশ্ন করছেন, “ডি এ র জন‍্য আন্দোলন করতে হবে কেন? ও টা তো তাঁদের ন‍্যায‍্য পাওনা। ” এই রাজ‍্যের একটু চিন্তা শক্তি সম্পন্ন ব‍্যক্তিদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করছেন ডি এ র দাবিতে কলকাতায় সরকারি কর্মচারিদের  অবস্থানে বসতে তাঁরা আগে কখনও দেখেন নি।

চিরকুটের শেষতম ফল শিলিগুড়িতে শাসকদলের সমর্থক তৃণমূল সেকেণ্ডারি টিচার্স অ‍্যাসোসিয়েশন থেকে পদত‍্যাগ করেছেন অনেক শিক্ষক। উত্তরবঙ্গেই একটি স্কুল থেকে একযোগে চৌদ্দ জন শিক্ষক সদস্যপদ ছেড়ে দিলেন গণ স্বাক্ষর করে। এমন ঘটনা সাম্প্রতিককালে নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন।