কোনও কোনও মহল থেকে প্রায়শই অভিযোগ ওঠে যে বামেরা মূলতঃ সিপিআই (এম)নাকি বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভাতে বিজেপির সঙ্গে হাত ধরে সরকার চালিয়েছে।সাম্প্রতিক সময়ে পাটনা এবং বেঙ্গালুরু তে বিজেপি বিরোধী জোটের মঞ্চে সিপিআই(এম)র উপস্থিতির পর এই অসত্য তথ্য আবার বাজারে ছাড়া হচ্ছে।এই অভিযোগ যে কতখানি অসত্য তার নজির ইতিহাস বহন করছে।

১৯৮৯সালের ৯ম লোকসভা নির্বাচনে প্রধান ইস্যু ছিল দুর্নীতি।দেশের প্রতিরক্ষার সঙ্গে যুক্ত অস্ত্র কেনার (বোর্ফস কামান)ক্ষেত্রে ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগে জাতিয় রাজনীতি তোলপাড় হয়ে ওঠে।জাতীয় রাজনীতির পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বামেরা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দেয়।সেই সরকারের অংশগ্রহণ করেনি।


এই সরকার কে বাইরে থেকে সমর্থন দেওয় হয়েছিল মাত্র, কোনও অভিন্ন নূন্যতম কর্মসূচির ভিত্তিতে কোনও জোট হয়নি।বিজেপি ও এই সরকার কে সমর্থন দিয়েছিল বাইরে থেকেই। কিন্ত কোনও ভাবেই একথা বলা চলেনা বামেরা বিজেপির সঙ্গে জোট গঠন করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহকে সমর্থন করেছিল।
ভিপি সিংহের সরকার কে সমর্থন দেওয়ার পিছনে বামেদের উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতির পাঁকে ক্রমশ যেভাবে ভারতবর্ষ ডুবে যাচ্ছিল যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ সেই দুর্নীতির হাত থেকে ভারতের জনগণ কে রক্ষা করা।
বিজেপির এই সরকারে সমর্থন দেওয়ার নির্দিষ্ট এজেন্ডা ছিল ওদের পরিকল্পনা ছিল এরকম ৮০র বেশি সাংসদের সমর্থনের উপর ভি পি সরকারের স্থায়িত্ব অনেক খানি নির্ভরশীল এই সুযোগে নিজেদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী যে এজেন্ডা সেই এজেন্ডা পূরন ।
কিছু সময়ের মধ্যেই তারা নিজেদের উগ্রহিন্দু মৌলবাদী কার্যকলাপের সূচনা করে। ১৯৯০ সালের ২৩ এবং ২৪শে জুন হরিদ্বারে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মার্গদর্শক মন্ডলির কেন্দ্রীয় পরিষদের বৈঠক হয় যেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ৩০ শে অক্টোবর দেওটা একাদশীর দিনে, অযোধ্যায় করসেবা শুরু হবে।জুলাই ১৯৯০ এ, চেন্নাইয়ে আর এস এসের রাজনৈতিক শাখা বিজেপির রাষ্ট্রীয় কার্যকারিনী বৈঠকে এই কর্মসূচিকে সমর্থন করা হল ।এই কর্মসূচির পক্ষে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে এল কে আদবানী বললেন, “এর ফলে রাজনৈতিক পুনর্গঠন হতেই পারে, রিঅ্যালায়েনমেন্ট হতেই পারে, আমরা প্রয়োজনে সংসদে বিরোধী চেয়ারে বসতে রাজী আছি, করসেবা হবে”।
ভিপি সিং বুঝতে পেরেছিলেন হিন্দুত্বর তাস খেলাটাই বিজেপির উদ্দেশ্য, তিনি , রাম বিলাস পাশওয়ানকে সামনে রেখে, মন্ডল কমিশনের সুপারিশ কিভাবে লাগু করা যায়, তার প্রস্তুতি শুরু করলেন।
১৯৯০র ২৯ সেপ্টেম্বর দশেরা থেকে করসেবককরা রওনা দিল উওর প্রদেশের অযোধ্যার দিকে। ইতিমধ্যেই ১৫ আগস্ট(১৯৯০) বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ১৫ আগস্ট বয়কট করার ঘোষণা করেছিল, ঘরে ঘরে সেদিন ভাগওয়া ঝান্ডা তোলার কথা বলেছিল, শঙ্খ বাজানোর কথাও বলেছিল, সব মিলিয়ে প্রবল হিন্দুত্ববাদের আবহ। এরই মধ্যে দেবিলালকে, মন্ত্রী সভা থেকে বরখাস্ত করেছেন ভিপি সিং, দেবীলাল বিরাট কৃষক সমাবেশ ডেকেছেন দিল্লিতে ৯ আগস্ট, তার আগেই ৭ আগস্ট ভি পি সিং আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের জন্য ২৭% রিজার্ভেশনের কথা ঘোষণা করে দিলেন।
