যুক্ত প্রদেশের হারদোই জেলার খাতেলি গ্রামে ১৯০৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন শিব ভার্মা। ভগৎ সিং-এর অন্যতম সহযোগী শিব ভার্মা স্বাধীনতার আগে থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ১৭ বছর বয়সে। কানপুর DAV কলেজে পড়ার সময় ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসে এক সপ্তাহের জন্য কানপুরে আসেন HRA-এর অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে দেখা করতে, তখনই প্রথম পরিচিত হয়  ভগৎ সিং-এর সাথে। হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন শিব ভার্মা। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় কাউনপুরে (এখন কানপুর)। শিব ভর্মা ছাড়াও এই দলের সদস্য ছিলেন বিজয় কুমার সিনহা, জয়দেব কাপুর এবং সুরেন্দ্র নাথ পান্ডের মতো লোকেরা। সমাজতন্ত্রের ভাবনা যাতে আরও দৃঢ় ও শাণিত হয় তার জন্য তাঁর সহকর্মী বিজয় কুমার সিনহা পরিচয় করায় সাংবাদিক ও লেখক রাধা মোহন গোকুলের সাথে। পরবর্তীকালে এই রাধা মোহন গোকুল হয়ে ওঠেন শিব ভার্মার পরামর্শদাতা এবং আদর্শ। তার যথাপোযুক্ত কারণ আছে। সময়টা ছিলো স্বাধীনতার পূর্ববর্তী। যে সময় বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়েছিলো চরমপর্যায়ে। এই সময় কিছু যুবক-যুবতী নিজ প্রাণের আহূতি দিয়ে দেশ রক্ষায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশ স্বাধীনের কাজে ব্রতী হয়েছিলো। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। এরফলে শুধু ভারতে নয় আরো অনেক দেশই পরাধীনতাকে ছিন্ন করে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ছেয়েছিলো সমাজতন্ত্রের ভাবনায়। কিন্তু সমাজতন্ত্রটা কি খায় না মাথায় দেয়! এটা যেমন নিজেদেরকেও জানতে হবে দেশের মানুষকেও বোঝাতে হবে, সেই বোঝা এবং বোঝানোর চাহিদা শিব ভার্মার সমাজতন্ত্রকে জানার স্পৃহা নিজ সামীপ্যে এবং বিপুলরগ্রন্থের সমাহারের যৌথ প্রয়াসে মেটাতে সক্ষম হয়েছিল রাধা মোহন গোকুল।

সালটা ছিলো ১৯২৫, কাকোরী ঘটনার পরবর্তী সময়ে চন্দ্রশেখর আজাদ ঝাঁসিতে যখন নিভৃত বাসে সেই সময় প্রথম সাক্ষাত ঘটে শিব ভার্মার সাথে। সেই সময় শিব ভার্মা কানপুরে আসেন রাধামোহন গোকুলের সাথে থাকতে সঙ্গে ছিলেন কুন্দন লাল। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠরত। এরপর ১৯২৮ সালে একে একে সুখদেব, রাজগুরু এবং অন্যান্যদের সাথে পুনরায় দলবদ্ধ হন। সেই সময় আগ্রায় নূরী গেটের কাছে “আমির চাঁদ” ছদ্মনামে একটি বাড়িও ভাড়া নেন এবং বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নেন।

১৯২৬, ১ মে কাকোরি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা। রাজসাক্ষী হয় দুজন এবং ১৭ জনকে বেকসুর খালাস করে। বাকি ২১ জন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল এই মামলা। ব্রিটিশদের দায়ের করা এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা চলে আঠারো মাস ধরে। যার চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয় ১৯২৭, ৬ এপ্রিল।

এরপর শিব ভার্মা এবং তার সহযোদ্ধা বিজয় কুমার সিনহার ওপর গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাকোরী ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত রায়ে ১০ বছর কারাদণ্ডে দন্ডীত যোগেশ চন্দ্র চ্যাটার্জীকে ফতেহগড় কারাগার থেকে মুক্ত করা অনুমোদন পাওয়ার জন্য। ১৯২৮ এর ৩ মার্চ ফতেহগড়ের কারাগার থেকে দেখা করে বেরোবার পর গোপনে পুলিশ তাদের লক্ষ করছে আঁচ করতে পারে। বুঝতে পেরে অবিলম্বে তড়িঘড়ি ট্রেনের টিকিট কেটে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তাতেও পুলিশের চোখ এড়াতে পারবেন না বুঝতে পেরে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন, সময়মতো জালালাবাদ স্টেশন ছাড়ার সময় তারা ট্রেন থেকে লাফ দেন এবং পুলিশের এক কনস্টেবল তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে আহত হন এবং তারা পালাতে সক্ষম হয়। এরপর বেশ কিছুদিন তাদের গা ঢাকা দিতে হয়।

 কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিলেন শিব ভার্মা। ১৯২৯ সালে শিব ভার্মাকে একটি দলের নেতা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল যেটি ভাইসরয় আরউইনকে হত্যার সম্ভাবনার মূল্যায়ন করবে। চন্দ্রশেখর আজাদ আদেশ দিয়েছিলেন যে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত বিধানসভায় বোমা নিক্ষেপ করার পরে, শিব ভার্মা এবং জয়দেব কাপুর ব্যতীত সবাইকে দিল্লি ছেড়ে যেতে হবে এবং চন্দ্রশেখর আজাদ নিজেই ঝাঁসিতে যাবেন। ভার্মা চন্দ্রশেখর আজাদকে স্টেশনে নামাতে গেলে  আজাদ ভার্মাকে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তের ভাল যত্ন নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এরপর ১৯২৯ সালের মে মাসে সাহরানপুরে একটি বোমা কারখানা স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডঃ গয়া প্রসাদ, জয়দেব কাপুরের সঙ্গে শিব ভার্মাকে। সেখানে তারা ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলো। কিন্তু পুলিশ ও স্থানীয়রা সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তারা নিস্ক্রিয় হয়ে থাকে এবং রাতের বেলা পালা করে রাত জেগে লক্ষ রাখতে থাকে এলাকার পরিস্থিতি। পরিস্থিতি লক্ষ রাখতে নজর পরে পুলিশের তল্লাশি অভিযান। তাই তারা প্রত্যেক মূহুর্তে সাবধানতা অবলম্বন করতেন। এরপর ১৩ মে একদিন সকালে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি দরজা খুলে সামনে সহযোদ্ধা ডঃ গয়া প্রসাদকে দেখতে পেলেও ততক্ষনাৎ নজর যায় সশস্ত্র পুলিশ। সে সময় পুলিশ তাকে জেরা করে তার উত্তরে শিব ভর্মা জবাব দেন বলেছিলেন যে তিনি ডাঃ গয়া প্রসাদের আত্মীয়, তিনি বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এবং এখানে ছুটিতে এসেছেন। কিন্তু পুলিশের চোখ পরে আলমারিতে পড়ে থাকা গানপাউডারের দিকে। সেই সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। এরপর মেজেতে রাখা ট্রাঙ্কটি খুলে, ভিতরে হাত রাখলেন শিব ভার্মা , একটি বোমা তৈরি করলেন এবং এটি ডিএসপির দিকে নিক্ষেপ করার ভান করলেন। ডিএসপি এবং বেশিরভাগ কনস্টেবল বাড়ির বাইরে দৌড়ে গেলেন যখন প্রধান পুলিশ অফিসার দরজার আড়ালে লুকিয়ে ভার্মার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য, বোমা এবং তাদের ট্রিগার করার জন্য প্রয়োজনীয় পিনগুলি আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল। ভার্মা পিন এবং দুটি রিভলভার আরেকটি আলমারিতে রাখতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি বোমাটি মেঝেতে রেখে আলমারির দিকে এগিয়ে যান। অফিসার এই সুযোগটি কাজে লাগান, ভার্মাকে পরাজিত করেন এবং সমর্থনের আহ্বান জানান। কনস্টেবলরা আবার ঢুকে পড়ে এবং অবশেষে কাপুর ও ভার্মা দুজনকেই হাতকড়া পরানো হয়। দুই দিন পরে, ডঃ গয়া প্রসাদ গভীর রাতে কানপুর থেকে ফিরে আসার সময় একই স্থানে গ্রেফতার হন। ভার্মা এবং কাপুর পরে জানতে পেরেছিলেন যে টিপ-অফটি তাদের HSRA স্বদেশী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ দিয়েছিলেন, যিনি পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হয়েছিলেন। এবং এক কনস্টেবল ভার্মার কাছে আত্মপ্রকাশ করেছিল যে ডিএসপি তাদের বলেছিল যে তারা আফিম ব্যবসায়ীদের অভিযান ও গ্রেফতার করতে যাচ্ছে, কনস্টেবলদের যদি বিপ্লবীদের সম্পর্কে কোন ধারণা থাকে তবে তারা তাদের পালাতে দিত।

