গরু পাচার ও অনুব্রত

গৌতম কর

অনুব্রত গরু পাচারকারী বলাটা অত্যুক্তি। আন্তর্জাতিক সীমানা ভেদ করে পাচার বিপুল বীরত্বপূর্ণ শিল্প। গরু, সোনা, প্রাচীণ মূর্তি থেকে নারী, শিশু, শস্তা শ্রমিক। মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ছিল এবং আছে। বিষয়টি Osmosis বা অভিস্রবণ প্রক্রিয়া। কম ঘনত্বের তরল আধা-ভেদ্য পর্দার ভেদ করে বেশী ঘনত্বের তরল মুখী ধাবিত হয়। উদাহরণ, কিসমিস পানিতে ডুবিয়ে রাখলে পানি ঢুকে ফুলে যায়। বাংলাদেশে গরুর চাহিদা বিপুল। আধা-ভেদ্য পর্দা হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। বিএসএফকে আধা-ভেদ্য করে দেন সতীশ কুমাররা। সতীশ কুমারদের সিগনালে খেলা দেখায় বাংলার অভিজ্ঞ পাচার শিল্পীরা। বীরভূমে ইলামবাজারের সুখবাজার বা মুরারইর হিয়াতনগরের মত অসংখ্য ছোট বড় গরুর হাট আছে। হাটের মালিকরা ওডিশা, পাঞ্জাব, বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে গরু আনে। অনেক তৃণনেতা বলেন, অন্য রাজ্য ব্যবস্হা নয়ে না কেন? গরু এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাওয়াটা বেআইনী বা পাচার নয়। পাচার হয় আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করলে। হাট সাপ্তাহিক হলেও জোরদার ব্যবসায় প্রতিদিন খোলা।

মনে করুন এনামুল হক গরু হাটের সিন্ডিকেটের ডন। তার গরু বাজারের নাম বিশু শেখ বা বি.এস। গরুর গায়ে বি.এস স্ট্যাম্প লাগানো থাকলে সংশ্লিষ্ট সবাই বুঝবে কোন মহাজনের গরু। পাচারকারীর হাতে থাকত পরিচয়ের কোড এবং যাত্রপথের হাল-হকিকৎ। বলতে পারেন, গরুদের ওটাই পাসপোর্ট। কারণ সতীশ কুমাররা নথি মিলিয়ে দুয়ারে পাচার প্রকল্প শুরু করবে। এরকম দশ বারো জন সিন্ডিকেট মালিক ছিলেন। শোকেসে থাকত কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন ব্যবসা, ফলে গরু হাটের সাথে সম্পর্ক ঠাহর করা মুশকিল। আব্দুল লতিফকে সবাই জানত মার্বেল ব্যবসায়ী হিসাবে। এনামুলের গ্রেপ্তারের পর ব্যবসার একাংশ উঠে যায় কেতুগ্রামের পাচুন্দিতে। এনামুল হককে গ্রেপ্তার করলেই আন্তর্জাতিক চোরা কারবার বন্ধ হয়ে যাবে না। এই গরু পাচারকারীরা তৃণমূল কর্মী হলেও অনুব্রত নিজে কোটি কোটি টাকার পাচারের ব্যবসা করতেন না, ততটা ক্ষিপ্রগতি বা সময় ছিল না। যে কোন বৃহৎ শিল্পে অনুসারী শিল্প থাকে। যেমন বাল্ব আছে, সুইচ আছে, মাঝে তারও আছে, বিদ্যুৎ না থাকলে কী লাভ?

