সপ্তম বামফ্রন্টের যাত্রা শুরু হয়েছে জনসমর্থনের প্রাণবন্ত ভিতের ওপরেই। ইস্পাত ,অটোমোবাইলস,পেট্রোকেম প্রভৃতি নতুন প্রস্তাবগুলি আসতে শুরু করেছে।রাজ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে আমাদের ভিত্তি বিস্তারের জন্য টাটাদের সঙ্গে অটোমোবাইলের যে কথাবার্তা চলছিল শেষপর্যন্ত সফল হয়েছিল। কিছু বাধা অতিক্রম করতে হবে। তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্প (ছোট গাড়ি ) ছিল উত্তরাখণ্ডে । সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের ঢালাও ভর্তুকি যা আমরা দিতে পারব না। কিন্তু কিছু ছাড় দিতে হবে , না হলে আসবে কেন ? জমির দামে,বিক্রয় করে এবং সহজ ঋণের ব্যবস্থা করে এটা সম্ভব হয়েছিল । কারণ ,এটা নিছক টাটা প্রকল্প নয় – এ রাজ্যের শিল্পায়ন ও সামগ্ৰিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠবে । টাটাদের বলা হয়েছিল ,খড়্গপুরে- মেদিনীপুরে আমাদের শিল্প তালুক এলাকাতে কারখানা করতে , তাদের পছন্দ সিঙ্গুর । শিল্পের জায়গা নির্বাচনে তাদের ব্যবসায়িক বিচারবুদ্ধি নিয়েই তারা চলবে। এক্ষেত্রেও তাদের অবস্থান ও তারা পাল্টাতে চায় না। জায়গা নিয়ে আমরা তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছি । কারণ আমাদের লক্ষ্য এই রাজ্যেই কারখানাটি হোক ।পরবর্তীতে অনেকে সিঙ্গুরের জমির উর্বরতা নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। সেখানে এক ফসলি থেকে দু -ফসলি জমিতে চাষ করে (ধান,আলু ইত্যাদি)যে কর্মসংস্থান হয়,সম্পদ সৃষ্টি হয় , অটোমোবাইলের মতন একটি কারখানা হলে তার কি ফলাফল হয় – এর তুল্যমূল্য বিচার করেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে এ রাজ্যের সিংহভাগ জমিই সেই অর্থে চাষযোগ্য।পতিত জমির পরিমাণ শতকরা তিন ভাগের বেশি নয় । সিঙ্গুরের কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের দায়িত্ব ও নিয়েছি।অধিগ্ৰহন শুধু প্রশাসন করবে না , কৃষক সংগঠন ,গনসংগঠন, রাজনৈতিক দল, স্থানীয় ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংস্থা- সবাইকে একত্র করতে হবে এই প্রক্রিয়ায়। সংশ্লিষ্ট গ্ৰামগুলিতে আলাপ – আলোচনা , পথসভা, মিছিল, জনসভা সংগঠিত ও হয়েছে।এসব করেও পরে দেখা যাচ্ছে ফাঁক রয়ে গেছে। সমস্ত মানুষের কাছে সমস্ত কথা পৌঁছায়নি।২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৭বিডিও অফিসে গোলমালের সুত্রপাত । কিছু মানুষ বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। দিল্লিতে সেই খবর জানলাম । ফিরে এসে বিষয়টি পরিষ্কার হল।‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে বিডিও দপ্তরে । আশি ভাগের বেশি মানুষ জমি দিয়ে অর্থ বুঝে নিয়েছেন। জমির বাড়তি মূল্য (সোলেসিয়াম)-ও পেয়েছেন ।ক্ষতিগ্ৰস্থ বর্গাদার এবং খেতমজুররাও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন ।

