কাকাবাবু- কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ এক আপসহীন বিপ্লবী ,ভারতের বুকে কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং সংগঠন যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম।

বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলার সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের জন্ম। বাংলায় ১২৯৬ সালের শ্রাবন মাসের কোনো এক সোমবার তিনি জন্মগ্রহন করেন। বাবা মনসুর আলী ছিলেন সন্দ্বীপ আদালতের মোক্তার। মা চুনা বিবি। কাকাবাবুর নিজের কথায়, তাঁদের দরিদ্র পরিবারে কারো জন্মদিন পালন করা হতো না। মায়ের মুখে শুনে শুধু সাল, মাস এবং বারের কথা তাঁর মনে আছে। ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুসারে শ্রাবণ মাসের সোমবারগুলি ছিলো ১৮৮৯ সালের ২২শে ও ২১শে জুলাই আর ৫ই এবং ১২ই আগস্ট। এই চারটে দিনের মধ্যে কোনটি তাঁর প্রকৃত জন্মদিন তা জানার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। এই অবস্থায় আগস্ট মাসের ৫তারিখ তাঁর জন্মদিন বলে তিনি ঠিক করেন। তাই ৫ই আগস্ট তারিখেই আমরা কাকাবাবুর জন্মদিন পালন করে থাকি।  

১৮৯৭ সালে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ১৮৯৯সালে তাঁকে ভর্তি করা হয় হরিশপুর মডেল ইংরাজি স্কুলে। কিন্তু সেই সময় পরিবারের আর্থিক অনটনের জন্য তিনি দুই বছরের বেশি ওই স্কুলে পড়তে পারেননি। তখন মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে আরবি, ফার্সি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলা চর্চা চালিয়ে যান। পরে ১৯০৬ সালে ১৭ বছর বয়সে সন্দ্বীপের কার্গিল হাইস্কুলে নিচু ক্লাসে ভর্তি হন। সেই সময় হাফিজা বেগমের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯১০সালে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ নোয়াখালি জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সেই সময় প্রবাসী পত্রিকায় এবং ইংরাজিতে মর্ডাণ রিভিউ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে নোয়াখালি জেলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর হুগলি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর ওই বছরেই কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে চলে আসেন। সেই সময় তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কাজে জড়িয়ে পড়েন। সমিতির ত্রৈমাসিক মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ প্রকাশ এবং তার সম্পাদকীয়র সমস্ত কাজে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই সমিতি কোনো সাম্প্রদায়িক লক্ষ্যে পরিচালিত হতো না। ইসলামিক সভ্যতার নানা দিক তুলে ধরাই ছিলো সমিতির উদ্দেশ্য।

জীবনজীবিকার কারণে ১৯০৬ সাল থেকেই কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ কোনো না কোনো বাড়িতে থেকে গৃহশিক্ষকের কাজ করতেন। নানা পরিস্থিতির মধ্যে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। নানা জায়গায় কাজও করেন। ১৯১৭ সালে তিনি বেঙ্গল গভর্নমেন্ট প্রেসে সহকারি স্টোর কিপারের কাজ করেন। এক বছর এই কাজ করার পর এক মাসের জন্য গভর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টে উর্দু থেকে বাংলা অনুবাদকের কাজও করেন। পরের এক মাস কাজ করেন কলকাতার স্কুল পরিদর্শকের অফিসে। ১৯১৮ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সর্বক্ষণের কর্মী হন।

১৯১৭ সালে রাশিয়ার বিপ্লব তাঁর মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। রুশ বিপ্লবের কিছু তথ্য, প্রচার পুস্তিকা এবং মার্কসবাদী সাহিত্য গোপন পথে ভারতে আসতে শুরু করলে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ তা পাঠ করেন। মূলত সন্দ্বীপের জাহাজিরা তাঁকে এইসব বই এনে দিতেন। এরমধ্যে দিয়ে তিনি মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মস্কোতে ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ গঠিত হয়েছে বলেও তিনি জানতে পারেন। ১৯২০ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফত কমিটির সদস্য মনোনিত হন। যদিও তিনি ওই পদ গ্রহণ করেননি। তবে ওই বছরের শুরুতেই কাকাবাবু ঠিক করে ফেলেছিলেন, রাজনীতি হবে তাঁর পথ এবং পেশা। ১৯২০ সালের গোড়ায় কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় চলে আসেন এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কলেজ স্ট্রিটের দপ্তরে ওঠেন। সেই বাড়িতেই কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ এবং নজরুল ইসলাম বসবাস শুরু করেন। তাঁরা দু’জনেই নবযুগ নামে সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশনার সাথে যুক্ত হন। পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন কাকাবাবু। পত্রিকার অপর সম্পাদক নজরুল ইসলাম। পরে ১৯২২ সাল পর্যন্ত তাঁরা তালতলা লেনের একটা বাড়িতে একসাথে ছিলেন। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লা চলে যান। তারপর তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং যোগাযোগ অটুট থাকলেও একসাথে আর থাকা হয়ে ওঠেনি।

