আমি কি চোর? এক সাঙ্ঘাতিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বরিষ্ঠ মন্ত্রী। কেউ চোর কিনা নির্ণয় করার অধিকার জনগনকে ভারতীয় সংবিধান দেয়নি। মন্ত্রী মহোদয় বামপন্হী নেতা ও সাংসদ এবং এক বিজেপি নেতার সার্টিফিকেট প্রার্থী। দলনেত্রী বা সেনাপতির সই করা ছাপানো সার্টিফিকেটে নিজের নাম লিখে সততার প্রমাণ দাখিল করতে পারতেন। সেই মানপত্র যে অচল পয়সা হয়ে গেছে তিনি বিলক্ষণ জানেন। তৃণদলের মঞ্চ থেকে সততার দাবী বালখিল্যতা। জনগন নিরপেক্ষ থাকার ভান করে। শিব্রাম চক্কোত্তিকে একদা এক বিতর্ক সভার প্রধান অতিথি করতে চাইলে সেই লেখক জিজ্ঞাসা করেন, উনি কোন পক্ষের পক্ষে কথা বলবেন? আয়োজকরা বোঝান, আপনি প্রধান অতিথি, সুতরাং আপনাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। শিব্রাম বুঝলেন, বেশ, কিন্তু কোন পক্ষের পক্ষে আমাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, সেটা বলে দেবেন। মঞ্চে মাইক হাতে পাওয়ার ড্রেস করা মন্ত্রীকে নিরাপদ মনে হয়। যেন তিরে বাঁধা ডিঙি নৌকা। কিন্তু নৌকার কাজ দরিয়ায় ভাসা। সুযোগ পেলে স্যান্ডোগেঞ্জিতে কাজ হাসিল।

মনে করুন, পঞ্চায়েত ভোটে সাতমহলা বাড়ি থেকে পঞ্চায়েত প্রধান বেরিয়ে এসে সটান প্রশ্ন করলেন, “আমি কি চোর?” যাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও গেল বর্ষায় ভেঙে গেছে, যাঁরা বাংলা আবাঁশের অনুদান ভিক্ষা করতে এসেছিলেন, তাঁরা জিভ কেটে বললেন, ছিঃ ছিঃ, এসব কী বলছেন। শুধু মুখের কথা নয়, পঞ্চায়েত ভোটে দেখা গেল সেই মাতব্বর পঞ্চায়েত প্রধান বিপুল ভোটে জিতেছেন। কোথাও পঞ্চায়েত দখল করতে না পারলেও বিরোধী জয়ী প্রার্থীরা উন্নয়নের সুইমিং পুলে ঝাঁপ দিয়ে ঢেউ তুলে দিয়েছেন। ফলে আপনার পেটে ভাত নেই বলেই যে শোষক চোর, এমনটা বলা যাবে না। শোষকের কাজ শোষক করেছে, জনগন তাঁদের কাজ করতে পারেননি। ফলে উনি চোর হলেই বা ইতর বিশেষ কোন ফারাক থাকবে না, সাধু হলে তো কথাই নেই। এমনকি দলনেত্রী বলেছেন, আগে (চোর) জানলে টিকিট দিতেন না। টিকিট তো দূরের কথা নারদবাবু মন্ত্রীত্বে বহাল হয়ে গেলেন। ফলতঃ আর কেউ না বুঝুক দলনেত্রী জানেন কোন বীণ কীভাবে বাজালে জনগন সাপের মত মাথা দোলাবে। দুঃখের কিছু নেই।

