এবছর বহুবিশ্রুত ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য মনোনীত কেরালার প্রাক্তন
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সি পি আই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিতির সদস্য শৈলজা টিচার পুরস্কারটি গ্রহণ করবেন না বলে জানিয়েছেন। কেন করবেন না তার কারণগুলিও স্পষ্টভাবে তাঁর বিবৃতিতে প্রকাশিত। এই নিয়ে প্রচুর বাদবিতণ্ডা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে।

বুর্জোয়া কাগজ হেডলাইন করছে, সি পি আই(এম) শৈলজার পুরস্কার পাওয়াটা বানচাল করে দিল। অন্যদিকে একদল অত্যুৎসাহী বামপন্থী এটাকে একটি ব্যতিক্রমী ত্যাগস্বীকার হিসাবে প্রচার করছেন। কমরেড শৈলজাকে আমি যেটুকু চিনি বা তাঁর সম্বন্ধে যেটুকু জানি তাতে আমার মনে হয় তিনি হয়তো মৃদু হেসে এই দুই প্রতিক্রিয়াকেই প্রত্যাখ্যান করতেন। বহু শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের পরোক্ষ সমালোচনা তিনি করতে চেয়েছেন এমনটাও আমার মনে হয়
না। শৈলজা একজন পোড়-খাওয়া কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টদের কিছু বিশেষ দায়বদ্ধতা থাকে। তার একটি হল বাস্তবের প্রতি স্বচ্ছ দৃষ্টি, আরেকটি সত্যের প্রতি অবিচল অনুরাগ। শৈলজার সিদ্ধান্ত এই দুটি দায়বদ্ধতার চর্চা থেকেই এসেছে বলে আমার মনে হয়।


অবশ্যই এটা খুব স্বাভাবিক যে প্রস্তাব যখন তাঁর কাছে এল তখন তা নিয়ে তিনি পার্টিতে আলোচনা করেছেন। কিন্তু বুর্জোয়া কাগজের বক্তব্য অনুযায়ী এটা কি ধরে নেওয়া যায় যে তিনি পুরস্কার নিতে ইচ্ছুক ছিলেন, পার্টির নির্দেশেই বাধ্য হয়েছেন প্রত্যাখ্যানে? এমনটা কি হতে পারেনা যে নিজস্ব যুক্তি থেকেই তাঁর এবিষয়ে যে আপত্তি ছিল পার্টি তাকেই অনুমোদন করেছে? কমিউনিস্ট পার্টির শৃঙ্খলা তো শেষবিচারে ঐচ্ছিক শৃঙ্খলা। কেউ যদি মনে করেন এতে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত ব্যাহত
হচ্ছে শৃঙ্খলার বাইরে যেতেও তাঁর কোনো অসুবিধা নেই। এমনটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটেও থাকে। কিন্তু শৃংখলারক্ষার প্রশ্নটাই পার্টির সঙ্গে ব্যক্তির আবশ্যিক যোগসূত্র, নিয়ত বুদ্ধিশুদ্ধির প্রয়োগ থেকে, আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ক থেকে সেই সংযোগ আসে না এমনটা বুর্জোয়া কাগজ মনে করতে পারে, আমরা কেন মনে করব?


যুক্তিগুলি শৈলজা টিচার কী দিয়েছেন তা একটু ভেবে দেখা যাক। প্রথমত, নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং করোনা অতিমারীর গতিরোধে কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রকের শীর্ষে থেকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিতেই তাঁকে ম্যাগসেসে পুরস্কার সমিতি নির্বাচন করে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে কেরালাতে একাজ করা গিয়েছিল একটি যৌথ কার্যক্রম হিসাবেই। ব্যক্তিহিসাবে এস্বীকৃতি গ্রহণ মানে সেই যৌথ কাজের
মূল্যকে খর্ব করা। কথাটা খাঁটি সত্য ছাড়া অন্যকিছুই নয়। কমিউনিস্টরা যখন সংসদীয় রীতিনীতি মেনে সাংবিধানিক শপথ নিয়ে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন তখন তাঁদের ওপর দ্বিগুণ ভার বর্তায়। মন্ত্রী হিসাবে এবং কমিউনিস্ট হিসাবে দায়বদ্ধতাকে মেলানোর কাজ তাঁদের করতে হয়। শৈলজা সেকথা মনে রেখে কাজ করেছেন একথাই তাঁর বিবৃতিতে প্রকাশ।


তিনি সংক্রমণের মোকাবিলার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন একথা কেউ অস্বীকার করবে না।কিন্তু কেরালার গোটা স্বাস্থ্যদপ্তরের কর্মীরা, নানা সরকারি প্রকল্পে যুক্ত অসংখ্য অনামা কর্মী, এন.জি.ও, পঞ্চায়েতের নির্বাচিত এবং ভারপ্রাপ্ত লোকজন তৃণমূলস্তর অবধি বিভিন্ন গণসংগঠনের সদস্য এঁরা সবাই যদি সঙ্গে সঙ্গে সরকারের
ডাকে সাড়া না দিতেন, প্রতিটি অঞ্চলে সংক্রমিতদের আলাদা রাখা, তাদের জন্য পরিষেবার ব্যবস্থা করা, কেউ যাতে কাজ হারিয়ে অভুক্ত বা অবহেলিত না থাকে সেজন্য সরকারি সুবিধাগুলিকে পৌঁছে দিতে তৎপর না হতেন তাহলে কোনো একক প্রচেষ্টায় এতবড় সফলতা কি মিলত? কমিউনিস্টরা তো এইভাবেই কাজ করে, সমস্ত জনসাধারণকে সক্রিয় করে তুলে। আজ এরাজ্যের শাসকদল এভাবে কাজ করার কথা
আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৮এর বন্যায় ঠিক এইভাবেই কি কাজ করেনি? কমরেড শৈলজা সেই নিখাদ সত্যটাই আমাদের মনে করাচ্ছেন, অন্য কিছু নয়।