এরপর শিব ভার্মা এবং তার দুই সহযোদ্ধা জয়দেব কাপুর এবং ডাঃ গয়া প্রসাদকে পাঠানো হয় লাহোর জেলে, এবং খুব কম সময়ের ব্যবধানে, HSRA বিপ্লবীরা বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার হয়ে লাহোর জেলে আসতে থাকেন। ১৯২৯ , ১৩ জুলাই যারা ইতিমধ্যে এক মাস ধরে অনশনে ছিলেন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে শিব ভার্মা, জয়দেব কাপুর, কিশোরী লাল এবং সমস্ত HSRA বিপ্লবীরা অনশন শুরু করেন। জেলে যখন ভগৎ সিং, মহাবীর সিং, রাজগুরু, সুখদেব এবং অন্যান্য আরও বলিষ্ঠ পুরুষরা বেশিরভাগ ক্ষতির সম্মুখীন হন, তখন চিকন এবং শীর্ণ হওয়ায়, শিব ভার্মা পুলিশের কম মারধরের শিকার হন। অনশনরত, যতীন দাসকে জোর করে খাওয়ানোয় আত্মহত্যা করেন ওই পরিস্থিতি সহ্য করতে না পারায় শিব ভার্মার অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে।

এমত অবস্থায় ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার রায় আসে। ইন্সপেক্টর সমবেদনা সহকারে শিব ভার্মা এবং অন্যদের ভগত সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর সাথে শেষবারের মতো দেখা করার অনুমতি দেন। শিব ভার্মার চোখে জল দেখে ‘’ভগৎ সিং মন্তব্য করেছিলেন “শিব, এটা আবেগপ্রবণ হওয়ার সময় নয়। আমি কিছু দিনের মধ্যে সমস্ত অসুবিধা থেকে মুক্তি পাব; কিন্তু আপনাদের সবাইকে একটি দীর্ঘ, কঠিন যাত্রা করতে হবে। আমি আত্মবিশ্বাসী যে ভারী বোঝা সত্ত্বেও দায়িত্বের কারণে, এই দীর্ঘ অভিযানে আপনি ক্লান্ত হবেন না এবং আপনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো নিরাশ হবেন না।‘’

এরপর শিব ভার্মাকে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজমুন্দ্রি জেলে পাঠানো হয় সেখানে তিনি জানতে পারেন প্রথমে আজাদ এবং পরে ভগত সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর মৃত্যুর সংবাদ। পরে তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। ১৯৩৩ সালে, তিনি বন্দীদের, বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে অনশনে অংশগ্রহণ করেন। এই অনশনের সময়, তার HSRA স্বদেশী মহাবীর সিং মারা যান। অন্য যারা মারা গেছেন তারা হলেন মোহিত মৈত্র এবং মানাকৃষ্ণ নবদাস। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অবশেষে দাবিগুলো মেনে নিতে বাধ্য হয়। কারাগার প্রাঙ্গণে একাডেমিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। বন্দীরা সতীশ পাকরাশি, শিব ভার্মা এবং ভূপাল বোসের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে, ভার্মা এবং হরে কৃষ্ণ কোনার নেতৃত্বে ৩৬-দিনের এবং চূড়ান্ত অনশন ধর্মঘট ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে সেলুলার জেল স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার আগে সম্পন্ন হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান।

পরবর্তী জীবনে শিব ভার্মা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উত্তর প্রদেশ রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৪৮ সালে। শিব ভার্মা অবিরাম ভারতীয় বিপ্লবীদের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন বিপ্লবীদের ছবি, প্রবন্ধ সংগ্রহের জন্য। এবং পরবর্তী সময় তিনি ‘লোকলহর’ এবং তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘নয়া সাভেরা’-এর সম্পাদক হন। তিনি একটি হিন্দি জার্নাল নয়া পথের সম্পাদকও ছিলেন।এছাড়াও তিনি শহীদ স্মৃতি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম গবেষণা কেন্দ্র, লখনউ প্রতিষ্ঠা করেন।