আপনি কে? আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখছেন, তার উপর নির্ভর করে আপনি কী দেখছেন। “Beauty is in the eye of the beholder.” আপনার পরিচিত বা আত্মীয়, কেউ কি টাকা দিয়ে চাকরি কিনেছে? আপনার স্ত্রী কি গয়নার দোকান থেকে ফেরার পথে ব্যাঙ্কে গিয়ে লক্ষ্মী ভান্ডারের টাকা জমা পড়ল কিনা খবর নেন? আপনার সন্তান কি ক্লাবের পরিকাঠামো উন্নয়ন ভাতায় মাতাল হয়ে যান? আপনার এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকলে মন্ত্রী চোর নন। গরীব গুর্বোদের ধারণা মন্ত্রীর বাপের গুপ্তধন থেকে রেশনের চাল আসে। ফলে মন্ত্রী রত্নাকর না বাল্মীকি তাতে কিছু যায় আসে না। মন্ত্রী আসলে প্রশ্ন করেছেন আপনাকে, ‘আপনি কি চোর?’ তাই বেশীর ভাগ লোক মুখ লুকিয়েছেন। আসল সমস্যা ছুটির দিনে তিনি শ্রাদ্ধ না করে তদন্তকারী সংস্হার আধিকারিকদের চা জলখাবার দিচ্ছেন। মুখে বলছেন, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। সেটা আরো বড় কোন চোরের উদ্দেশ্যে। সেই চোরের নিরিখে হয়ত মন্ত্রী সেরকম বলবার মত চোরই নন। সবটাই দৃষ্টিভঙ্গীর তফাৎ। বড় চোরের আশ্বাস ছিল তদন্তহীন দুর্নীতির অবাধ লাইসেন্স।

প্যালেস্তাইনের হয়ে হামাসরা ইজ্রায়েলের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করেছে। ইহুদীরা বিশ্ববাসীকে অনেক কিছু দিয়েছেন। মোজেস বলেছিলেন, আইনই সব। সেই আইন যখন যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করল, তখন যীশুর কথা ছিল, ভালবাসাই সব। কার্ল মার্ক্সও একজন ইহুদী ছিলেন, তিনি বললেন, আপনার না খেতে পাওয়ার অসুখটা ভালবাসায় সারবে না। পুঁজিই সব। পুঁজিতে পেট ভরলেও নাকি অসম্পূর্ণতা, থেকে যায়। তখন ফ্রয়েডের বাণী, মনটাই সব। শেষ পর্যন্ত অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এসে বললেন, সবই আপেক্ষিক। এবার ইজ্রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বললেন, শুরু করেছে ওরা, শেষ করব আমরা। কিন্তু ওরাটা কারা? যে মন্ত্রী প্রশ্ন করছেন, আমি কি চোর? নাকি, সেই মন্ত্রী যাকে বলছেন, ছিঃ ছিঃ ছিঃ- তিনি? এই গোলকধাঁধায় জনগন ঘুরতে থাকবে আর ২০২৪এর নির্বাচনটা সেই মন্ত্রী এবং তাঁর ছিঃ ছিঃ ছিঃ বস পকেটে পুরে নেবেন। একদিন ব্যতিক্রমী মাননীয় বিচারকরা অবসর নেবেন। অতঃপর মন্ত্রীর ধারণা তাঁর মৃত্যুর পর ক্লিন চিটের সার্টিফিকেট চলে আসবে ভারতীয় সংবিধানের নিরপেক্ষ পক্ষ থেকে।

তিনি চোর কিনা, নিশ্চিন্ত হবার জন্য আদালতে যাওয়া উচিৎ ছিল। সেনাপতি অনেক নিশ্চিত বলে শীর্ষ আদালতের দরজায় কপিলমুনিকে (কপিল ও মনু) বসিয়ে রেখেছেন রক্ষাকবচের কড়া নাড়ার জন্য। MGNREGA বা বাংলা আবাঁশের প্রাপ্য টাকার দাবী পলকা বলে আদালতে যাচ্ছেন না। নাটক হচ্ছে রাজঘাটে, গিরিরাজ ভবনে, রাজভবনে। সবটাই রাজকীয় ব্যাপার। জনগন যেন বুঝতে পারেন সেনাপতি কোন পাথর সোজা রাখছেন না, কিন্তু সঠিক পাথরে হাত দিচ্ছেন না। সেই মন্ত্রী এক রাত প্রেসিডেন্সি জেলে নারদের অপবাদে কাটিয়ে এসেছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে নিজাম প্যালেসে দরবার করতে চলে আসেন। অতএব সেই প্রভাবশালীর দিকে তাকিয়ে জনগন বলবেন, রাজা, আপনার পোষাক কই? তেমনটা ভাবাটা অবান্তর। সেই ভরসাতেই তো তাঁর প্রশ্ন। জনগনের মেরুদন্ড ও সততা থাকলে উত্তর এক রকম হবে, নয়ত মন্ত্রীর মত আরো বড় চোরের দিকে তাকিয়ে বলবেন, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ব্যাপারটা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বে চলে গেল। একটা চোরের সাথে আরো বড় চোর সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