সারা দেশে কোথাও এর নজির নেই। তাহলে কারা বিরোধিতা করছেন ? এই অনিচ্ছুক তো শতকরা আঠারো ভাগেরও কম । তার মধ্যে অর্ধেকের বেশিরও জমির কাগজপত্রই নেই। সিঙ্গুরে কারখানা তৈরির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। প্রায় আশি ভাগ সম্পূর্ণ হয়েছে। টাটারা ইতিমধ্যেই এই অঞ্চলের যুবক-যুবতীদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছে। কারখানা গড়ার কাজে অঞ্চলের বিরাট শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েছে।এই সময় নতুন সমস্যা উপস্থিত হলো । নন্দীগ্রামে তথাকথিত জমির আন্দোলন শুরু হয়েছিল যদিও সেখানে কোনো জমি অধিগ্রহণ হয়নি। এর নেতিবাচক প্রভাব সিঙ্গুরে এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যেই আর একটি ঘটনা ঘটেছে। তাপসী মালিক নামে একটি তরুনীর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে নির্মিয়মাণ কারখানার মাঠে।আমি সিবিআই তদন্তের একদিন ও দেরি করিনি । কারণ আমিও চিন্তিত কে বা কারা এই অপরাধ করল।এই ঘটনার এখনো বিচার হয়নি । কেউ দোষী ও সাব্যস্ত হয়নি । নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে । সিঙ্গুরে কারখানা শুরু হওয়ার মুখে নতুন করে বিক্ষোভ – অনশনের তামাশা শুরু হল। রঙ -বেরঙের অনেক নেতার আনাগোনাও বেড়ে গেলো।এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপাল সিঙ্গুর বিতর্কের মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন ।খোলামনেই রাজি হয়েছিলাম। আমি এবং আমার দুই সহকর্মী নিরুপম সেন ও সূর্যকান্ত মিশ্র আলোচনা করতে যাই। সমস্ত আলোচনা দাঁড়িয়ে গেল অধিগৃহীত জমির ৪০০ একর ফেরত দেওয়ার দাবিতে।আমি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছিলাম ,এই জমি মূল কারখানার অনুসারী শিল্পগুলোর জন্য।সেই জন্যই তা হাতছাড়া করা সম্ভব নয় । প্রকৃতপক্ষে ইঞ্জিন সহ মূল গাড়ি বাদে গাড়ির অন্য অংশগুলি তারাই তৈরী করে । ইতিমধ্যেই এই অনুসারী শিল্প ইউনিট গুলি ৪০০একরের বৃহদংশেই কাজও শুরু করে দিয়েছে। এনসিলিয়ারি মানে নেত্রীর ধারণা ওয়াইন শপ এবং বিউটি পার্লার। বাস্তবতার,যৌক্তিকতার ধার ধারেন না। আলোচনার ফলাফল স্বভাবতই শূন্য।রাজ্যপাল সম্পর্কে পরে ভেবে দেখেছি তিনি সত্যি কি চেয়েছিলেন? পূর্ববর্তী রাজ্যপাল শ্রী শাহের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার মুখে প্রধানমন্ত্রী ড.মনমোহন সিং নিজের থেকে আমায় জিজ্ঞাসা করে ছিলেন , আমার কোনো নাম প্রস্তাব আছে কিনা ।আমি খুশি হয়ে ছিলাম , সাধারণত দিল্লির সরকার এইসব সৌজন্যের ধার ধারে না ।আমি শ্রী গান্ধীর নাম প্রস্তাব করেছিলাম। রাজ্যপাল পদে দায়িত্ব নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কই ছিল । বিরোধীদের রক্ষায় হঠাৎ তিনি মাঠে নামলেন কেন ? শিল্পায়নের প্রশ্নে রাজ্যের শরীরে যে বিষাক্ত ক্ষতস্থান তৈরী হয়েছে , সেখান থেকে বদ রক্তক্ষরণ যতদিন চলবে ,রাজ্যের মানুষ রাজ্যপাল গান্ধীকেও ততদিন মনে রাখবে।হঠাৎই শারদোৎসবের মুখে রতন টাটা সিঙ্গুর থেকে বিদায়ের সিদ্ধান্ত নিলেন । আমার কঠোর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতেও ফল হল না । এতদিন তাঁরা যে মনোভাব দেখিয়েছিলেন ,এই আকস্মিক পরিবর্তনে আমি বিস্মিতই হলাম ।তাঁর মতে ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’ হিসাবে তিনি এই রাজ্যে থাকতে চান না । পরবর্তীতে আমি অনেক চিন্তা করেছি- কোথায় ভুল হলো ? জমি অধিগ্রহণে না অধিগ্ৰহনের পন্থা-পদ্ধতিতে? বিরোধীদের সম্পর্কে নরম মনোভাব দেখিয়ে ভুল করেছি ? অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেব। কিন্তু মূল কথা পশ্চিমবঙ্গের অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যফিরে দেখা , জানুয়ারি ২০১৭।