স্বাধীনতা সংগ্রামী, সি.পি.আই. (এম.) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য ও ‘দেশহৈতেষী’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সুধাংশু দাশগুপ্ত। জন্ম ১৯১২ সালের ৩০শে জানুয়ারী বরিশালে।


সুধাংশু দাসগুপ্ত বরিশালে ছাত্রজীবন থেকেই সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন।  ছাত্র জীবনেই স্বাধীনতার জন্য দীক্ষিত হয়েছিলেন বিপ্লবী মন্ত্রে। নিরঞ্জন সেন, সতীশ পাকড়াশী প্রমুখ সশস্ত্র বিপ্লবীদের নেতৃত্বে যোগ দিয়েছিলেন রিভোল্ট গ্রুপে।


১৯২৭ সালে ম্যাট্রিক ও ১৯২৯ সালে বি.এম. কলেজ থেকে আই.এসসি পাশ করে ডাক্তারি পড়ার জন্য কলকাতায় এসে কারমাইকেল (বর্তমান আর.জি. কর) কলেজে ভর্তি হন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্তের মাধ্যমে বিপ্লবী নিরঞ্জন সেনগুপ্তের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে কলকাতায় মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় আরও ২৩ জনের সঙ্গে অভিযুক্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন। ১৯৩০ সালে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী থাকার সময় কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হালিমের সাথে পরিচিত হন। সেখানেই সুধাংশু দাশগুপ্ত ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ পাঠ করেন এবং নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। ১৯৩২ সালে অন্যান্যদের মতো তাঁকেও ডান্ডাবেরি পরিয়ে জাহাজে আন্দামান জেলে পাঠানো হয়। তিনি আন্দামানে নির্বাসিত হন। সেখানে কমিউনিস্ট কনসলিডেশনে যোগ দেন এবং মার্কসবাদী হয়ে ওঠেন। সেখানে কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন ক্যাম্পের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৩৪ সালে আন্দামান থেকে  তাঁকে  কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসা হয় এবং মুক্তি দেওয়া হয় ১৯৩৫ সালে। ছাড়া পেয়ে তিনি বরিশালে গিয়ে বি.এম. কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে বি.এ. এবং ১৯৩৮ সালে এম.এ. পাশ করেন।  ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কমরেড পি. সি. যোশীর তত্ত্বাবধানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ অর্জন করেন। এমএ পাশ করার পর তিনি ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে কাজ শুরু করেন এবং ক্রমে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল হালিমের সম্পাদনায় কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘আগে চলো’ প্রকাশিত হলে তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ধীরে ধীরে নিজেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারায় শিক্ষিত করে তোলেন। ১৯৪০ সালে তিনি পার্টির পত্র-পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। এরপর ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণা হয়। সেই সময় বিভিন্ন নামে কিছুদিন অন্তর গোপন পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকে। ১৯৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দে পার্টির নির্দেশে তিনি নয়াদিল্লিতে যান এবং কিছুদিন কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক ইংরেজি মুখপত্র ‘ক্রসরোড’ পত্রিকা পরিচালনার কাজ করেন। এরপর আবার তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন১৯৫৩ সালে। তারপর যোগ দেন ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায়। 


কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে যে মতাদর্শগত বিতর্ক ও সংগ্রাম চলে সুধাংশু দাশগুপ্ত তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ১৯৫৪-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৩ সালে সংশোধনবাদী নেতৃত্ব কর্তৃক তিনি ‘স্বাধীনতা’ থেকে বরখাস্ত এবং পার্টি থেকে বিতাড়িত হন। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে পার্টির মার্কসবাদী নেতৃত্ব জেল থেকে ছাড়া পেয়েই সুধাংশু দাশগুপ্তকে তাঁর পার্টি সদস্যপদ ফিরিয়ে দেন। 
‘দেশহৈতেষী’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। তখন থেকেই তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হন এবং পরিচালনা করেন।১৯৬৩ সালের ১৬ই আগস্ট ‘দেশহিতৈষী’ প্রকাশিত হলে তিনি সম্পাদকমন্ডলীর অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ‘দেশহিতৈষী’ পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। সুধাংশু দাশগুপ্তের পরিচালনায় ‘দেশহিতৈষী’ সংশোধনবাদ এবং সঙ্কীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রামে ইতিহাস হয়ে আছে। ১৯৬৪ সালে সুধাংশু দাশগুপ্ত পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং পার্টি কংগ্রেসের পরেই ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৬ সালের ৫ই মে মুক্তি পান।
১৯৬৬ সালের ১৮ই নভেম্বর মোহিত মৈত্র প্রয়াত হলে সুধাংশু দাশগুপ্ত দেশহিতৈষীর সম্পাদকের দায়িত্ব এবং সংবাদ সম্পাদনার কাজও করেছেন। 


১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য এবং পার্টির শিক্ষা সাব-কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ২০০২ সালের মে মাসের তিনি শারীরিক অসুস্থতার জন্য সম্পাদকের দায়িত্ব ত্যাগ করেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ চর্চার বহু পুস্তকের তিনি রচয়িতা।
যেমন মার্কসবাদী: কী ও কেন?’, ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রসঙ্গে’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা’, ইত্যাদি।