১৯২২সালের ১২ই আগস্ট নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় ‘ধুমকেতু’ প্রকাশিত হয়। যে পত্রিকা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের বল জোগাতো। কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে এই পত্রিকায় লিখতেন। তাঁর লেখায় গণআন্দোলনের আবেদন থাকতো। সেই সময় তিনি একটা কাগজ বের করার জন্য কোম্পানি খুলতে উদ্যোগী হন। কিন্তু তাঁর আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় কুতুবুদ্দিন আহমদ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ঠিক হয় কাগজটি হবে মজদুর ও কৃষকদের মুখপত্র। এর ঘোষণাপত্রে কাকাবাবুর লেখা বাংলা খসড়াটির ইংরাজি অনুবাদে মজদুরের ইংরাজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিলো ‘প্রোলেতারিয়েত’ শব্দটি। আমাদের দেশে প্রোলেতারিয়েত শব্দটির এটাই সম্ভবত প্রথম প্রয়োগ। এদিকে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি না হওয়ায় কাগজ বের করা সম্ভব হয়নি। তবে কাকাবাবু বিভিন্ন সাময়িকীতে লেখালিখি চালিয়ে যান।

১৯২০ সালের ১৭ই  অক্টোবর তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। কাকাবাবুর কথায়, “এই কাজের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও ভারতে আমার এবং আমার সহকর্মীদের মধ্যে এর প্রভাব পড়েছিলো।“ ১৯২১ সালে এই পার্টির পক্ষ থেকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশিত ইশতেহার প্রচারের অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। এরপর থেকেই কাকাবাবু দেশের যেখানেই যেতেন সেখানেই ব্রিটিশ পুলিস তাঁর উপর নজরদারি চালাতো। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বার্তাবাহক নলিনী গুপ্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। একই সময় ভারতের বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকজন মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন- শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, মহম্মদ আলি, গোলাম হোসেন প্রমুখ। তাঁদের সাথে কাকাবাবুর যোগাযোগ হয়। ১৯২২সালের শেষের দিকে শওকত ওসমানি মস্কো থেকে কলকাতায় ফিরলে তাঁর সাথেও কাকাবাবুর পরিচয় হয়। ওই বছর নলিনী গুপ্ত ইউরোপ ফিরে গেলেও এম এন রায়ের মাধ্যমে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সাথে কাকাবাবুর পরিচয় করিয়ে দেন। ওই সময়েই কমরেড আবদুল হালিমের সাথে কাকাবাবুর দেখা হয়। তাঁরা দু’জনে যৌথভাবে ভারতের বুকে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হন।

কাকাবাবুর কথায়, ভারতের বুকে আগে পরে চার জায়গায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজ শুরু হয়েছিলো। একসাথে মিলিত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো এমনটা নয়। প্রত্যেক জায়গায় উদ্যোক্তারা পৃথক পৃথকভাবে কাজ শুরু করেছিলেন। দেশের ভিতর কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার প্রধান উদ্যোক্তারা ছিলেন – কলকাতায় কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ও আবদুল হালিম, মুম্বাইতে শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, লাহোরে গোলাম হোসেন, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার প্রমুখ।

১৯২৩সালের ১৬ই মে ব্রিটিশ সরকারের পুলিস কাকাবাবুকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করে। কয়েকদিন বাদে তিনি জামিন পান। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কানপুর বলসেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় কাকাবাবুকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলায় শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, শওকত ওসমানি ও নলিনী গুপ্তর সঙ্গে তাঁরও চার বছরের সাজা হয়। আলিপুর, প্রেসিডেন্সি, কানপুর, রায়বেরেলি হয়ে কাকাবাবুকে যখন ঢাকা জেলে বদলি করা হয় তখন তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এই জেলে থাকলে মৃত্যু হতে পারে এই আশঙ্কায় এরপর তাঁকে আলমোড়া জেলে পাঠানো হয়। ১৯২৫ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।

