ইতিহাসকে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে আমরা কি ভাবে দেখবো? সেখান থেকে আমরা কি ভাবেই বা শিক্ষা গ্রহণ করবো তা নিয়ে পন্ডিতজনের মধ্যে বিস্তর মত পার্থক্য রয়েছে। আসলে এই মত পার্থক্যটা চিন্তার, চেতনার। ঐতিহাসিক ভাবে আমাদের এই বাংলার মাটিতেই এমন পরস্পর বিরোধি মতামত গড়ে উঠেছিল। আমি আমার আলোচনাটা এমনই দুজন মানুষের সম্পর্কে করতে চাই, যাঁদের কর্মকান্ডের মধ্যে বেশ কিছু মিল থাকলেও মূলত মতাদর্শগত পার্থক্য থাকার কারণে দুজনের কর্মধারা দুই স্রোতে প্রবাহিত হয়েছিল। এই দুজন ব্যাক্তি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ও নরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়।

প্রথমেই আলোচনাটা একটা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে শুরু করা যাক, বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত) একবার মাত্র একমাসের জন্য (1886 সালের জুন মাসে) একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মজার ব্যাপারটা হলো, যিনি বিবেকানন্দকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন তিনিই মাত্র একমাসের মধ্যেই কর্তব্যে অবহেলার জন্য বরখাস্তও করেছিলেন। স্কুলটির নাম মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বৌবাজার শাখা)। আর যিনি বিবেকানন্দকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ও বরখাস্ত দুটোই করেছিলেন তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।

পরবর্তী সময়ে নরেন্দ্রনাথ দত্ত হিন্দু ধর্মের একজন প্রচারক হিসেবে বিখ্যাত হন এবং রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। রামকৃষ্ণ মিশন তৈরির জন্য তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যান এবং সেখান থেকে মিশন গড়ে তুলবার জন্য প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার নীরবেই কাজ করে যান।

পার্থক্যটা আসলে এখানেই…চিন্তাধারার, শিক্ষার। একজন আধ্যাত্মিক পীড়নের সমর্থক ও প্রচারক আর একজন ঠিক তার বিপরীত; যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী, হৃদয়বান একজন সাচ্চা মানুষ। আর তাই তার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এত বিস্তর তারতম্য। একজন সন্ন্যাসীর বেশ ধরে ধর্মের ঢোল পিটিয়ে সাড়ম্বরে মানুষের সেবা করবো বলে মিশন গঠনের জন্য দেশে বিদেশে ঘুরেবেড়ান…এবং পাই পয়সার হিসেব পর্যন্ত বুঝে নেন (বিবেকানন্দের লেখা ব্যাক্তিগত চিঠিপত্রে এর ভুঁড়ি ভুঁড়ি উদাহরণ রয়েছে)। আর একজন নারী শিক্ষার জন্য, দেশবাসীর প্রান্তিক মানুষের শিক্ষার জন্য নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেন। এই কাজ করার জন্য তাকে কিন্তু মেকি সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করতে হয়নি। সমস্ত বাঁধাকে উপেক্ষা করে মানুষের মনে জ্ঞানের আলো সঞ্চারিত করবার কাজ একাগ্রচিত্তে করে গিয়েছেন। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে না পারলে এই পীড়ন থেকে মুক্তির পথ পাওয়া অসম্ভব। ছল-চাতুরীর দ্বারা যে এই কাজ হওয়ার নয় তা তিনি নিশ্চিত ভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই মাত্র একমাসের মধ্যেই কর্তব্যে অবহেলার জন্য বরখাস্ত করেছিলেন বিবেকানন্দকে। বিবেকানন্দ কিন্তু এই বিষয়টি খুব সহজ ভাবে নেননি। বরং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রতি যথেষ্ট রাগ যে পুষে রেখেছিলেন তা মহেন্দ্র গুপ্তর (বা মাস্টার বা শ্রীম) সাথে এই কথোপকথনের দ্বারা বেশ স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যায়-

মাস্টার (বিবেকানন্দের প্রতি)- বিদ্যাসাগর বলেন, আমি বেদ খাওয়ার ভয়ে ঈশ্বরের কথা কাউকে বলি না।

