দুর্নীতি দুর্নীতি আর দুর্নীতি। বেসুমার দুর্নীতি। শুধু স্কুলের বিভিন্ন পদে দুর্নীতির খনি খুঁড়েই, এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা উদ্ধার হয়ে গিয়েছে। এ নাকি কিছুই নয়! বাপ রে বাপ! আরও কত কোটি যে বেরোবে! বাংলার মানুষ এতো এতো টাকা কোনদিন চোক্ষে দেখে নি।

বালিখাদান, কয়লাখনি লুট করে, গরু পাচার করে তিহাড় জেলে বন্দি তৃণমূলী বেতাজ বাতসা। তারও যে দুর্নীতির পথে অর্জণ শত শত কোটি টাকা নগদে ও সম্পদে, তাও সবার জানা হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এ সবের শেষ দেখে ছাড়তে হলে –তৃণমূল-বিজেপি’র মধ্যে যে সাঁট হয়েছে, তাকে ছিঁড়ে ফেলতে হবে। গণপ্রচার সেই পথেই এগোচ্ছে।

যোগ্য পার্থীদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। আট হাজার স্কুল উঠে গেল, ২৫ লক্ষ ছাত্র শিক্ষার আঙ্গিনার বাইরে চলে গেল। ‘উৎসশ্রী’র কল্যানে ঢালাও বদলি নিয়ে নেওয়ার কারণে, বিশেষ করে গ্রামীণ স্কুলগুলো শিক্ষক বিহীন হয়ে যাচ্ছে। কংকালসার চেহারা তাদের। সরকার এসবে প্রশ্রয় দিচ্ছে, কারণ ওদের মূল লক্ষ্য শিক্ষাকে বেসরকারীকরণ করা।

ফসলের দাম পায় না চাষি, সারের, বীজের কালোবাজারির অগ্নিমূল্যে গম সরষে আবাদ করতে নাভিশ্বাস। চারজন আলুচাষি আত্মহত্যা করলেন। আলুর সরকারী দাম ও কেনার নীতি যা ঘোষোণা হয়েছে, তা কৃষক মারার আরেক ফাঁদ। কেনা হবে, মোট উৎপাদনের মাত্র সাত শতাংশ। দর যা ঘোষণা করেছে, তা উৎপাদন খরেচের অর্ধেকও নয়। পেঁয়াজের দামেও ঠকছে চাষি। সেজন্য এসব নিয়ে পথ অবরোধ হলো সারা রাজ্য জুড়ে।

ঘর পায় নি বেশিরভাগ গরিব মানুষ। যারা পেয়েছে তাদর নগদ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তবুও কিছুটা অবধি উঠে, সেসব পড়ে আছে। পানীয় জলের সংকট সব গরিব পাড়ায়।

এরমক, চিকিৎসা না পাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ, এডিনো ভাইরাসে অকাল মৃত শতাধিক শিশু। জিনিস-পত্র কিনতে গিয়ে হাত পুড়ে যাচ্ছে মানুষের, গ্যাসের দামের তাপ গ্যাসের উনোনের আগুনের থেকেও বেশি। জ্বালা ধরছে মানুষের গায়ে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই পাকারাস্তায় পিচ উঠে গিয়ে পায়ের ছাল –চামড়া উঠে যাচ্ছে মানুষের।

বাংলার প্রতিটি পাড়া থেকে যত পরিযায়ী গিয়েছে ভিনরাজ্যে, তাদের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। যুবক–যুবতি, স্বামি–স্ত্রী-সন্তান বাইরের রাজ্যে খাটতে গিয়েছে গ্রাম উজার করে।

এই সব কদাকার নৈরাজ্য দূর করার জন্য কৃষকদের, শ্রমিকদের, ছাত্রদের,যুবদের- শিক্ষকদের-কর্মচারীদের বাংলা কাঁপানো লড়াই আমরা চলতি সময়ে দেখতে পাচ্ছি, নির্বাচনী সংগ্রামগুলিতেও বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয় দেখতে পাচ্ছি আমরা।

আমরা ক’দিন আগেই দেখলাম – ভয়ভীতি, নানা কালা অধ্যাদেশকে বুড়ো আগুল দেখিয়ে কর্মচারী শিক্ষকদের অভুতপুর্ব ধর্মঘট ন্যায্য ডি এ’র দাবিতে। কিন্তু দাবি উপস্থাপনে গুণগত তফাত কী? ধর্মঘট আহ্বায়করা আরও দাবি করলেন, বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের প্রায় ১৩ লক্ষ শূণ্যপদে নিয়োগ দিতে হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং গণতন্ত্র ধবংস করা চলবে না।

এসময়ের একটা বড় ব্যাপার ত্রিপুরা। সেখানে ভেদবাদী দল ও বিজেপি’র ষড়যন্ত্রে, মানুষের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতিহীন ফলাফল এসেছে। এতো করেও, মাত্র কানের কাছ দিয়ে জিতেই বিজেপি হত্যা, দৈহিক আক্রমন, ভাঙচুর, লুট অগ্নি সংযোগ, চাঁদার জুলুম ইত্যাদি দুষ্কাণ্ড চালাচ্ছে। ত্রিপুরায় বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি তার বিরুদ্ধে লড়ছে।

বর্তমানে যে লড়াইগুলো চলছে, সেই লড়াইয়ের বিষয়গুলির সঙ্গে যুক্ত করে ত্রিপুরার জন্যও সংহতি মূলক লড়াই লড়ে চলেছে পঃবংগবাসী।