১৯২৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর দ্য ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। ১৯২৫ সালের ১২ই অক্টোবর কাকাবাবুই প্রথম ভারতে কোনো কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলনের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেন। জাতীয় কংগ্রেসের বাৎসরিক সম্মেলনের চৌহদ্দির বাইরে একটি তাঁবুতে সম্মেলন হয়। এই সম্মেলন থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিতে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদও নির্বাচিত হন।

কলকাতায় ফিরে কাকাবাবু লেবার স্বরাজ পার্টির দপ্তরে থেকে কাজকর্ম পরিচালনা করা শুরু করেন। এই লেবার স্বরাজ পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘লাঙ্গল’-য়ের প্রধান পরিচালক ছিলেন নজরুল ইসলাম। ১৯২৬ সালের ১২ই আগস্ট লাঙ্গলের নাম বদলে ‘গণবাণী’ করা হয়। কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ হন তার সম্পাদক। ১৯২৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা বাধলে কাকাবাবু সহকর্মীদের নিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

এই পর্বে বাংলার নানা প্রান্তে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বিকাশেও কাকাবাবু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন বিহারের ঝরিয়ায় অনুষ্ঠিত এ আই টি ইউ সি-র অধিবেশনে তিনি অন্যতম উপ সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই বছরের ২৭শে এবং ২৮শে ডিসেম্বর কলকাতায় গোপনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভা হয়। এই সম্মেলনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নতুন সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি (পরবর্তীতে সেন্ট্রাল কমিটি) গঠিত হয়। কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ তার সদস্য নির্বাচিত হন। এই সভায় মুজফ্‌র আহ্‌মদকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে কাজ করার জন্য মস্কো পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের সময় সভাস্থলে শ্রমিকদের এক সুবিশাল মিছিলের নেতৃত্ব দেন কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদ।

১৯২৯ সালের ২০শে মার্চ ব্রিটিশ সরকার মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এই মামলায় কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সহ ৩১জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মীরাট মামলা ছিলো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় বিচার। যে মামলায় সেই সময়েই ব্যয় হয়েছিলো প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। চার বছর ধরে এই মামলা চলে। ১৯৩৩ সালের ৯ই জানুয়ারি এই মামলার রায়ে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে আপিলে সাজা কমে তিন বছর হয়। কাকাবাবুর কথায় মীরাট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা ভারতে কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলো। এই প্রসঙ্গে একটি তিনি লিখেছিলেন, ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় বন্দীরাই জিতেছিলেন। …..বছরের পর বছর মামলা চালিয়ে ব্রিটিশ গভর্ণমেন্ট সারা বিশ্বে বন্দীদের প্রতি ঘৃণা উদ্রেগের পরিবর্তে সহানুভূতির উদ্রেগ করেছিলেন। জগতের নানা স্থান থেকে মীরাট মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ এসেছিলো।’

পরবর্তী সময়েও নানা মামলায় ব্রিটিস সরকার কাকাবাবুকে বহুবার গ্রেপ্তার করে। স্বাধীন ভারতেও শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি করার কারণে তাঁকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়। সব মিলিয়ে তাঁর জীবনের ২০টা বছর জেলেই কাটে। জেলে থাকার সময় রাজনৈতিক বন্দীদের মর্যাদা ও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার দাবীতে তিনি দু’বার দীর্ঘ সময় অনশন করেন। একবার কাকাবাবুকে কলকাতা ছাড়ার আদেশও দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে কলকাতা ত্যাগ করলেও সেই সময় তিনি গোপনে ফিরে আসেন। দু’বছর আত্মগোপনে থেকেই তিনি পার্টির কাজ চালিয়ে যান। এটাই অবশ্য শেষ নয়, প্রায় পাঁচ বার, সব মিলিয়ে আট বছর আত্মগোপনে থেকে তিনি পার্টির কাজ করেছেন। এই কাজে তিনি এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, পার্টির অন্যান্য নেতৃত্বও এ’বিষয়ে তাঁর থেকে পরামর্শ নিতেন। মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ পার্টি ও গণ সংগঠনের কাজে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় অবিভক্ত বঙ্গদেশে একই সঙ্গে পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলনের বিকাশে তাঁর ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জেল থেকে ফিরে মার্কসবাদে বিশ্বাসী রাজবন্দীরা প্রায় সবাই তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন। সেই সময় যাঁরা কলকাতায় থাকবেন বলে ঠিক করেছেন তাঁদের শ্রমিক ইউনিয়নে এবং যাঁরা গ্রামে ফিরে যাবেন তাঁদের কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করার পরামর্শই তিনি দিতেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন জেলায় পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কাকাবাবু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। যার ফলস্বরূপ অবিভক্ত বঙ্গদেশের ২৮টি জেলাতেই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। এই অল্প সময়ে পার্টির সভ্য সংখ্যাও অনেক বাড়ে।