যুক্ত প্রদেশের হারদোই জেলার খাতেলি গ্রামে ১৯০৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন শিব ভার্মা। ভগৎ সিং-এর অন্যতম সহযোগী শিব ভার্মা স্বাধীনতার আগে থেকেই সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ১৭ বছর বয়সে। কানপুর DAV কলেজে পড়ার সময় ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসে এক সপ্তাহের জন্য কানপুরে আসেন HRA-এর অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে দেখা করতে, তখনই প্রথম পরিচিত হয়  ভগৎ সিং-এর সাথে। হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন শিব ভার্মা। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, সুরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় কাউনপুরে (এখন কানপুর)। শিব ভর্মা ছাড়াও এই দলের সদস্য ছিলেন বিজয় কুমার সিনহা, জয়দেব কাপুর এবং সুরেন্দ্র নাথ পান্ডের মতো লোকেরা। সমাজতন্ত্রের ভাবনা যাতে আরও দৃঢ় ও শাণিত হয় তার জন্য তাঁর সহকর্মী বিজয় কুমার সিনহা পরিচয় করায় সাংবাদিক ও লেখক রাধা মোহন গোকুলের সাথে। পরবর্তীকালে এই রাধা মোহন গোকুল হয়ে ওঠেন শিব ভার্মার পরামর্শদাতা এবং আদর্শ। তার যথাপোযুক্ত কারণ আছে। সময়টা ছিলো স্বাধীনতার পূর্ববর্তী। যে সময় বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়েছিলো চরমপর্যায়ে। এই সময় কিছু যুবক-যুবতী নিজ প্রাণের আহূতি দিয়ে দেশ রক্ষায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশ স্বাধীনের কাজে ব্রতী হয়েছিলো। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। এরফলে শুধু ভারতে নয় আরো অনেক দেশই পরাধীনতাকে ছিন্ন করে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ছেয়েছিলো সমাজতন্ত্রের ভাবনায়। কিন্তু সমাজতন্ত্রটা কি খায় না মাথায় দেয়! এটা যেমন নিজেদেরকেও জানতে হবে দেশের মানুষকেও বোঝাতে হবে, সেই বোঝা এবং বোঝানোর চাহিদা শিব ভার্মার সমাজতন্ত্রকে জানার স্পৃহা নিজ সামীপ্যে এবং বিপুলরগ্রন্থের সমাহারের যৌথ প্রয়াসে মেটাতে সক্ষম হয়েছিল রাধা মোহন গোকুল।

সালটা ছিলো ১৯২৫, কাকোরী ঘটনার পরবর্তী সময়ে চন্দ্রশেখর আজাদ ঝাঁসিতে যখন নিভৃত বাসে সেই সময় প্রথম সাক্ষাত ঘটে শিব ভার্মার সাথে। সেই সময় শিব ভার্মা কানপুরে আসেন রাধামোহন গোকুলের সাথে থাকতে সঙ্গে ছিলেন কুন্দন লাল। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠরত। এরপর ১৯২৮ সালে একে একে সুখদেব, রাজগুরু এবং অন্যান্যদের সাথে পুনরায় দলবদ্ধ হন। সেই সময় আগ্রায় নূরী গেটের কাছে “আমির চাঁদ” ছদ্মনামে একটি বাড়িও ভাড়া নেন এবং বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নেন।

১৯২৬, ১ মে কাকোরি ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা। রাজসাক্ষী হয় দুজন এবং ১৭ জনকে বেকসুর খালাস করে। বাকি ২১ জন বিপ্লবীর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল এই মামলা। ব্রিটিশদের দায়ের করা এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা চলে আঠারো মাস ধরে। যার চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয় ১৯২৭, ৬ এপ্রিল।

এরপর শিব ভার্মা এবং তার সহযোদ্ধা বিজয় কুমার সিনহার ওপর গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাকোরী ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত রায়ে ১০ বছর কারাদণ্ডে দন্ডীত যোগেশ চন্দ্র চ্যাটার্জীকে ফতেহগড় কারাগার থেকে মুক্ত করা অনুমোদন পাওয়ার জন্য। ১৯২৮ এর ৩ মার্চ ফতেহগড়ের কারাগার থেকে দেখা করে বেরোবার পর গোপনে পুলিশ তাদের লক্ষ করছে আঁচ করতে পারে। বুঝতে পেরে অবিলম্বে তড়িঘড়ি ট্রেনের টিকিট কেটে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তাতেও পুলিশের চোখ এড়াতে পারবেন না বুঝতে পেরে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন, সময়মতো জালালাবাদ স্টেশন ছাড়ার সময় তারা ট্রেন থেকে লাফ দেন এবং পুলিশের এক কনস্টেবল তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে আহত হন এবং তারা পালাতে সক্ষম হয়। এরপর বেশ কিছুদিন তাদের গা ঢাকা দিতে হয়।

 কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিলেন শিব ভার্মা। ১৯২৯ সালে শিব ভার্মাকে একটি দলের নেতা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল যেটি ভাইসরয় আরউইনকে হত্যার সম্ভাবনার মূল্যায়ন করবে। চন্দ্রশেখর আজাদ আদেশ দিয়েছিলেন যে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত বিধানসভায় বোমা নিক্ষেপ করার পরে, শিব ভার্মা এবং জয়দেব কাপুর ব্যতীত সবাইকে দিল্লি ছেড়ে যেতে হবে এবং চন্দ্রশেখর আজাদ নিজেই ঝাঁসিতে যাবেন। ভার্মা চন্দ্রশেখর আজাদকে স্টেশনে নামাতে গেলে  আজাদ ভার্মাকে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তের ভাল যত্ন নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এরপর ১৯২৯ সালের মে মাসে সাহরানপুরে একটি বোমা কারখানা স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডঃ গয়া প্রসাদ, জয়দেব কাপুরের সঙ্গে শিব ভার্মাকে। সেখানে তারা ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলো। কিন্তু পুলিশ ও স্থানীয়রা সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তারা নিস্ক্রিয় হয়ে থাকে এবং রাতের বেলা পালা করে রাত জেগে লক্ষ রাখতে থাকে এলাকার পরিস্থিতি। পরিস্থিতি লক্ষ রাখতে নজর পরে পুলিশের তল্লাশি অভিযান। তাই তারা প্রত্যেক মূহুর্তে সাবধানতা অবলম্বন করতেন। এরপর ১৩ মে একদিন সকালে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি দরজা খুলে সামনে সহযোদ্ধা ডঃ গয়া প্রসাদকে দেখতে পেলেও ততক্ষনাৎ নজর যায় সশস্ত্র পুলিশ। সে সময় পুলিশ তাকে জেরা করে তার উত্তরে শিব ভর্মা জবাব দেন বলেছিলেন যে তিনি ডাঃ গয়া প্রসাদের আত্মীয়, তিনি বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এবং এখানে ছুটিতে এসেছেন। কিন্তু পুলিশের চোখ পরে আলমারিতে পড়ে থাকা গানপাউডারের দিকে। সেই সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন। এরপর মেজেতে রাখা ট্রাঙ্কটি খুলে, ভিতরে হাত রাখলেন শিব ভার্মা , একটি বোমা তৈরি করলেন এবং এটি ডিএসপির দিকে নিক্ষেপ করার ভান করলেন। ডিএসপি এবং বেশিরভাগ কনস্টেবল বাড়ির বাইরে দৌড়ে গেলেন যখন প্রধান পুলিশ অফিসার দরজার আড়ালে লুকিয়ে ভার্মার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য, বোমা এবং তাদের ট্রিগার করার জন্য প্রয়োজনীয় পিনগুলি আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল। ভার্মা পিন এবং দুটি রিভলভার আরেকটি আলমারিতে রাখতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি বোমাটি মেঝেতে রেখে আলমারির দিকে এগিয়ে যান। অফিসার এই সুযোগটি কাজে লাগান, ভার্মাকে পরাজিত করেন এবং সমর্থনের আহ্বান জানান। কনস্টেবলরা আবার ঢুকে পড়ে এবং অবশেষে কাপুর ও ভার্মা দুজনকেই হাতকড়া পরানো হয়। দুই দিন পরে, ডঃ গয়া প্রসাদ গভীর রাতে কানপুর থেকে ফিরে আসার সময় একই স্থানে গ্রেফতার হন। ভার্মা এবং কাপুর পরে জানতে পেরেছিলেন যে টিপ-অফটি তাদের HSRA স্বদেশী ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ দিয়েছিলেন, যিনি পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হয়েছিলেন। এবং এক কনস্টেবল ভার্মার কাছে আত্মপ্রকাশ করেছিল যে ডিএসপি তাদের বলেছিল যে তারা আফিম ব্যবসায়ীদের অভিযান ও গ্রেফতার করতে যাচ্ছে, কনস্টেবলদের যদি বিপ্লবীদের সম্পর্কে কোন ধারণা থাকে তবে তারা তাদের পালাতে দিত।