গরুর হাট থেকে সতীশ কুমারদের সীমান্ত অবধি গরুর লরি পুলিশ প্রশাসন দেখতে পাবে না। দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির জন্য যেমন ব্যায়বহুল চিকিৎসা আছে, না দেখতে পাওয়ার খরচ ততোধিক। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার ডি.এম, এস.পি সাহেবরা, কাস্টমসের দুঁদে অফিসাররা আছেন। প্রতি থানায় আইসি আছেন, নিচে চৌখশ ঊর্দি বাহিনী। এনামুল বা লতিফের মত মূল শিল্পপতিরা এই অন্ধ করার দাদন দিয়েছিলেন সায়গল হোসেনকে। পাচারের মূল ব্যবসার একটা উইং পেশাদার কুশলী অনুসারী শিল্পকে দেওয়া হয়। সায়গল হোসেন এক কনস্টেবল মাত্র। অনুসারী শিল্পের মালিক অনুব্রত মন্ডলকে অঙ্কটা জানাতেন। অনুব্রতর নির্দেশানুসারে বড় মাথা থেকে প্রতি থানায় ওজনানুসারে প্যাকেট পৌঁছে যেত। আসল চোখ নবান্নের চোদ্দ তলায়। হ্যাঁ, নবান্নের সিগনাল ছাড়া জেলা সভাপতি এনামুল বা লতিফদের পরিষেবা দিতে পারতেন না। তাহলে অনুব্রতর মূল কাজ সায়গল হোসেনকে দিয়ে টাকা তোলা এবং কাটমানির সুষম কার্যকরী বিতরণ। শিল্পে ওভারহেড আনুষঙ্গিক ভোট লুঠের মত খরচটাও বহন করতে হয়।

তাহলে কি অনুব্রত কেবল গরু পাচার শিল্পের সার্ভিস প্রোভাইডার? এই কাজটা করতে জেলাটাকে হাতের মুঠোয় রাখতে হবে। প্রতিটা মানুষ যেন মা-মাটি হারাবার ভয়ে থরথর করে কাঁপে। ডি.এম, এস.পি, আই.সিদের সহযোগিতায় ও পারষ্পরিক স্বার্থে বিরোধী শূণ্য করতে হবে। তার একটা ভাষা আছে। সেটা ইংরাজী না বোঝা, হিন্দী না বলতে পারা বা বাংলা না লিখতে পারার ক্ষমতায় বিচার করা যাবে না। দ্বিতীয়তঃ লর্ড কর্নোয়ালিসের মত জমিদারীর চিরস্হায়ী বন্দোবস্ত করতে হবে। তাহলে মন খুলে বোম, বন্দুক বিনিয়োগে কার্পণ্য থাকবে না। তৃতীয়তঃ খাজনায় যেন নবাবের অসন্তুষ্টি না থাকে। মাথায় স্নেহের হাত, কেষ্টার মাথায় অক্সিজেন কম যায়, কিন্তু ও খুব ভাল সংগঠক। গরু যেমন লরিতে পাঠানো যায়, টাকার বস্তার জন্য চাই নীলবাতি লাগানো অ্যাম্বুলেন্স, গ্রীন করিডর। চতুর্থতঃ কেবল গরুর সার্ভিস প্রোভাইডার হলে হবে না, সাথে অনুপ মাঝি, বিনয় মিশ্রর কয়লা, নদীর বালি, পাথর খাদান, অরণ্যের কাঠ, শিশু-নারী পাচার শিল্প থেকে টোলট্যাক্সের ব্যবসায় পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে।

সুতরাং বোঝা গেল, অনুব্রত গরু পাচারকারী নন, তিনিও সতীশ কুমারদের মত গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস প্রোভাইডার। যে পরিষেবা না থাকলে তেল খাওয়া মেশিনের মত সিন্ডিকেট মালিকদের ব্যবসা চলবে না। পদস্খলন হলেই সিউড়ির আই.সি শেখ মহম্মদ আলির মত সিবিআইয়ের ডাক। তারপরেও অনুব্রতর সমস্যা আছে। এই ব্যবসার বিপুল লভ্যাংশ পুরোটাই তাঁর কলপ করা চুলের মত কালো। পঞ্চমতঃ সব চেয়ে শক্ত কাজ সেই কালোকে দিনের আলোয় সাদা করা। এর জন্য যেমন মণীষ কোঠারির মত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট দরকার, তেমনই অনুগত দাস সম্প্রদায়ের সহস্র অ্যাকাউন্ট থেকে নির্ভরশীল ব্যাঙ্ক ম্যানেজার। সাথে সাংবাদিক, রবিনহুড ভাবমূর্তি। এবং ষষ্ঠতঃ যে কোন আন্ডার ওয়ার্ল্ড পরিচালনায় দরকার অপ্রয়োজনীয় বা বিপজ্জনক ব্যক্তিকে ছুটি দিয়ে দেওয়া। ২৭শে এপ্রিল, ২০২২, দুর্গাপুর থেকে ইদের বাজার করে ফেরার পথে ইলমবাজারে সায়গল হোসেনের গাড়ি ডাম্পারে ধাক্কা মারলে শিশুকন্যা সহ বন্ধু মাধব কৈবর্তের মৃত্যু, বাঁচে সায়গল। তখন সিবিআইর ডাকাডাকির শুরু।