১৯৩৭সালের মার্চ মাসে বাঁকুড়ার পাত্রসায়রে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য পাঁচ সদস্যের যে সভাপতি পরিষদ নির্বাচিত হয় তাঁর অন্যতম সদস্য ছিলেন কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। সম্মেলনের নীতিগত দলিল রচনা এবং পেশ তিনিই করেছিলেন। যা বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার প্রথম রাজনৈতিক-সাংগঠনিক দলিল হিসাবে গৃহীত হয়েছিলো। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯সাল পর্যন্ত তিনি সারা ভারত কিষান সভার উপ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক। ১৯৪৩ সালে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত প্রথম পার্টি কংগ্রেসের পতাকা তিনিই উত্তোলন করেছিলেন। তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন তার মধ্যে একমাত্র ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস ছাড়া সবগুলি পার্টি কংগ্রেসেই তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত সারা ভারত কৃষকসভার সম্মেলনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই বছর কমরেড হো চি মিন ফরাসী সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার পথে কলকাতায় এলে ডেকার্স লেনের পার্টি অফিসে তাঁর সাথে কাকাবাবুর সাক্ষাৎ হয়। কমরেড হো চি মিনের সাথে তাঁর দ্বিতীয় সাক্ষাতটি হয় ১৯৫৭ সালে, মস্কোতে।

মতাদর্শগত বিষয়ে পার্টি ভাগ হওয়ার সময়ে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও কাকাবাবুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ১৯৬৪ সালের ৩১শে অক্টোবর থেকে ৭ই নভেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত সপ্তম কংগ্রেস থেকে সি পি আই (এম) গঠিত হয়। পার্টি কংগ্রেস শুরু হওয়ার আগের দিন কাকাবাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলে থাকাকালীনই তিনি সি পি আই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সি পি আই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

কাকাবাবুর জীবন লড়াইয়ের। পার্টি সংগঠন, গণ আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি যেমন দক্ষ ছিলেন তেমনই ১৯৩৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সমস্ত নির্বাচনী সংগ্রামেও তিনি সক্রিয়ভাবে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রশ্নেও তিনি ছিলেন আপসহীন।

কাকাবাবু বিশ্বাস করতেন, মানসিক বিকাশের জন্য সংবাদমাধ্যম ও বক্তব্যের স্বাধীনতা খুবই জরুরি। একইরকম ভাবে চিন্তাচেতনাকে উৎসাহিত করার জন্য ভাবনার আদানপ্রদানও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছাপাখানা, সংবাদপত্র এবং পুস্তক বিপণিকে রক্ষা করা এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভালোবাসা ছিলো অপরিসীম। তাঁর হাত ধরেই ন্যাশনাল বুক এজেন্সি এবং গণশক্তি প্রিন্টার্সের পথ চলা শুরু। তাঁর লেখা বহু প্রবন্ধ ও রচনা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’, ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম যুগ: ১৯২১-১৯৩৩’, ‘সমকালের কথা’, ‘কৃষকের কথা’, ‘প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯৭৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ৮৪ বছরের জীবনে ৬০ বছরই রাজনৈতিক জীবন। তাঁর বেশিরভাগ সময় কেটেছে পার্টি অফিসে, কারাগারে কিংবা গোপন আস্তানায়। এছাড়া পার্টির পক্ষ থেকে ভাড়া নেওয়া ঘরে অথবা কর্মস্থলে। নিজের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে তিনি কিছুই করেননি। জীবনের ৫২টা বছর তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবেই কাটিয়েছেন।

কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ লাল সেলাম।

কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ অমর রহে। 

Left Squad   প্রতিবেদন