চে গোয়েভারা মানে কেবল রোমান্টিক বিপ্লবী? মতাদর্শ বর্জিত রাইফেলধারী গেরিলা যোদ্ধা? লম্বা সুদর্শন চেহারার  চে-র আয়ত চোখের মুখাবয়ব দেখে সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। অনেক তরুণীর কাছে তো ১৯৬০ সালে কমিউনিষ্ট আলোকচিত্রী আলবার্তো কোর্দা’র তোলা ‘গ্যেরিলারি হিরোইকা’ (গেরিলা হিরো) শীর্ষক চে-র আবক্ষ ছবিটি যেন ক্রাশ! কিন্তু এর সবটাই ঠিক নয়।

       চে গোয়েভারা—প্রকৃত নাম আর্নেস্তো গোয়েভারা দে লা সের্না।স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ কথার অর্থ ‘প্রিয়’ বা ‘বন্ধু’।আবেগপ্রবণ আর্নেস্তো তাঁর প্রিয় সকলকেই ‘চে’ বলে সম্বোধন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কালক্রমে ওটিই তাঁর নাম হয়ে যায়। প্রথম জীবন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি একটু একটু করে  খেলাধুলা, সাহিত্য চর্চা সহ নানা বিষয়ে চে-র ব্যুৎপত্তির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।

সাঁতার, ফুটবল, গল্ফ, শ্যুটিং, রাগবি, সাইক্লিং এইরকম নানা ধরনের খেলায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর ভালো লাগার কবিরা হলেন পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল, ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রমুখ। তিনি ভালো আবৃত্তি করতে পারতেন। লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা ৭০টি নিবন্ধ আছে। আছে তাঁর লেখা কয়েকখানি বই। যেগুলি তিনি শহীদের মৃত্যুবরণ করার পরে প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে গেরিলা যুদ্ধ প্রসঙ্গে লেখা তাঁর নিবন্ধগুলিও আছে। আবার এ সবের সঙ্গে তিনি ১৯৫৩ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্নস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা বিদ্যার স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেন। বংশগত ভাবে তিনি ছিলেন আইরিশ। তাই বিদ্রোহ ছিল তাঁর রক্তে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আয়ারল্যাণ্ডের মানুষরা কোনোদিন ব্রিটিশের কাছে বশ্যতা মেনে নেয় নি। যদিও জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনীয়। চে ছিলেন একাধারে একজন মার্কসবাদী, বিপ্লবী, বুদ্ধিজীবী, লেখক, চিকিৎসক, গেরিলা নেতা, গেরিলা যোদ্ধা, সমর বিশারদ, কূটনীতিবিদ ও কিউবা বিপ্লবের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। এককথায় তিনি ছিলেন বিপ্লবের বিশ্বপ্রতীক বা বিশ্বচেতনা।

     চে-র এই বিপ্লব চেতনার  স্ফূরণ ঘটেছিল ১৯৫২ সালে ডাক্তারি পড়া থেকে ছুটি নিয়ে মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকার বেশকিছু দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে। যে ভ্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ  আছে তাঁর ‘মোটর সাইকেল  ডায়েরি’ শীর্ষক রচনায়। এই ভ্রমণ তথা পর্যবেক্ষণ তাঁর সামনে ওই মহাদেশের সবকটি দেশের মানুষের ওপর গেড়ে বসা দারিদ্র ও শোষণকে উন্মুক্ত করে দেয়। উন্মুক্ত করে দেশগুলির স্বৈরাচারী, একনায়কতন্ত্রী ভয়ংকর শাসনকে। এর কারণ হিসাবে তিনি চিহ্নিত করেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে। এর সমাধানের রাস্তা হিসাবে তিনি দেশে দেশে বিপ্লব সংগঠিত করার কথাই ভেবেছিলেন। তিনি সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকাকে আলাদা আলাদা দেশের সমষ্টি বলে কোনোদিনই  মনে করেন নি। বরং এই দেশগুলো একটি অভিন্ন অস্তিত্ব এবং এই দুঃখ-কষ্ট লাঘবের  একমাত্র পথ হল সশস্ত্র বিপ্লব বলে তিনি মনে করতেন।এই ভাবনা থেকেই  তিনি পরবর্তী সময়ে মার্কসবাদে দীক্ষিত গেরিলা যোদ্ধা হয়ে ওঠেন। স্টেথো ছেড়ে হাতে তুলে নেন রাইফেল।

     এছাড়াও চে-র বিপ্লবী চেতনা ও মার্কসবাদী চেতনা গড়ে ওঠার পেছনে ছিল তাঁর পরিবারেরও প্রভাব। বাবা আর্নেস্তো গোয়েভারা লিঞ্চ ও মা সিলিয়া দুজনেই ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। তাঁরা ছেলের ওপর ধর্মশিক্ষার ভার চাপান নি। বরং জোর দিয়েছিলেন ছেলে যাতে মুক্ত শিক্ষার পরিবেশ পায়। তাঁদের পারিবারিক লাইব্রেরিটিও এই প্রশ্নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

        চে-র সমাজবীক্ষা প্রথম তাঁকে যে কাজে প্রাণিত করে সেটি হল গুয়েতেমালার প্রেসিডেন্ট আরবেনজের সরকারকে রক্ষা করার সংগ্রামে অংশগ্রহণ। কিন্তু সে সংগ্রাম ব্যর্থ  হল। চে মেক্সিকোর ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওলজিতে যোগ দিলেন। মেক্সিকোতেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটল কিউবার একনায়কতন্ত্রী বাতিস্তা সরকারের অত্যাচারে বিতাড়িত দুই নেতা ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে। ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে কাস্ত্রো ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে মিলিত ভাবেই তাঁর গোপনে গ্রানমা জাহাজে কিউবা গমন এবং সেখানকার বিপ্লবে অন্যতম নেতা হিসাবে অংশগ্রহণ।দুই বছরের গেরিলা লড়াই শেষে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে বাতিস্তার পতন ও কিউবার বিপ্লব জয়যুক্ত হবার মধ্য দিয়ে এক  ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা হল।

