শিল্পমন্ত্রীত্ব সহ দেশের একাধিক বড় বড় পদ ও দায়িত্ব ছেড়ে, এমনকি, দেশের নাগরিকত্বটাও ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন চে গ্যেভারা। অন্য দেশে। ভিন্ন মহাদেশে। সেখানকার মানুষের মুক্তির যুদ্ধে রাইফেল হাতে লড়তে।

মাথা উঁচু রেখে মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত চে ছেড়ে গেলেন পাঁচ সন্তানকে। ছোট্ট চিরকূটে বিদায় জানালেন তাদের। লিখলেন: “… এই দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে যেকোনো কারুর সাথে ঘটা যেকোনো অন্যায় যেন তোমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারে। মনটাকে সবসময় এমন করেই প্রস্তুত রেখো। জেনো, এটাই একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে বড় গুন। …বাবার কাছ থেকে মস্ত একটা চুমু।”

আলেইদার বয়েস তখন সবে পাঁচ। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সে মেজ। লেখাপড়া শিখছে স্কুলে, অক্ষর পরিচয় হয়েছে। কিন্তু আস্ত একটা চিঠি গড়গড় ক’রে পড়ে ফেলার মতন ততটাও কি বড় হয়েছে তখন? বোধহয় মা-ই সেদিন প’ড়ে শুনিয়েছিলেন বাবার চিঠিটা।

সেদিনের পুচকে মেয়েটা এখন প্রবীণ। বয়স বাষট্টি। স্বনামধন্য চিকিৎসক আলেইদা গ্যেভারা। মেয়ে এস্তেফানিয়ার সাথে বাংলায় আসছেন।

 ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কার মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রীও বাংলায় এসেছিলেন বটে। নেমেছিলেন দমদম বিমান বন্দরে। বাইরে হাজার মানুষের বিক্ষোভে স্লোগান উঠেছিল ‘গো ব্যাক’। ফিরে যেতে হয়েছিল তাকে, বিমানবন্দরের বাইরে বেরোনোর হিম্মত হয়নি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একরত্তি ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ধর্ষ লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত চে সেদিন ডাক দিয়েছিলেন: “দুটো তিনটে অনেকগুলো ভিয়েতনাম গড়ো”।

Che visiting a school in the Pilana Block near Delhi. Photo courtesy Photo Division, Government of India.

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই, ভিয়েতনাম, চে গ্যেভারা, দমদম বিমানবন্দর। পুরনো সেই বিন্দুগুলোই জুড়ে যাচ্ছে জানুয়ারি ‘২৩-এ। 

যেখান থেকে ম্যাকনারাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলা, সেখানেই চে’র উত্তরাধিকারীদের বরণ করবে এবার। বোমায় ঝলসানো নাপামের ক্ষুদে মেয়েটির জন্যে উদ্বেল সেদিনের কলেজস্ট্রীটে এবার কিউবার সংহতিতে জড়ো হবেন অযুত মানুষ।

আন্তর্জাতিক সংহতির এই বোধ আসে কোত্থেকে?

দুনিয়াব্যাপী বিস্তৃত একটা শেকল; তাতেই বাঁধা পড়ে আছি সকলে। আমাদের সকলেরই হাতে, পায়ে, গলায় সেই একটাই শেকলেরই দাগ। যত দূরের দেশেই থাকি একে অন্যের থেকে, মাঝে যতই আস্ত মহাসাগর থাকুক কিংবা ভিন্ন মহাদেশ— অভিন্ন শেকল থেকে মুক্ত হতে চাইছি সকলে। অভিন্ন এই আকাঙ্খাতে, সংগ্রামের অভিন্ন নির্যাসেই উৎসারিত হয় সংহতির বোধ। একাত্ম হই পরস্পরের সাথে। আমার নামও পাল্টে হয়ে যায় ‘ভিয়েতনাম’, তোমারও তাই।

শেকলটাকে নির্ভুল চিনিয়েছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন। কাগজে কলমে দেখিয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ আদতে পুঁজিবাদেরই সর্বোচ্চ স্তর। হাতে কলমে শিখিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলটির দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাত করার কায়দা। শতেক বছর পরে, আজও তাই, লেনিনের নাম শুনলে ঘুম ছুটে যায় দুনিয়াদারির মালিকদের।

The last photo taken of Vladimir Lenin alive

বদলে যাওয়া সময়ে প্রাসঙ্গিক থাকতে হ’লে বামপন্থীদের পরিত্যাগ করতে হবে যত বস্তাপচা ধ্যানধারণা। সরে আসতে হবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার রাস্তা থেকে। ভুলতে হবে লেনিনকে। হরবখত এই এক পরামর্শ দিয়ে চলেছে তারা। কেউ স্পষ্টভাবে, কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে।

সত্যি সময় বদলে গেছে অনেক। লেনিনের সোভিয়েতও আর নেই। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদও কি আর নেই?

গোটা বিশ্বকে মুঠোয় পোরার বাসনায় আরব দুনিয়ায় কারা যুদ্ধে যায় তবে? আস্ত প্যালেস্তাইনকে কবরখানা বানিয়ে রেখেছে কারা? কারাই বা বোমায় মারে, খিদেয় মারে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শিশুদের আজও? যুদ্ধে আর দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষকে উদ্বাস্তু বানিয়ে ছাড়ছে কারা? কিউবাকে অর্থনৈতিক অবরোধে মুখে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তবে কে?

