আজ থেকে ১৭৫ বছর আগে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস  প্রণীত ‘কমিউনিষ্ট পার্টির ইস্তেহার’  প্রকাশের পর ‘কমিউনিজমের ভূত’ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপ। কারণ তখন ইউরোপের দেশে দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা একটি বিকাশমান ব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার উপনিবেশ থেকে ব্যাপক লুন্ঠনের ফলে ইউরোপের সাম্রাজ্যলোভী দেশগুলিতে পুঁজিতন্ত্র বা ধনতন্ত্রের বিকাশ তখন গতিলাভ করেছে। অথচ সমাজবিকাশের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে ভিত্তি করে এই বিকাশমান ধনতান্ত্রিক বা বুর্জোয়া ব্যবস্থার উচ্ছেদের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছিল কমিউনিষ্ট ইস্তেহারের  পাতায়। বলা হয়েছিল, ‘বুর্জোয়ার পতন ও প্রলেতারিয়েতের জয়লাভ দুই-ই সমান অনিবার্য’।

        শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘কমিউনিষ্ট লীগ’ ছিল একটি গুপ্ত সমিতি। লীগের কর্মপন্থা হিসেবেই কমিউনিষ্ট ইস্তেহারের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮৪৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি।১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব, ওই বছরের ২৩-২৪শে জুন প্যারিসে সর্বহারাদের অভ্যুত্থান এবং ১৮৪৮-৪৯ সালে সারা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিপ্লবের প্রেক্ষাপটেই ইস্তেহারের আত্মপ্রকাশ। যদিও এই বিপ্লবগুলির কোনোটিই সফল হতে পারেনি। কমিউনিজমের ভূত দেখে আতঙ্কিত বুর্জোয়ারা ও তাদের সহযোগী সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যথা পোপ ও জার, মেতেরনিখ ও গিজো, ফরাসি র‌্যাডিক্যালরা আর জার্মান পুলিশ-গোয়েন্দারা ভূত তাড়ানোর জন্য ‘পবিত্র’ মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। ১৮৪৮ সালের প্যারিস অভ্যুত্থানের পরাজয়ে পিছু হটল সর্বহারা শ্রেণি। তাদের ওপর নেমে এল নির্মম রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন। চলল বিচার, ঘোষিত হল কারাদণ্ড। এই আক্রমণের মুখে ভেঙে দেওয়া হল লীগ। কিন্তু ইস্তেহার বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়নি, হারিয়ে যায়নি। বরং যত দিন গেল ২৩ পাতার এই ইস্তেহারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকল। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে কমিউনিষ্ট ইস্তেহার। ইস্তেহার প্রকাশের ২৫ বছর পর ১৮৭২ সালের জার্মান  সংস্করণের ভূমিকায়  মার্কস-এঙ্গেলস লেখেন যে, ইস্তেহার এখন একটি ঐতিহাসিক দলিল। এর অদলবদল করার কোনো অধিকার তাদের নেই।

         ইস্তেহারের মূল চিন্তাসূত্রটি হল, অর্থনৈতিক উৎপাদন ও তা থেকে অনিবার্যভাবে উদ্ভূত প্রত্যেক ঐতিহাসিক যুগের সমাজকাঠামো সেই যুগের রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক ইতিহাসের ভিত্তি স্থাপন করে; ফলতঃ মানবজাতির সমগ্র ইতিহাস (জমির উপর সাধারণ মালিকানা চিহ্নিত আদিম উপজাতি সমাজের অবলুপ্তির পর থেকে) হল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস, শোষক ও শোষিত, শাসক ও নিপীড়িত শ্রেণির সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণিসংগ্রামের এই ইতিহাস বিবর্তনের এক ধারা সৃষ্টি করে যা আজকের দিনে এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে একইসঙ্গে গোটা সমাজকে সকল শোষণ, নিপীড়ন, শ্রেণিপার্থক্য ও শ্রেণিসংগ্রাম থেকে চিরদিনের মতো মুক্ত না করে শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণিটি অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণি শোষক ও শাসকের তথা বুর্জোয়া শ্রেণির কর্তৃত্বের কবল থেকে মুক্তি পেতে পারেনা। ডারউইনের জীববিজ্ঞানের তত্ত্বের  সঙ্গে মিল রয়েছে এই ইতিহাসের।  আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্য আগতপ্রায় অবসান ঘোষণা করাই ছিল কমিউনিষ্ট ইস্তেহারের লক্ষ্য।