নরেন্দ্র বেত খাবার ভয়।

মাস্টার বিদ্যাসাগর বলেন, মনে কর, মরবার পর আমরা সকলে ঈশ্বরের কাছে গেলুম। মনে কর, কেশব সেনকে, যমদূতেরা ঈশ্বরের কাছে নিয়ে গেল। কেশব সেন অবশ্য সংসারে পাপ টাপ করেছে। যখন প্রমাণ হলো তখন ঈশ্বর হয়ত বলবেন, ওঁকে পঁচিশ বেত মার। তারপর মনে কর, আমাকে নিয়ে গেল। আমি হয়ত কেশব সেনের সমাজে যাই। অনেক অন্যায় করিছি। তার জন্য বেতের হুকুম হলো। তখন আমি হয়ত বল্‌লাম, কেশব সেন আমাকে এই রূপ বুঝিয়েছিলেন, তাই এইরূপ কাজ করিছি। তখন ঈশ্বর আবার দূতদের হয়ত বলবেন, কেশব সেনকে আবার নিয়ে আয়। এলে হয়ত তাকে বলবেন, তুই একে দিছিলি? তুই নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু জানিস না, আবার পরকে উপদেশ

দিছিলি? ওরে কে আছিস— একে আর পঁচিশ বেত দে। (সকলের হাস্য)।

তাই বিদ্যাসাগর বলেন, নিজেই সামলাতে পারি না, আবার পরের জন্য বেত খাওয়া। (সকলের হাস্য) নিজে ঈশ্বরের বিষয় কিছু বুঝি না, আবার পরকে কি লেকচার

দেবো ?

নরেন্দ্র— যে এটা বোঝেনি, সে আর পাঁচটা বুঝলে কেমন করে?

মাস্টার আর পাঁচটা কি?

নরেন্দ্র— যে এটা বোঝে নাই, সে দয়া, পরোপকার বুঝলে কেমন করে? স্কুল বুঝলে কেমন করে? স্কুল করে ছেলেদের বিদ্যা শিখাতে হবে, আর সংসারে প্রবেশ করে, বিয়ে

করে ছেলে মেয়ের বাপ হওয়াই ঠিক, এটাই বা বুঝলে কেমন করে।

যে একটা ঠিক বোঝে, সে সব বোঝে। (শ্রীম। ১৩৭৭ ব. : ২ : ২৫১-৫২)।

শুধু তাই নয়, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে বিবেকানন্দ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বাম বিদ্রুপ করতে শুরু করেন। বাল্যবন্ধু প্রিয়নাথ সিংহকে বিবেকানন্দ বলেন, “দেশের মহা দুর্গতি হয়েছে, কিছু কররে। ছোট ছেলেদের লক্ষ্য করার বিষয় মেয়েদের নয়] পড়বার উপযুক্ত একখানাও কেতাব নেই।

[প্রিয়নাথ সিংহর] প্রশ্ন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তো অনেকগুলি বই আছে।

এইকথা বলামাত্র স্বামীজী [বিবেকানন্দ ] উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, ‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক : ওতে কোন কাজ হবে না। শুতে মন্দ বই ভাল হবে না।” (পূর্ণাত্মানন্দ সম্পাদিত। ২০১২: ১৪৬)।

দুজনের মধ্যেকার চিন্তাধারার ও শিক্ষার পার্থক্যটা যে কোথায় তা বুঝতে হলে বুঝতে হবে দুজনের জীবন দর্শনকে। যেখানে বিবেকানন্দ বিধবা বিবাহ বিরোধিতা করেছিলেন, বাল্যবিবাহের সমর্থক ছিলেন এমনকি সতীদাহের মতোন কুপ্রথারকে শুধু সমর্থনই করেননি সতীত্বের মাহাত্ম্যও প্রচার করেছিলেন। উল্টো দিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় সমস্ত কুপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছিলেন। একদম সামনে দাঁড়িয়ে এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কল্পিত ঈশ্বরের প্রতি এতটুকুও ভক্তিভাব তার কোনও দিনই ছিল না। বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র তার দাদার সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখেন, “অগ্রজ মহাশয় শৈশবকাল হইতে কাল্পনিক দেবতার প্রতি কখনোই ভক্তি বা শ্রদ্ধা করিতেন না” (শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন। 2002)। আর বিদ্যাসাগর মহাশয় ধর্ম সম্পর্কে বলতে গেলেই মজা করে বলতেন, “দেখ, ধর্ম-কর্ম ওসব দলবাঁধা কান্ড।”

ইতিহাসের পথ ধরে আমরা হাঁটবো, জানবো এবং নিজস্ব বিচার বোধ দিয়ে বুঝতে শিখবো কাকে আমরা কাপুরুষ বলবো এবং কাকেই বা একজন সাচ্চা মানুষ হিসেবে মানবো।