পৃথিবীর দেশে দেশে কাদের নির্দেশে তামাদি হচ্ছে খনি, জমি; পুড়ে খাক্ হচ্ছে জঙ্গল? কাদের বানানো নীতিতে দেশে দেশে জনতার সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে বহুজাতিকের হাতে? আমাদের দেশেরও রেল, ব্যাঙ্ক, বীমা, প্রতিরক্ষা শিল্প, এমনকি কৃষিক্ষেত্রটাও কর্পোরেটদের মুনাফার মৃগয়াক্ষেত্র বানানোর প্রয়াস?

দেশে দেশে বিশাল বেকারবাহিনিকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে শ্রমশক্তির দাম কমিয়ে ফেলার দাওয়াই বাতলাচ্ছে কারা? বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের দাওয়াই মেনে দেশে দেশে চালু হচ্ছে নতুন শ্রমনীতি। সকলেরই আঁতের কথাটা এক। মজুরি কমিয়ে, শ্রমসময় বাড়িয়ে, কাজের নিরাপত্তা-স্থায়ীত্ব কেড়ে নিয়ে, শ্রমিকদের দরকষাকষির শক্তিকে কমিয়ে দিয়ে, শ্রমিকশ্রেণিকে প্রতিরোধক্ষমতাহীন বানিয়ে, ইউনিয়ন ও ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করার কৌশলে আমাদের দেশের সরকারও এনেছে শ্রমকোড। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে যতটা নমনীয় করা যায় তার জন্যে একই রকমের সংস্কারের পথ নিচ্ছে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সরকারগুলোও। সার, বীজ, জ্বালানি, রেশন থেকে সরকারি শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের পথ নিচ্ছে। এমনি এমনিই নয়; দুনিয়াজোড়া শেকলটারই নিয়ম মেনে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন নির্দেশিত অভিমুখেই।

 লেনিনের সময়ের থেকে অন্যরকম চেহারায় থাকলেও;  সাম্রাজ্যবাদ আছে। ভরপুর আছে, আছে প্রবলভাবেই। তাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইকেও থাকতেই হবে। আগের চেয়েও জোরালোভাবেই থাকতে হবে। আর থাকতে হবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের আন্তর্জাতিক সংহতিকেও। এসব শব্দ উচ্চারণে যে যতই নিষেধ করুক, ভুরু কোঁচকাক, নীতির প্রশ্নে অনড়তা ভিন্ন পথ নেই। বাঁচার পথ নেই কোনও আর।

দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের জন্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নে এমন অনড়তাই শিখেছে কিউবা। সিয়েরা মায়েস্ত্রার দিনগুলি থেকে। অরন্যে, পাহাড়ে, আঁখক্ষেতে, গ্রামে, বন্দরে, বিপদসঙ্কুল অজস্র অলিতে গলিতে গেরিলা পদচারণায়। বিপ্লবের প্রস্তুতিতে কারখানায়, মিলে, শহরের রাস্তায় ধর্মঘটের পিকেটিংয়ে। কিউবা বিপ্লব সম্পন্ন করার পর সে বিপ্লবকে রক্ষা করার দায়িত্ব কমরেডদের হাতে সঁপে গেরিলা পোষাকে চে-র কঙ্গোতে চলে যাওয়ায়। মুক্তির যুদ্ধে। তারও পরে বলিভিয়ায়।

জানা যায়, সিআইএ-র মদতপুষ্ট বলিভিয়ান সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ার পর একটা ছোট্ট স্কুলঘরে নিয়ে যাওয়া হয় চে গ্যেভারাকে। ১৯৬৭-র অক্টোবর ৮-এ। পরের দিন সকালে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখায় একটা ব্যকরণের ভুলের দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সে স্কুলের যুবতী শিক্ষিকাটির। তাঁকে চে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “শিশুদের স্কুল এত অপরিচ্ছন্ন কেন”!

হাত দুটো পিছমোড়া ক’রে বাঁধা, পা দু’টোও বাঁধা, হাঁটুর তলা বুলেটবিদ্ধ। অত্যাধুনিক বন্দুক তাক্ করেছেন বলিভিয়ান সৈন্য মারিও তেরান। মৃত্যুর থেকে কয়েক সেকেণ্ড দূরে শিকার করা আহত শুয়োরের মতো মেঝেতে শুইয়ে রাখা চে কী ভাবছিলেন তখন? শোনা যায়, সে কথা নাকি তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। চে’র চোখ ছিল উন্মিলিত, মুখে ছিল ছোট্ট জবাব- ‘বিপ্লবের অমরত্বের কথা’।

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায়, মুক্তির বাসনায় এমনই দৃঢ়তা যাকে খোদ মৃত্যুও টলাতে পারে না। এমনই অনড়তা শিখিয়েছেন আর্নেস্তো গ্যেভারা। আমাদের চে।

 বাষট্টি বছরের আলেইদা সেই শিক্ষা নিয়েই আসছেন কিউবা থেকে। বাষট্টি বছরের মার্কিন অবরোধ সত্বেও যে কিউবা এক ইঞ্চি সরে আসেনি তার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে। এই গ্রহের প্রতিটি প্রান্তে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা থেকে।

কিউবার এহেন অনড়তার প্রতি আমাদের সংহতিকেও আমরা নড়তে দেব না। আলেইদাকে, এস্তেফানিয়াকে গণসম্বর্ধনা দেওয়ার ছুতোয় গোটা দুনিয়াকে এই কথাটুকু জানিয়ে দেবে পশ্চিম বাংলা। আরো একবার।