আদরণীয় চৌকিদারজী, মানে আমাদের দেশের স্বঘোষিত চৌকিদারকে নিয়ে কয়েকটি কথা বলতেই হচ্ছে। অতি সম্প্রতি চৌকিদারজীর বড়ো বড়ো কথার ঢোল একেবারে ফেটে চৌচির। এর আগে ঢোল ফেঁসেছে বারবার। যেমন—‘কালা ধন’ ধরবার নামে নোটবন্দিতে। প্রায় ১০০ শতাংশ কালো টাকাই সাদা হয়ে গেল। তারপর এক কর কাঠামোর নামে তৈরি জি এস টি তে বিপুল করের চাপে সব জিনিসের দাম হল আকাশছোঁয়া। দুর্গতি ভোগ করল আম জনতা ও ছোটো ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বিপুল করছাড়ের সুবিধা পেল দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা। এরপর এল কর্পোরেট বান্ধব কৃষি আইন। এক বছর ধরে কৃষকদের মরণপণ সংগ্রামে ফিরিয়ে নিতে হল সে আইন। মুখ পুড়ল চৌকিদারের। জলের দরে দেশের সম্পদ কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দেবার ঘটনাও দেশজুড়ে আম আদমির মনে জোরালো প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল তিনি চৌকিদার আসলে কাদের? দেশের গরিব-গুর্বো সাধারণ মানুষের না কর্পোরেটদের। আর গত দুই সপ্তাহে আমেরিকান ফিনান্সিয়াল ফরেন্সিক রিসার্চ ফার্ম ‘হিন্ডেনবার্গ’ তাঁর একান্ত প্রিয় ধনপতি গৌতম আদানি তথা আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কেলেঙ্কারি উন্মোচিত করে দেওয়ায় ও জনসমক্ষে প্রকাশ করায় চৌকিদার সে প্রসঙ্গে মুখে কুলূপ এঁটে মৌনিব্রত গ্রহণ করেছেন।

চৌকিদারজীর কঠোর চৌকিদারির মধ্যেই আদানি গোষ্ঠী বা  গ্রুপ বিদেশে বেনামি শিখন্ডি  কোম্পানি তৈরি করে  কারচুপি করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে জালিয়াতি করে বিপুল শেয়ার বিক্রি করেছে ও মাত্র তিন বছরে নিজেদের সম্পত্তির পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১২০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে। ভারতীয় টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ হল ১১লক্ষ কোটি    টাকা। পরিণামে বিশ্বের তৃতীয় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে গৌতম আদানি। আদানির শেয়ার কেনায় সর্বাগ্রে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারতীয় জীবন বিমা নিগম (এল আই সি)। তাদের কেনা শেয়ারের দাম ৮১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। হিন্ডেনবার্গের তথ্য সামনে আসায়   শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় সেই শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরাসরি লোকসান ৩৮ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এইভাবে আদানিরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চড়া দামে শেয়ার বেচে বিপুল সম্পদ দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া(এস বি আই)। আনুমানিক ক্ষতি ২৭ হাজার কোটি টাকা। তবে তারা এখনও তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাপ করে উঠতে পারে নি। এছাড়াও পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পি এন বি) ও ব্যাঙ্ক অব বরোদার কাছে আদানি গোষ্ঠীর ঋণ যথাক্রমে ৭ হাজার ও ৪ হাজার কোটি টাকা। এতগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দিয়ে কৃত্রিম চড়া দামে  আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনানো অথবা ওই সংস্থাগুলি থেকে আদানিদের বিপুল ঋণ প্রদান সবই চৌকিদারজীর বদান্যতায়। ফলস্বরূপ জনগণের অর্থ লুঠতরাজ চালাতে পারল আদানিরা। এল আই সি-তে ২৯ কোটি বিমার গ্রাহক ও এস বি আই-তে ৪৫ কোটি গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে। নির্লজ্জ আদানিরা  বিপুল শেয়ার পতনের পরেও ‘ফলো আপ পাবলিক অফার’ (এফ পি ও)-এর নামে আবার শেয়ার বিক্রি করে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা চালায়।২০ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রিও হয়ে যায় এইভাবে। তারপর শেয়ার বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য হয় আদানিরা। কিন্ত এত কান্ডের পরেও শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ‘সেবি’ এখনও কোনও তদন্তের নির্দেশ দেয় নি।এখন চৌকিদারজী মুখে কুলুপ আঁটলে অথবা ওঁর দলবল হিন্ডেনবার্গকে গাল পাড়লে রেহাই মিলবে? যে প্রশ্ন আগেই একটু একটু করে উঠতে শুরু করেছিল তা ক্রমশ সুনামির আকার নিতে চলেছে—চৌকিদারজী আপনি কাদের হয়ে চৌকি দিতে নেমেছেন???