        কমিউনিষ্ট লীগ উঠে যাবার পরে প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল শ্রমজীবী মানুষের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের। ১৮৬৪ সালে গড়ে উঠল প্রথম আন্তর্জাতিক। বিগত আক্রমণ ও দমন-পীড়নের কথা মাথায় রেখে মার্কস-এঙ্গেলস এই সমিতির জন্য অপেক্ষাকৃত উদার কর্মসূচি প্রণয়ন করলেন। ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়ামের ট্রেড ইউনিয়নগুলি, ফ্রান্সের নৈরাজ্যবাদী প্রুঁধোপন্থীরা, জার্মানির সুবিধাবাদী লাসালপন্থীরা, সকলের কাছেই গ্রাহ্য হল এই কর্মসূচি। পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সর্বহারা এই আন্তর্জাতিক সমিতিতে হাত মেলায়। ১৮৭৪-এ প্রথম আন্তর্জাতিকের অবসানের সময় দেখা গেল প্রুঁধোর মতবাদ ও লাসালপন্থা মরতে বসেছে। শ্রমিকরা উন্নত রাজনৈতিক  চেতনার আলাদা মানুষে পরিণত হয়েছে।

       উক্ত সময়কালের মধ্যেই ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের ঘটনা ঘটল। সর্বহারাদের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হল শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী সরকার। এটিই বিশ্বের সর্বপ্রথম সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্রী সরকার। তবে এর আয়ু ছিল মাত্র ৭২ দিন। মার্কসের ভাষ্য অনুযায়ী প্যারি কমিউনের শিক্ষা হল, শ্রমিকশ্রেণি আগে থেকে তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটি অর্থাৎ বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রটি শুধু দখল করেই তাকে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে পারেনা। শ্রমিকশ্রেণির কর্তব্য হল পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করা।

         এক শোষণহীন সমাজ গড়ার সংকল্পেই রচিত কমিউনিস্ট ইস্তেহার।এই ইস্তেহার হাজার হাজার বছরের বৈষম্যের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার ব্লুপ্রিন্ট এবং সমাজ বদলের দলিল। এই দলিলে বলা হয়েছে বুর্জোয়া সমাজে ১০ শতাংশ মানুষের সম্পত্তি আছে বাকি ৯০ শতাংশের না থাকার বিনিময়ে। কমিউনিস্ট লীগের কর্মপন্থা হলেও কমিউনিষ্ট ইস্তেহার হয়ে উঠেছে কমিউনিস্টদের লক্ষ্য সম্পর্কে একটি সার্বজনীন রূপ-Universal Programme of the Communists. কোনো একটি দেশের প্রেক্ষিতে নয়, দেশকালের বেড়া অতিক্রম করে সমগ্র মানবজাতির শৃংখল মোচনের দিকনির্দেশ করা হয়েছে ইস্তেহারে। এখানেই কমিউনিস্টদের সুনির্দিষ্ট তিনটি লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে-১) প্রলেতারিয়েতকে শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত করা, ২)বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ ঘটানো, ৩)প্রলেতারিয়েত কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার করা। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব এই দুইয়ের মূল নির্যাস রয়েছে এই ইস্তেহারে। যদিও মার্কস ‘ক্যাপিটাল’ লিখেছিলেন পরে।