এরপর শিব ভার্মা এবং তার দুই সহযোদ্ধা জয়দেব কাপুর এবং ডাঃ গয়া প্রসাদকে পাঠানো হয় লাহোর জেলে, এবং খুব কম সময়ের ব্যবধানে, HSRA বিপ্লবীরা বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার হয়ে লাহোর জেলে আসতে থাকেন। ১৯২৯ , ১৩ জুলাই যারা ইতিমধ্যে এক মাস ধরে অনশনে ছিলেন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে শিব ভার্মা, জয়দেব কাপুর, কিশোরী লাল এবং সমস্ত HSRA বিপ্লবীরা অনশন শুরু করেন। জেলে যখন ভগৎ সিং, মহাবীর সিং, রাজগুরু, সুখদেব এবং অন্যান্য আরও বলিষ্ঠ পুরুষরা বেশিরভাগ ক্ষতির সম্মুখীন হন, তখন চিকন এবং শীর্ণ হওয়ায়, শিব ভার্মা পুলিশের কম মারধরের শিকার হন। অনশনরত, যতীন দাসকে জোর করে খাওয়ানোয় আত্মহত্যা করেন ওই পরিস্থিতি সহ্য করতে না পারায় শিব ভার্মার অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে।

এমত অবস্থায় ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার রায় আসে। ইন্সপেক্টর সমবেদনা সহকারে শিব ভার্মা এবং অন্যদের ভগত সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর সাথে শেষবারের মতো দেখা করার অনুমতি দেন। শিব ভার্মার চোখে জল দেখে ‘’ভগৎ সিং মন্তব্য করেছিলেন “শিব, এটা আবেগপ্রবণ হওয়ার সময় নয়। আমি কিছু দিনের মধ্যে সমস্ত অসুবিধা থেকে মুক্তি পাব; কিন্তু আপনাদের সবাইকে একটি দীর্ঘ, কঠিন যাত্রা করতে হবে। আমি আত্মবিশ্বাসী যে ভারী বোঝা সত্ত্বেও দায়িত্বের কারণে, এই দীর্ঘ অভিযানে আপনি ক্লান্ত হবেন না এবং আপনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো নিরাশ হবেন না।‘’

এরপর শিব ভার্মাকে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজমুন্দ্রি জেলে পাঠানো হয় সেখানে তিনি জানতে পারেন প্রথমে আজাদ এবং পরে ভগত সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর মৃত্যুর সংবাদ। পরে তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়। ১৯৩৩ সালে, তিনি বন্দীদের, বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে অনশনে অংশগ্রহণ করেন। এই অনশনের সময়, তার HSRA স্বদেশী মহাবীর সিং মারা যান। অন্য যারা মারা গেছেন তারা হলেন মোহিত মৈত্র এবং মানাকৃষ্ণ নবদাস। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অবশেষে দাবিগুলো মেনে নিতে বাধ্য হয়। কারাগার প্রাঙ্গণে একাডেমিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। বন্দীরা সতীশ পাকরাশি, শিব ভার্মা এবং ভূপাল বোসের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে, ভার্মা এবং হরে কৃষ্ণ কোনার নেতৃত্বে ৩৬-দিনের এবং চূড়ান্ত অনশন ধর্মঘট ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে সেলুলার জেল স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার আগে সম্পন্ন হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান।

পরবর্তী জীবনে শিব ভার্মা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উত্তর প্রদেশ রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৪৮ সালে। শিব ভার্মা অবিরাম ভারতীয় বিপ্লবীদের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন বিপ্লবীদের ছবি, প্রবন্ধ সংগ্রহের জন্য। এবং পরবর্তী সময় তিনি ‘লোকলহর’ এবং তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘নয়া সাভেরা’-এর সম্পাদক হন। তিনি একটি হিন্দি জার্নাল নয়া পথের সম্পাদকও ছিলেন।এছাড়াও তিনি শহীদ স্মৃতি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম গবেষণা কেন্দ্র, লখনউ প্রতিষ্ঠা করেন।