আদানির এই বিপুল শেয়ার জালিয়াতিতে বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা। তাদের সাতটি সংস্থায় শেয়ারের দাম কমেছে গড়ে ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ হারে। মাঝখানে দুদিন উঠলেও ফের মুখ থুবড়ে পড়েছে আদানি গোষ্ঠীর সব সংস্থার শেয়ার। গোষ্ঠীর ১০টি সংস্থার মধ্যে আদানি এন্টারপ্রাইজেসের পতন প্রায় ১১%। গোষ্ঠীর শেয়ার হোল্ডাররা সার্বিকভাবে শেয়ার সম্পদ হারিয়েছেন ৪৯ শতাংশ। এই শেয়ারের সিংহভাগ অংশের ক্রেতা হল রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থা। তাই  আদানির থেকে লোকসান বেশি দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থার। তারা চৌকিদারজীর নির্দেশেই চড়া দামে আদানির শেয়ার কিনে এখন বিপুল লোকসানে ডুবেছে। এ ক্ষতি দেশের ও দেশের জনগণের। অথচ চৌকিদারজীর নির্দেশে এই জালিয়াতির তদন্ত কোনও সরকারি সংস্থাকে দিয়ে করানো হবে না। এমনকি বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী যৌথ সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেও এই কেলেঙ্কারির তদন্ত করা যাবে না। সম্প্রতি দেশের সুপ্রিম কোর্টের অনুসন্ধান কমিটিতেও চৌকিদারজী নিজের লোক বেশি করে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।  তার অর্থ প্রহসন ছাড়া কিছুই হবে না। এই বিপুল কেলেঙ্কারির রহস্য কোনোদিনই উন্মোচিত হবে না।

এখন প্রশ্ন আদানিদের সঙ্গে চৌকিদারজীর সম্পর্কটা কী? জানা যায় চৌকিদারজীর গুজরাট জমানায় এই আদানি ভাইব্রান্ট গুজরাটের ধারণাকে সামনে আনতে ব্যবসায়ীদের জড়ো করেছিলেন। বিনিময়ে গুজরাটে তাদের ব্যবসার বিপুল  বৃদ্ধি ঘটে। চৌকিদারজীর ইজরায়েল সফরের পরেই সেখানে আদানিদের একের পর এক বরাত জোটে। এমনকি ভারত-ইজরায়েল প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আদানির হাতে চলে যায়। কী সব্বোনেশে ব্যাপার! চৌকিদার অস্ট্রেলিয়া সফরে গেলেন। কোন জাদুতে সেখানকার স্টেট ব্যাঙ্ক আদানিদের ব্যবসার জন্য বিপুল ঋণ দিয়ে দিল! চৌকিদারের বাংলাদেশ সফরের  সময় বিদ্যুত বিক্রির সিদ্ধান্ত হল, বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন পর্ষদের সঙ্গে আদানির পঁচিশ বছরের চুক্তি হয়ে গেল। গত ২০২২-এর জুন মাসে শ্রীলঙ্কার বিদ্যুত পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রকাশ্য শুনানিতে বলেছেন যে, রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষে তাঁকে জানিয়েছেন ভারতের চৌকিদার আদানিকে সরাসরি প্রকল্প দিতে চাপ দিচ্ছেন। 

তাই প্রশ্ন উঠছে এবং উঠছেই—চৌকিদারের কয়টি বিদেশ সফরে গৌতম আদানি সফরসঙ্গী ছিলেন? কয়টি সফরের মাঝখানে তিনি যোগ দিয়েছেন? কয়টি সফরের পরেপরেই তিনি গেছেন ও বরাত পেয়েছেন?

পরতে পরতে কেলেঙ্কারির অধ্যায় উন্মোচন পর্বে উঠে এসেছে আজ থেকে সাত বছর আগের আর এক কেলেঙ্কারির কথা। ২০১৬ সালে গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানির নাম উঠে এসেছিল পানামা পেপারের বিশ্বজোড়া অর্থ পাচার কেলেঙ্কারির ঘটনায়। সেই সময় পানামা পেপারস্ বিশ্বের বিভিন্ন করমুক্ত (ট্যাক্স হেভেন) দেশে বেআইনিভাবে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা যে বিপুল অর্থ  মজুত করেছে তার রিপোর্ট প্রকাশ করে। ভারতে এইরকম কর্পোরেটদের মধ্যে ছিল আদানি গোষ্ঠী। হিন্ডেনবার্গ যেমন শেয়ার দরের কারচুপি ও জালিয়াতিতে অর্থ লোপাটের কথা জানিয়েছে, সেই রকমই সাত বছর আগের অর্থ লোপাটের তথ্য সামনে আনে পানামা। এই খবরে তোলপাড় পড়ে যায় বিশ্ব জুড়ে। বিভিন্ন  দেশে এই আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেবল ভারতে ছাড় পেয়ে যায় আদানি গোষ্ঠী। তখনও চৌকিদারজী দিল্লির মসনদে আসীন স্বমহিমায়।

এ কেবল আদানিদের জন্য চৌকি দেবার কাহিনি নয়। এ হল বিশ্ব লগ্নিপুঁজির ও ধান্দার ধনতন্ত্রের পক্ষে পাহারাদারির ব্যবস্থা। চৌকিদার নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল সেই কাজই করে চলেছেন গত ৯ বছর ধরে। অর্থাৎ বিপুল পুঁজির মালিকদের সেবাদাসত্ব। এ কাজে পিছিয়ে নেই তাঁর বহেনজীও। অর্থাৎ এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে হলদিয়া ও তাজপুরের বিপুল পরিমাণ জমি ৯৯ বছরের লীজে আদানিদের দিয়েছেন সমুদ্র বন্দর করার জন্য। দেউচা-পচামীতে আদিবাসীদের জমি কেড়ে কয়লা খনি নির্মাণের জন্য তুলে দিতে চাইছেন আদানিদের হাতে। জমিরক্ষার  নামে আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসা নেত্রী এখন জমি হাঙরদের হাতে জমি তুলে দিতে ব্যস্ত! 

দুই দলই আদানিদের থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পেয়েছে নির্বাচনী বন্ডে। বিজেপির প্রাপ্তি ৫২৭০ কোটি আর টি এম সি’র ৫২৮ কোটি।

এই প্রতারকদের বিরুদ্ধে জেগে উঠছে আম জনতা। এদের বিচার হবে জনতার আদালতে।

।।চৌকিদার তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।।