এটা একটা দুর্ঘটনা। বেঁচে যাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা। লিঙ্কম্যান না থাকলে তদন্তের অনেক সূত্র হারিয়ে যেত। অর্থাৎ অনুব্রত যে অসামান্য পরিষেবা দিয়েছেন, তা বহাল রাখতে হাইকমান্ড কসুর করেননি। উডবার্ন থেকে সিবিআই, ইডির হেপাজত হয়ে আসানসোল জেল। সরকারী দল তাঁকে বীরের সম্বর্ধনার কথা বলছেন। কোন মন্ত্রী তাঁকে বাঘ বলছেন। এই বীর বাঘের সিংহাসন অটুট থাকলে পাচার শিল্পীদের অ্যাম্বুলেন্স রাতের আঁধারে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। ফলে আসানসোল জেলের কুঠুরি তাঁর নিচুপট্টির বাড়ির চেয়ে আরামদায়ক করে ফেলেছিল। তিনি জেলার সভাপতি রইলেন। ভোটের চালিকা শক্তি ছিল বেতাজ বাদশাহের হাতে। ইডি বুঝতে পারল বাংলার মাটিতে বীর সন্তানকে ঘায়েল করা যাবে না। দিল্লী যাত্রার খবর হতেই শিবঠাকুর মন্ডলের মামলা এবং দুবরাজপুর পুলিশের তৎপরতা। রাউস অভিনিউ কোর্টে হাজির কপিল সিব্বাল থেকে মনু সিঙ্ঘভির মত আইনজীবীরা। তিনি গরু পাচারকারী নন, কিন্তু অন্ধকার জগতের কিং-পিন। আজ পাচার শিল্প বহাল তবিয়তে আছে, কেবল অনুব্রত আছেন তিহাড়ে।

ভয়ঙ্কর খেলা হবে। কালোকে সাদা করার খেলা। আমরা যে খেলতে জানি। এত বড় সম্রাজ্যের চূণকাম চাট্টিখানিক কথা নয়। ৪৫ বিঘার উপর ভোলেবোম রাইসমিলের মত একাধিক চালকল। শ খানেক কৃষি ও বাস্তু সম্পত্তি। এমন ৫৭ কোটির ২৬টা সম্পত্তি কন্যার নামে আবিস্কৃত। বালি, কয়লা, পাথর খাদানে লগ্নি, ভুয়ো কম্পানী থেকে IPL। যোগফল সিঙ্গুরের ৯৯৭ একরের অনেক বেশী। হিসাব রক্ষক মণীশ জানেন কত আয়, কত খরচ, কত খাজনা, আর অনুব্রতর বাজনা কত। পার্সোনাল কালীর ৫৭০ ভরি অলঙ্কারে মুগ্ধ জনতা। মণীশ আরো জানেন, মুখ না খুললে কারাগার, খুললে হয়ত সায়গল হোসেনের মত ভাগ্যবান হবেন না। দিল্লী আদালতে কাঁদছেন, আমার একমাত্র ভুল সি.এ হওয়া। তিনি জানেন, মাধবের মত কত বেকসুরকে মৃত্যুর ঘাট পার করে দিয়েছে এই বীরচক্র। সায়গলের ছোট্ট কন্যা থেকে সাগর ঘোষ কেউ রেহাই পায়নি। বগটুই জ্বলেছে। এক বিশাল দানব অসহায় মানুষের ফুসফুস নিয়ে খেলছে। মণীশরা বুঝতে পারছেন না, কারাগারের অন্ধকার নাকি মৃত্যুতে চিতার আলোর সম্ভাষণ?