      কিউবার বিপ্লব সফল হবার পর চে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ভূমিকা পালন করেন। কিউবার প্রতিনিধি হিসাবে বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তার মধ্যে আমাদের দেশও ছিল। কিন্তু বিপ্লব যাঁর শিরায় শিরায় তিনি কি এক জায়গায় বাধা পড়ে থাকেন? তাই ১৯৬৫ সালে কিউবা সরকারের কাজে ইস্তফা দিয়ে তিনি চলে গেলেন কঙ্গো। সঙ্গী হলেন তাঁর সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক ও বারোজন যোদ্ধা। প্যাট্রিস লুমুম্বার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহে সাহায্য দিতে এই যাত্রা। ছয় মাস ধরে চলা বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেল নানা দুর্বলতায়। তার মধ্যে অন্যতম কারণ জনবিচ্ছিন্নতা। কঙ্গো থেকে চে-র পরবর্তী গন্তব্য বলিভিয়া। ১৯৬৭ সালের ২৩ মার্চ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট স্বৈরশাসক রাবিয়েন্তোসের বিরুদ্ধে সংঘটিত গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে।চে-র লেখা বলিভিয়ার ডায়েরিতে সেই ভয়ংকর অসম সংগ্রামের বর্ণনা আমরা পাই। কিন্তু সেখানেও শ্রমজীবী মানুষকে গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে সমবেত করায় দুর্বলতা ছিল সেদেশের যোদ্ধাদের। ফলশ্রুতিতে এক কৃষকের বিশ্বাসঘাতকতায় বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গেলেন চে। ধরা পড়ার একদিন বাদে যুদ্ধক্লান্ত, আহত, নিরস্ত্র চে-কে গুলি করে মারল সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। দিনটি ছিল ৯ অক্টোবর,১৯৬৭। একজন বিপ্লবীকে মেরে ফেলতে পারল প্রতিক্রিয়ার শক্তি। কিন্তু বিপ্লবের স্বপ্ন হাজার থেকে লাখ,লাখ থেকে অযুত-নিযুত চোখের তারায় জ্বলে উঠল। সে স্বপ্নকে নস্যাৎ করবে কে? তাই তো লাগাতর অর্থনৈতিক অবরোধ জারি রেখেও কিউবাকে একঘরে করতে পারেনি আমেরিকা। উলটে নিজেরাই একঘরে হয়ে গেছে।  বিশ্বজুড়ে দেড়শোর মতো দেশে প্রায় দু’হাজারের মতো কিউবা সংহতি কমিটি ও মঞ্চ গড়ে উঠেছে।

চিলি, নিকারাগুয়া, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া সহ একের পর এক দেশ মার্কিন নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করে বেরিয়ে এসেছে ও নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। গড়ে তুলেছে ‘আলবা’ , ‘সেলাক’-এর মতো নিজেদের বিকল্প সংগঠন। আজ লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে দক্ষিণপন্থীদের বিপরীতে বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোর রমরমা। সেসব ক্ষেত্রে হাজার চে লড়াইয়ের ময়দানে। সারা দুনিয়া জুড়েই চলছে সে লড়াই। আর এই লড়াইয়ে কিউবা একটি আলোকবর্তিকা। এইখানেই চে-র আত্মত্যাগের সার্থকতা। তাই চে-কে রাজনীতি ও মতাদর্শ বর্জিত রোমান্টিক হিরো বানাতে চায় লগ্নি পুঁজি ও কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা। তাঁকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায় মদের বোতল কিম্বা গেঞ্জি-টুপির বিজ্ঞাপনে অথবা বাহু-বুকের উল্কিতে। চে থাকুন আমাদের চেতনার তন্ত্রীতে। কারণ চে মানে অসীম প্রতিস্পর্ধা, চে মানে শ্রেণি শত্রুর প্রতি ঘৃণা, চে মানে বিপ্লবের বিশ্বচেতনা, চে মানে মার্কসবাদের  প্রতি গভীর প্রত্যয়। গেরিলা যুদ্ধ প্রসঙ্গেও চে-র সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি—জনভিত্তি চাই। যেখানে শাসকের সামান্য হলেও, এমনকি মেকি জনভিত্তি আছে সেখানে গেরিলা যুদ্ধ সম্ভব নয়। এই কারণেই আমাদের দেশে তার প্রাসঙ্গিকতা নেই। ঠিক একই কারণে কঙ্গো ও তৎকালীন বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধ ব্যর্থ  হয়েছিল।চে কন্যা ডাক্তার অ্যালেইদা গোয়েভারা ও দৌহিত্রী অধ্যাপিকা এস্তেফানিয়া গোয়েভারা আমাদের বাংলায় এসেছেন সমাজতান্ত্রিক কিউবার অগ্রগতি ও কিউবা সহ গোটা লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক সংগ্রামের অগ্রগতির  বার্তা নিয়ে। বাংলার আপামর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জনতা প্রস্তুত তাঁদের অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করতে এবং কিউবা সহ সমগ্র লাতিন আমেরিকার সংগ্রামের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করতে।