স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর পযার্য়েই ১৯২০ সনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা। অতি ক্ষুদ্র এই রাজনৈতিক শক্তিকে ব্রিটিশ সরকার সঠিকভাবেই এদেশে তাদের প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের পযার্য়ে দীর্ঘ আট বছর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী (১৯৩৪-৪২) রাজনৈতিক দল ছিল।


বিজেপির মত দলের পূর্বসূরীদের কথা আলোচনায় না আনাই শ্রেয়। কারণ তাদের মুচলেকা লিখতভাবে ব্রিটিশ শাসকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। মহাফেজ খানার দলিল ঘেঁটে যেকোনো মানুষ এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে আসতে পারেন।


কিন্তু স্বাধীনতার আন্দোলনে যাদের যথেষ্ট অবদান ছিলো, সে সমস্ত রাজনৈতিক দলকেও কখনও বেআইনী হতে হয় নি। ব্রিটিশরা তাদেরকে অন্তত কমিউনিস্টদের মত বিপদজনক দল মনে করেনি।
সে যুগে কমিউনিস্ট মতাদর্শের সাথে পরিচিত হওয়ার কাজটিই ছিল যথেষ্ট বিপজ্জনক। এদেশে মার্কসবাদের কোনো বই পড়া বা বিক্রয় করা ছিল নিষিদ্ধ। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী যে শ্রমিকরা জাহাজের কর্মী ছিলেন, তারা যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে এই বেআইনী বই এদেশে পাচার করে যেত। কলকাতার মাত্র দু’ একটি দোকান অতি সন্তর্পণে একান্ত পরিচিতদের কাছে সে বই বিক্রয় করত। ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় মুজাফফর আহমেদের বর্ণনায়।


কমিউনিস্টদের লক্ষ্য সমস্ত শোষণ পীড়ণের অবসান। আধুনিক যুগে পুঁজিবাদকে খতম না করে শোষণ-পীড়নের অবসান অসম্ভব। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবাসীর ঘাড়ে চেপে আছে। শোষকদের উৎখাত করার কাজটি তৎকালীন ভারতবর্ষে কমিউনিস্টদের প্রথম করণীয়। এ কাজে সর্বহারা ছাড়াও সমাজের অনেক অংশের অংশগ্রহণের ও নিশ্চয়তা সুস্পষ্ট।
তাই প্রাকস্বাধীনতা পযার্য়ে কমিউনিস্টদের প্রধান কাজ ছিল দেশকে পরাধীনতা মুক্ত করা। এই লক্ষ্য নিয়েই অনেক মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা জাতীয় কংগ্রেসে অংশ গ্রহণ করে। কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতাই সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করার জন্য কমিউনিস্টরা শ্রমিক -কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এ বিষয়ে কংগ্রেসের সকলে গুরুত্ব না দিলেও একটি অংশ ছিল যথেষ্ট আগ্রহশীল। তারা শ্রমিক এবং কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার ভূমিকা পালন করে। কংগ্রেস দলে একটি অংশ শ্রেণী চিন্তা বা শ্রেণি অবস্থানের কারণেই এক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত বা বিরোধী ছিলেন। কমিউনিস্টরা মনে করেছে ৮০% দেশবাসী কৃষক। তাদের বাদ দিয়ে যেমন জাতীয় আন্দোলন অবান্তর, তেমনি আধুনিক যুগে সর্বাপেক্ষা অগ্রসর এবং সংগ্রামী ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রমিকের অংশগ্রহণও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অবশ্য প্রয়োজনীয়। জনসংখ্যার ৮০% কৃষককে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জমিদার-মহাজনের পীড়নের বিরুদ্ধে নীরব থাকা বা মালিকের শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে কথা না বলে এদের সংগঠিত করা যায় না তাই সংগ্রামী শক্তির জাগরণ ঘটাতে গেলে এই শ্রেণী সংগ্রামের পর্বটিও ছিল অনিবার্য। কমিউনিস্ট ব্যতিত অনেকেই এ দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি অনেক কংগ্রেস নেতারও ভূমিকা ছিলো। দীর্ঘ সময় ঐক্যবদ্ধভাবে দুটি শ্রেণি সংগঠনে সকলে কাজ করেছে। মুখ্য ভূমিকায় কমিউনিস্টরা। সোভিয়েত বিপ্লব এবং আমাদের পাশ্ববর্তী চীন দেশের মুক্তি সংগ্রামে অগ্রগতি এ দেশেও ব্রিটিশদের আতঙ্কিত করে। আমাদের দেশের মালিক-জমিদার শ্রেণীও কমিউনিস্টদের আগ্রগতিতে শঙ্কিত ছিল। শোষণ বিরোধী সংগ্রামী শক্তির উৎস কমিউনিস্টদের চরম শত্রু বলে চিহ্নিত ব্রিটিশদের অসুবিধা হয়নি। ব্রিটিশ সরকার তার প্রধান শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করতে মীরাট ষড়যন্ত্র, কানপুর ষড়যন্ত্র এবং পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। কি সে ষড়যন্ত্র? ষড়যন্ত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার। বাস্তবে ব্রিটিশ শাসনের অবসান কমিউনিস্টরা করতে চেয়েছে। এটা কোনও গোপন তৎপরতা নয়। প্রকাশ্যেই একথা সর্বদা বলা হত। কিন্তু সরকার একমাত্র শীর্ষ স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে নয়। মামলা পরিচালনাও করা হত সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ পথে। অর্থাথ অভিযোগ বা তা প্রমাণের প্রশ্নই প্রায় অবান্তর ছিল। কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই তাই মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার যাবজ্জীবন সাজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনে যাবজ্জীবন অন্ধকার কারার আড়ালে থাকার সাজা ছিল নিয়মিত বিষয়। অন্য কিছু বিপ্লববাদী বাদে কমিউনিস্টরাই এ সাজা পেয়েছে। অন্য দলকে এমন সাজা খাটতে হয় নি। দ্বীপান্তর সর্ম্পকেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। আন্দামানে কারান্তরালে থাকা বন্দী তালিকায় দেখা যাবে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য নেতা সেখানে অন্ধ কুঠুরীতে সাজা খাটেনি। কমিউনিস্টদের নামগুলো আজও ঊজ্বল আর আছে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি অর্জন করা দামোদর সাভারকারের নাম। যে সকল কমিউনিস্ট নেতারা বিনা বিচারে বা সাজাপ্রাপ্ত বন্দী ছিলেন, তারা কখনও মুক্তি চেয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন প্রত্যাশা কারও ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামী অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ক্ষেত্রে এমন সমস্যা প্রায় ছিলনা বলা চলে। শুধুমাত্র বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা ছিল। ওই বিপ্লবীদের মধ্যে অধিকাংশরাই জেলে থাকাকালীন মার্কসবাদের সংস্পর্শে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। বাংলার চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের বীর সেনানীরা ২/১ জন বাদে প্রায় সকলেই পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এক্ষেত্রে সংগ্রামী নারীদের কথাও ভোলার নয়। কল্পনা দত্ত, ইলা মিত্র, মণিকুন্তলা সেনের মত নারী কমিউনিস্টরা আজও শ্রদ্ধা অর্জন করে। কমিউনিস্টরা কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করার প্রথম থেকে আত্মনিয়োগ করে। কাজটি ছিল যথেষ্ট বিপজ্জনক। ব্রিটিশ পুলিশ ছাড়াও ছিল জমিদার বা মালিকের ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী। তাদের হাতে প্রাণ হারানোর বাস্তবতা ছিল। শিক্ষিত যুবকরা জীবনের সকল সুখ বির্সজন দিয়ে শ্রমিক-কৃষকের সাথে একাত্ম হয়ে থাকার কষ্টকর জীবনযাত্রায় কমিউনিস্টদের কাছে ছিল স্বাভাবিক। ফলে যক্ষা বা আলসার রোগে আক্রান্ত হতে হয় নি, এমন কমিউনিস্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন। কমিউনিস্টদের ন্যায় এমন কঠোর জীবনযাত্রার মুখোমুখি অন্য অংশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হতে হয়নি। তাদের নামও সেদিন দেশবাসী খুব কমই জানতে পেরেছে।