তদন্তকারী সংস্হাদের কাছে গরু পাচারের প্রসঙ্গ এসেছে অনুব্রতকে চিনতে। অনুব্রতকে চিনতে হলে কন্যা সুকন্যা, সুকন্যার চালক তুফান, ল্যাংচা হাবের কৃপাময়, রসনা তৃপ্তির বিজয় রজক, সহায়ক অর্ক, পঞ্চুপ্রধান শুভঙ্কর, কাউন্সিলার বিশ্বজ্যোতি, দুষ্কৃতি তাপসদের খাজানা জানতে হবে। যে নবাবের সনদ পেয়ে জেলার জায়গীর হয়েছেন, তাঁর অমৃতকথা শুনতে হবে। জল যদি বাড়তে থাকে তাহলে নবাব এত্তেলা পাঠাবেন দিল্লীর বাদশাহকে। বাদশাহের দরবার উপঢৌকন গেলে ঘোড়ার জিন হালকা করে দেবেন, তারপর যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা। অনুব্রত গরু পাচার করতেন না, সেফ প্যাসেজ প্রোভাইডার ছিলেন সনদের জোরে। তদন্তকারী সংস্হা সব আবিষ্কার করলেই যে জনগন জানবে বা সাজা হবে, তেমনটা ভাবা কষ্টকল্পনা। কারণ পাচারকারীরা আরো উপরে বসে। সেই তখতে আরেক অসুর বসে বলবেন, ভয়ঙ্কর খেলা হবে। নকুলদানা, গুড়, বাতাসার পর বার্গার, মোমো, ক্যাডবেরির খেলা হবে। সাথে সোহাগ থাকবে। গাঁজা কেস থাকবে। নতুন গোলাম হোসেন আসবেন। সায়গল হোসেন যাবেন।

শেষ পাতে, তদন্ত। বীরভূমে গরু পাচার হয়। পাচারের দুই হাত, প্রেরক ও গ্রাহক। প্রেরকের তৎপরতা আলোচিত হচ্ছে, সীমান্তের ওপাশে গ্রাহকের উৎসাহ আছে। বিকিকিনির কড়ি আন্তর্জাতিক সীমানা ভেদ করে আসে। সুতরাং গ্রাহকের অংশে কেন্দ্রীয় সরকারী যোগ আছে। পাচার বিষয়ক বিশ্বকোষ বিশ্ববঙ্গের প্রশাসন জানে। সরকারী তরফে কোন স্হানীয় এজেন্ট পরিষেবা দেবে তাও নির্ধারিত। এসব নতুন কথা নয়। জানার বিষয় মাত্র দুটি (১) বীরভূমে সার্ভিস প্রোভাইডারদের লুন্ঠিত সম্পদের পরিমাণ কত। (১ক) মোট সম্পদের কত অংশ ওয়াশিং মেশিনে ধোলাই হয়েছে। (১খ) অপরিশোধিত বর্জ্য কি দেশে আছে। (১গ) বাজেয়াপ্ত গুপ্তধনের পরিমান কত। (২) নবান্নের সনদ মোতাবেক সাপ্তাহিক খাজনা কত। (আয়ের ৩গুণ হওয়া বাঞ্ছনীয়)। (২ক) খাজনা কীভাবে যেত। (২খ) খাজনার প্রত্যক্ষ গ্রাহক কে। (২গ) সরকারী তরফে চুক্তির অধিকারী কে। প্রথম অংশে তদন্তে কিছু তৎপরতা থাকলেও দ্বিতীয় অংশে পা রাখবে না। মানুষ ভুলে যাবে। কিছু গান স্যালুট হবে। অনুব্রতরা ফিরে আসে অন্য চেহারায়।