উল্লিখিত সংগ্রামগুলিকে বিজেপি ও তৃণমূল সাঁট করে নানা কায়দায় বেপথু করতে চাইছে। তার মধ্যে অন্যতম ভেদবাদীতা ও সাম্প্রদায়ীকতার জঘন্য রাজনীতির প্রসার ঘটানোর অপচেষ্টা।

কিন্তু এই সংগ্রামগুলো বিপন্ন বিধ্যস্ত মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে পরিণত হওয়ায় ঐ সাম্প্রদায়ীকতা ও ভেদবাদীতা হালে পানি পাচ্ছে না বিশেষ।

অর্থনৈতিক সহ জীবনের নানা দাবি নিয়ে শ্রেণী ও গণ আন্দোলন এবং ভাবাদর্শিক ক্ষেত্রে লড়াই গড়ে উঠছে। মানুষের ভয়ের আগল ঘুচে যাচ্ছে। একজন বলছিলেন – ভয়টা যেমন সংক্রামক, তেমনই সাহসটাও সংক্রামক। মানুষের মধ্যে সেই সাহসের উদ্ভাস দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু জনশত্রুরা ক্ষমতার এক বিকৃত স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। ওদের টিকে থাকার মূল উপাদান হিংসা, জিঘাংসা। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ও ভোট লুট করা। হিংসা–জিঘাংসা চালানোর মূল ‘কারিগর’ লুম্পেনরা। ওঁচা সমাজবিরোধীরা। তাদের ভরণপোষণের মূল উপাদন অবৈধ পথে অর্জিত লূটের বেলাগাম অর্থ। ‘রাজত্ব’ ছাড়া সেই অর্থের জোগান বন্ধ হয়ে যাবে।

লক্ষ্যন দেখে বোঝা যাচ্ছে – তৃণমূলের আয়ূ আর বেশি দিন স্থায়ী নয়। কিন্তু দুর্নীতি, স্বৈরাচারীতা ও শয়তানি এক্ষুনি ছেড়ে দেবে তা ভাবা ভুল হবে। ছাড়বে না। না হলে দেখলেন না, দশই মার্চের অভূতপূর্ব ধর্মঘটের পরের দিন ঐ লুম্পেনরা ভীতি প্রদর্শণের দুঃসাহস দেখালো। কিন্তু নতুন বিষয়, এবার তারা পর্যুদস্ত হলো।

ওরা মরণকামড় দিতে কসুর করবে না। সেজন্যই এই সন্ধিকালে আমাদের দিক থেকে আরও সাহস, জঙ্গিত্ব ও প্রত্যাঘাত দরকার। দরকার আরও বেশি বেশি ধারাবাহিক লড়াই। এপথেই ওদের উৎখাত করতে হবে। আর দরকার শ্রেণী ও গণ সংগঠনগুলির মধ্যে তীক্ষ্ণ বোঝাপড়া বজায় রাখা। বজায় রাখা চিন্তা ও কাজের ঐক্য। তাতে এমন ঐকতান সৃষ্টি হবে, যে জনতা তাদের মুক্তির পথে সঠিকভাবে চলতে পারবে ঐক্যবদ্ধভাবে। জয় হয়ে অবধারিত।

এখন একটা গ্রামীণ গল্প শোনাই —

কনসার্ট

আলকাপ যাত্রা গান। মাঝখানে চৌকি দিয়ে তৈরি স্টেজ।

স্টেজের পিছনে সাজঘর – গ্রীনরুম। সেখান থেকে স্টেজে আসে প্লেয়াররা। সামনে দর্শক, এ পাশে দর্শক, ওপাশে দর্শক। কিন্তু স্টেজের একেবারে পাশে দুধারে থাকে কনসার্ট পার্টি।

বাঁশি, জুড়িমন্দিরা, কর্নেট, ফ্লুটবাঁশি, হারমনিয়ম, তবলাডুগি, ঢোলক, ক্যাসিও ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে দু’পাশে বসেন যন্ত্রীরা।

আলোকাপ গান শুরু হবার অনেক আগেই ওঁরা নিজ নিজ যন্ত্র নিয়ে বসে পরেন।

মাঝখানে বড় স্টেজ। মুখোমুখী সামনা সামনি, কিন্তু মাঝখানের স্টেজের কারণে কিছুটা দূরে দূরেই হয় তাদের বসার জায়গা।

আগে যন্ত্রগুলো সুরে বাঁধতে হবে। তখন বাজনদাররা কী করেন? পরস্পর দূরে বসে থেকেও চোখের ঈশারাতে নিজ নিজ যন্ত্রের স্কেল সমান করে নেয়। যাতে একটার সঙ্গে অপরাটার ধ্বনিসাম্য থাকে।

তারপর এক বেল, দু’বেলের পর তিন বেল পরার সঙ্গে সঙ্গে সুর তালের মিলিত মধুর সুরধ্বনি সমস্ত দর্শককে মোহিত করে দেয়।

যদি নিজেরা ঐভাবে বোঝাপড়া না করে নিতেন, যদি প্রত্যেকের বাদ্যযন্ত্র থেকে একেক রকমের স্বর বেরতো, তবে কি এমন সুন্দর সুরধ্বনি শুনতে পারত দর্শক সাধারণ? অত সুন্দর আবহ তৈরি হতো চরাচরে! হতো না। লড়াইয়ের ময়দানে এই পদ্ধতিটাই আমাদের নিতে হবে।