                  এখন প্রশ্ন হল, আজকের দিনের বাস্তবতায় কমিউনিষ্ট ইস্তেহারের কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে কি নেই! উত্তর হল হ্যাঁ আছে। সমসাময়িক পুঁজিবাদ সম্পর্কে ব্যাখ্যা ও পুঁজিবাদের ভবিষ্যত অভিমুখ সম্পর্কে অনুমান দুই-ই কমিউনিস্ট ইস্তেহারে উল্লেখিত আছে। ইস্তেহারে পুঁজিবাদের বিশ্বায়িত প্রক্রিয়ার বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবে- ‘নিজেদের প্রস্তুত পণ্যের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, সর্বত্র স্থাপন করতে হয় যোগসূত্র।’ ওই সময়ের পুঁজিবাদের শোষণের ও সংকটের রূপ বিধৃত আছে ইস্তেহারের চারটি অধ্যায়ের প্রথম অধ্যায়ে। যেখানে বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণি মুখোমুখি অবস্থানকারী বৈরী শ্রেণি। অধিক মুনাফার জন্য শ্রমিকদের কম মজুরিতে অতিরিক্ত খাটিয়ে শোষণ করা, অধিক উৎপাদনের ‘মহামারি’ ও পণ্যের বাজার না পাওয়া জনিত সমস্যায় সংকটগ্রস্ত ছিল সেসময়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর বর্তমান নয়া আর্থিক উদারনীতিতে পুঁজিবাদ উৎপাদনের ক্ষেত্রকেই সংকুচিত করে ফেলছে। আজকের বিপুলায়তন বিশ্ব লগ্নিপুঁজির  আগ্রহ কেবলমাত্র টাকার ব্যবসায়  পুঁজি বিনিয়োগ করা। তাই পুঁজি খাটছে শেয়ার বাজারে, ফাটকায়। সীমাহীন মজুত শ্রমের কারণে সংকট আরো তীব্র আকার গ্রহণ করছে। উৎপাদিকা শক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশের সঙ্গে মানুষের শ্রমের সম্পর্ক সমানুপাতিক হচ্ছে না। ক্রমবিকশিত উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে অব্যবহৃত শ্রমশক্তির কারণে। আমরা জানি উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের অমীমাংসিত দ্বন্দ্বই বিপ্লব ঘটায়।

               বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়  যেহেতু উৎপাদনের ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমানভাবে সংকুচিত সেহেতু শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রম থেকে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির সম্ভাবনাও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এটা এই সময়ের পুঁজিবাদের মহা দুর্বলতার দিক। এর পাশাপাশি কর্মহীন মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে বাজার থেকে সরে যাচ্ছে। ফলে বাজারের সংকোচন ঘটছে এবং সর্বগ্রাসী মন্দায় ডুবছে গোটা ব্যবস্থাটাই।

         বাজার সর্বস্বতার নাম করে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির তাত্ত্বিকগণ যথা মিলটন ফ্রিডম্যান, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা প্রমুখ আজকের দিনের পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে চেয়েছিলেন, অথচ মাত্র তিন দশকের মধ্যেই সেই বাজার ভঙ্গুর ও কার্যত ধ্বংসের পথে চলে গিয়েছে। এই ব্যবস্থায় ছাঁটাই, কর্মহীনতা উদ্বৃত্ত শ্রমের পাহাড় গড়ে তুলবে এবং

 উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করবে। পুঁজিবাদ টিকবে কীভাবে? মানুষ কি মেনে নেবে শ্রমশক্তির এই অপচয়?

                          নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ  জোশেফ স্টিগলিৎজ বিগত ২০১১ সালে আজকের নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘অব দি ওয়ান পার্সেন্ট, বাই দি ওয়ান পার্সেন্ট, ফর দি ওয়ান পার্সেন্ট’। এ যেন  বুর্জোয়া ব্যবস্থার সমালোচনায় ইস্তেহারের সেই ভাষ্যের প্রতিধ্বনি-দশ ভাগের এক ভাগ বিত্তবান বাকি নয় ভাগের বিত্তহীনতার বিনিময়ে।

        মানুষ ‘মানুষ’ বলেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার হীন, ঘৃণ্য, তিক্ত পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করবেই, বাঁধন ছিঁড়বেই। যতক্ষণ শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত ততক্ষণ শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির জন্য সংগ্রাম অটুট থাকবে।

       তাই নিবন্ধের শেষে একথা বলা যায়, বিশ্ব লগ্নিপুঁজির চূড়ান্ত আধিপত্যবাদী পৃথিবীতে আজও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদকে ‘কমিউনিজমের ভূত’ই তাড়া করে বেড়ায়।