আপনি যেমন, আপনার নেতা মন্ত্রী তেমনই হবে। আপনি কি সেই চোর নেতাকে ভোট দিয়ে এসে আপনার সন্তানকে বলতে পারবেন, চুরি করা অন্যায়? ফলে সেই নেতার সৌজন্যে আপনি উত্তর পুরুষকে চোর বানাচ্ছেন। তারপর আপনি চায়ের দোকানে বাকীতে চা খেয়ে কান চুলকে বলবেন, সমাজটা উচ্ছন্নে গেল। বিএলআরও দপ্তরে টাকা গুঁজে পুকুর ভরাট করবেন। আপনাকে বাঁচতে চোর নেতার প্রয়োজন। চোর নেতার আপনাকে প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ নেতা মন্ত্রীর ধারে কাছে ঘেঁষে না। আপনি চেনেন ও জানেন, যে মন্ত্রী প্রশ্ন করছেন, তার উত্তর- হ্যাঁ, আপনি চোর। কিন্তু একটা চোর কখনও অন্নদাতা চোরকে কালিমালিপ্ত করতে পারে না। ঘুরে ফিরে সেই আপেক্ষিক তত্ত্বে ফিরে এল। আপনার গলায় সোনার চেন থাকলে আপনি পুকুর চোর, আর কালো সুতোয় মাদুলি থাকলে লক্ষ্মী ভান্ডার চোর। আপনি ভাববেন, এই মন্ত্রীর উপর সেনাপতি চোর আছেন, তার উপর চোরের রাণী, তার উপর আছেন দিল্লীর বাদশাহ চোর। সেই তুলনায় আপনি নেহাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নগন্য মুরগী চোর।

এই মন্ত্রী যদি ভুল করে প্রশ্ন করে বসেন, আমাকে যারা ভোট দিয়েছেন, তারা কি চোর? মন্ত্রী তো কারো কাছে হাত পেতে দু নয়া নেননি। ভগবান কি প্রণামী নেন, নাকি বাক্সে ফেলতে হয়? তাহলে বাক্স চোর। দিল্লীর বাদশাহের দরবারে আম, দই, নয়া কুর্তা-পাজামার সাথে পদিপিসির বর্মী বাক্স যায়। সব প্রশ্নের উত্তর সোচ্চারে হয় না। মুখ্যমন্ত্রী যদি প্রশ্ন করেন, তিনি কি ধর্ষণের পক্ষে? তিনি এমন কদাপি দাবী করেননি, বরঞ্চ ধর্ষণের রেট জারি করেছেন। কিন্তু নির্ভয়া কান্ডে খুনী ধর্ষকদের যে চরম শাস্তি হয়েছে, বাংলায় তা হবার নয়। দিল্লীর বাদশাহ কি কখনও বলেছেন, বাংলায় কোন দুর্নীতির তদন্ত শেষ হবে না? কিন্তু হয়নি। চোর, ধর্ষক, দুর্নীতিগ্রস্ত জনগন এঁদের সমর্থনের মূল ভিত্তিভূমি। সেই চোর, ধর্ষক, দুর্নীতিগ্রস্তরা নিজেদের দোষ কবুল করবে না বলে, নেতা মন্ত্রীদের দিকে আঙুলও তুলতে পারবে না। ফলে নেতা, মন্ত্রীরা সর্বদা জনগনকে প্রশ্ন করেন। আমি কি চোর? মদন চোর, কুনাল চোর, টুম্পাই চোর, মুকুল চোর, আমি চোর? কালাধন ওয়াপস আনা চাহিয়ে ইয়া নেহি আনা চাহিয়ে?