কিন্তু দেশবাসীকে জানান বা নাম প্রচারের আকাঙ্খা তাদের আছন্ন করতে পারেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্ব থেকেই প্রচার মধ্যমে কমিউনিস্টদের অবহেলা করার প্রবণতা ছিল। তবুও সে সময় নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকদের অমিল ছিল না। এক্ষেত্রে বর্তমান যুগে আস্থা অনেক পরিবর্তিত। অবস্থার অনেক অবনতি হয়েছে। কমিউনিস্টদের গৌরবগাথা প্রচারিত হোক, তা কোনো মালিকানা গোষ্ঠী সহ্য করতে পারে না। যতটা সম্ভব সত্যকে চেপে রাখার কাজে তারা যথেষ্ট তৎপর। বরং কমিউনিস্টদের সর্ম্পকে অপপ্রচার করে, মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরির কাজটিতে তারা যত্নবান। বরং যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত না থাকার মুচলেকা দিয়েছে, যে সংগঠন স্বাধীনতার কোনো দাবী উত্থাপন করেনি, তাদেরকেই দেশপ্রেমী বলে বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। সেই মর্মেই দেশের ইতিহাস পুর্ণলিখনের উদ্যোগও চলছে। ইতিহাসকে খতম করার এ প্রবণতাকে প্রতিহত করার সংগ্রাম এড়িয়ে যাওয়া আজ অসম্ভব। আজকের দেশবাসীকে ইতিহাস জানান জরুরী। জাতীয় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটার ক্ষেত্রে কংগ্রেস দলের ক্ষেত্রে কংগ্রেস দলের নাম প্রথম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘপর্যায়ে কংগ্রেসের জাতীয় সন্মেলন স্বাধীনতার দাবী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেনি। ১৮৮৫-র বহু বছর পার হয়েছে স্বাধীনতার প্রস্তাব আসে নি। কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার পরই প্রথম কমিউনিস্টরাই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীতে প্রস্তাব উত্থাপন করে। সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। তারপরও দু’টি অধিবেশনে কমিউনিস্টরা প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে পেশ করে এবং সন্মেলনে সমবেত প্রতিনিধিদের মধ্যেও বিলি করে। কংগ্রেস দল প্রতিষ্ঠার চার দশক পরেই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের দাবী উত্থাপন সম্ভব হয়। আর বিজেপির মত দল কোনোদিনই স্বাধীনতার দাবী উত্থাপনই করতে পারেনি। হয়ত তারা পরাধীনতারই পুজারী। ভারতের কমিউনিস্টরা ভারতের স্বাধীনতা দাবী করবে, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু উল্লেখ করা দরকার; ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রজনীপাম দত্ত এবং বেন ব্রাডলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কার্যক্রমে নিয়মিত সহায়তা করেছেন। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামীর এবং সাজাপ্রাপ্তের তালিকায় রয়েছে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতা বেন ব্রাডলের নাম।