এর পরে আসে তাঁর দ্বিতীয় যুক্তি। রামন ম্যাগসেসের নামটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ফিলিপিনস এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণপশ্চিম প্যাসিফিক এলাকা জুড়ে পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট নিধনের ইতিহাস। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ ফিলিপিনসের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন রামন ম্যাগসেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে। সেটা ছিল তথাকথিত ‘কোল্ড ওয়ারে’র পর্ব। ইন্দোনেশিয়া ফিলিপিনস এবং অন্যান্য দেশে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে যে জন-অভ্যুত্থান ঘটেছিল তার কিছু হদিশ
রয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘অগ্নিকোণ’ কবিতাটিতে। মার্কিন সরকার মরিয়া ছিল এই অঞ্চলে তাদের অনেকদিনের প্রভাবপ্রতিপত্তি ক্ষুণ্ণ হবার সম্ভাবনায়। ম্যাগসেসে এব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের মস্ত সহায় ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি যে কুখ্যাত ম্যানিলা প্যাক্টের অন্যতম হোতা ছিলেন তার উদ্দেশ্যই ছিল ছলেবলেকৌশলে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে জনগণের অধিকারের আন্দোলনকে পরাস্ত করা। মার্কিনিদের সাহায্যে শত শত কমিউনিস্ট যোদ্ধাকে হত্যা করেই আন্দোলনের আগুন নেভানো যায়।
গণতান্ত্রিকতার মুখোস বজায় রেখেই একাজ তিনি করেন, যদিও তাঁর প্রশাসন মার্কিন সরকারের সহায়তায় সেনাপুলিশ ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করে তোলে। এক ‘গণতান্ত্রিক’ প্রেসিডেন্টের স্মৃতিতেই তাঁর নামে রকফেলার ফান্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৭ সাল থেকে চালু করে রামন ম্যাগসেসে আন্তর্জাতিক পুরস্কার।


পরবর্তী সময়ে বহু বছর ধরে মার্কিন সরকারের ছত্রছায়ায় অনেক স্বৈরতন্ত্রী শাসক রাজত্ব করে গেছেন ফিলিপিনসে। এদেশের মার্কিননির্ভরতা কখনো দূর হয়নি। এ যেন কিউবার উলটো ইতিহাস। বিগত অতিমারীর সময়ে মার্কিন দেশে কৃষ্ণাঙ্গদের পাশাপাশি
যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সংক্রমিত হয়েছেন, মারা গেছেন সবচেয়ে বেশি তাঁদের মধ্যে আছেন হতদরিদ্র ফিলিপিনো অভিবাসীরা, যাঁরা কম মাইনের শ্রমিকহিসাবে কাজের খোঁজে সেদেশে ভিড় জমান। কিউবা কিন্তু আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের সামনে অটুট স্পর্ধায় নিজস্ব সার্বভৌমতা বজায় রেখে চলেছে।


হতে পারে তারপরে প্যাসিফিক দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। পুরস্কারের যারা উদ্যোক্তা, তাঁরাও হয়তো চান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই ইতিহাস আড়ালে থাকুক, রামন ম্যাগসেসেকে লোকে মনে রাখুক এক দক্ষ প্রশাসক, এক উন্নয়নশীল দেশে জনমুখী নীতির প্রবর্তক হিসাবে। যাঁদের অন্যকিছু মনে রাখার দায়বদ্ধতা নেই তাঁরা বিবেকের সঙ্গে আপস না করেও এই পুরস্কার গ্রহণ করতেই পারেন। কিন্তু একজন কমিউনিস্টের পক্ষে কি তা সম্ভব? ইতিহাসচেতনা ছাড়া কমিউনিস্টের পথচলা
অসম্ভব। আরো অসম্ভব আজকের দিনে। যখন সাম্রাজ্যবাদ একেক জায়গায় নতুন নতুন রূপ নিচ্ছে, আবার প্রতিপদে তার রক্তাক্ত পদচিহ্ন মুছে ফেলার জন্য নিযুক্ত রয়েছে তার হাজার হাজার ক্রীতদাস, যারা বলছে, কই সাম্রাজ্যবাদ? এখন তো সেসব অতীতের কথা হয়ে গেছে। এই সময়ে কমরেড শৈলজা টিচারের এই বিবৃতি সেই বাস্তবকে
আমাদের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরল। আমাদের মনে করাল, বালিতে মুখ গুঁজে থেকে ইতিহাসকে পালটানোর স্পর্ধা করা যায় না। তিনি কমিউনিস্টের কর্তব্য পালন করেছেন এটাই আসল কথা।