সবুজ, গেরুয়া জনগন তাঁদের চোর, ধর্ষক নেতাদের জন্য হাততালি দেয়। মাঝে সবুজ মঞ্চের নেতা গেরুয়া মঞ্চে চলে যায় বা গেরুয়া নেতা সবুজে বিক্রী হয়। একই জনতা হাততালি দেয়। মেরুদন্ডহীন সেই মীরজাফরদের জন্য স্যান্ডোগেঞ্জি পরে ঘুষ খাবার পরেও প্রশ্ন করতে পারেন। আসলে চোর জনতা ওনাদের চোর বানিয়েছে। সমাজে চোরদের সংখ্যা কমাতে হবে, শিক্ষা বাড়াতে হবে, ফেক ডিগ্রী ঘৃণা করতে হবে, পোষা সুশীলদের কবর দিতে হবে, পরিবারতন্ত্রের মুখে আগুন জ্বালিয়ে বাপ-দাদুর বয়সী ক্রীতদাসদের স্বাধীনতা দিতে হবে। মধ্য যুগীয় বর্বরতা আধুনিক কালে অচল। দশ পয়সা দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারলে শহীদ মিনারে নিজে ফাঁসীর দড়ি পরার বাসনাকে নিষ্কলুষ জোকারের রসিকতা ধরতে হবে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ দিল্লীশ্বর চোর, দুর্নীতি কখনও প্রমাণ করবেন না। সেই ভরসায় চোররা আপনাদের প্রশ্ন করছে। হেলিকপ্টার চড়বে, হাসবে, রক্ষিতার খাটের তলায় নোট জমাবে। আপনার ঘরে আঁধার ঘুচবে না। চুরির কেরোসিনের বাতি বেশী দিন জ্বলবে না। জনগন শুদ্ধ হোন, চোররাও মানুষ হবে।

সমাজসেবা করে এই বদনাম নাপসন্দ। চোরদের আচার আচরণ সংযত হলে ভাল। প্রভাবশালী দেখাতে গিয়ে আড়ম্বর করে ফেলেন। সমাজসেবা করে কীভাবে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে যান? অনেকে ব্যবসা করে হাতে হ্যারিকেন ধরে বাড়ি ফেরেন, আবার অনেক আঙুল কলাগাছ হয়ে যায়। একই অফিসে একই পদে চাকরি করে কেউ হেলেঞ্চা শাক কেনেন, কেউ রেওয়াজী খাসীর দোকানে লাইন দেন। আপনার মনের ভিতর যে সমাজসেবার প্রাচীণ ধারনা আছে, সেখানেই গোড়ায় গলদ। যারা পারেন, তারা পারেন। হ্যাঁ, সমাজসেবা করেও বড়লোক হওয়া যায়। বুদ্ধিমান টালির বাড়িটা ছাড়েন না, কারণ স্ফূর্তির জন্য তো মাদ্রিদের হোটেল আছে। বোকারা শান্তিনিকেতন রাজপ্রাসাদে পুলীশ প্রহরায় ঘুমোন। আমরা জানি, চোর ভোটাররা সৎ নেতা মন্ত্রীদের ভাল থাকতে দেবেন না, কিংবা সততার বিজ্ঞাপন দিলে জামানত চলে যাবে। এনারা কেউ চোর ছিলেন না। জনগন চোর বানিয়েছেন। সেই চোররা দল বানিয়েছেন। সেই দল সরকার চালাচ্ছে। আমরা চুপ আছি, মানে মৌনং সম্মতি লক্ষণং।