উচ্চবর্নের হিন্দুরা এর বিরোধিতা করল, ওবিসি, দলিত, পিছড়ে বর্গ সমর্থন করলো।
বাধা পেলো বিজেপির সমগ্র হিন্দুদের রামের নামে জাগিয়ে তোলার আড়ালে নিজেদের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা পূরনের কাজ।ভিপি সিং, নিজে হেরেছিলেন কিন্তু বিজেপিকেও রুখেছিলেন ক্ষমতায় আসতে বিজেপিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আর ও এক দশক আর এই সময় থেকেই ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রবলভাবে উন্মোচিত হয়েছিল।আর ভি পি সিংহের এই ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের পাশে সেদিন দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র নেতৃত্বে বামেরাই।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে ৯০র দশকে পাঞ্জাবের আকালি দল শিবসেনা ছাড়া আর কোনও দলই বিজেপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়নি কিন্ত ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটবার পরেও কংগ্রেস ভেঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ওই ৯০র দশকেই বিজেপির হাত ধরে তাদের জোট সঙ্গী হয়।
সারা দেশ জুড়ে করসেবার নামে বিজেপি উগ্রহিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার আবহ তৈরী প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তা এই বাংলাতে প্রতিহত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার ।বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কমরেড জ্যোতিবসু বিজেপি কে প্রকাশ্য অসভ্য বর্বরের দল বলেছিলেন ।দেশজুড়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস কে কেন্দ্র করে দাঙ্গা হলেও বাংলায় আগুন জ্বলেনি এ আগুন জ্বলে উঠবার আগেই তা নিভিয়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার আর বাম কর্মীরা।
অতীতে এবং আজও কমিউনিস্টরা ভারতে এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে উর্ধ্বে তোলার কাজে সবচেয়ে দৃঢ়। 
১৯২০সালে সিপিআই গঠনের পরপরই ১৯২০-র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির তরফে এম এন রায় লিখেছিলেন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের একমাত্র প্রতিষেধক হল সমস্ত জাত-সম্প্রদায়ের শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি ঐক্য। গোটা শতাব্দীজুড়েই কমিউনিস্টদের কাজের মূল জোরই হল মেহনতীর ঐক্য শক্তিশালী করা। 
১৯২০-তে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রত্যেক বার্ষিক অধিবেশনে সিপিআই জাতীয় আন্দোলনের কর্মসূচি কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে ইশ্‌তেহার পেশ করেছে ( ১৯২১-এ আমেদাবাদ, ১৯২২-এ গয়া, প্রভৃতি)। 
১৯২৬-এ গুয়াহাটি অধিবেশনে পেশ করা ইশ্‌তেহার সুনির্দিষ্টভাবে দেশের ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সংঘাত সম্পর্কে আলোচনা করেছিল। শ্রমজীবীদের ঐক্য শক্তিশালী করার জন্য কংগ্রেস অধিবেশনকে আহ্বান জানিয়ে ইশ্‌তেহারে বলা হয়েছিল: 
‘‘গত কয়েক বছর দেশে যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত চলছে তাতে অনেকে নিশ্চয়ই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। সত্যই তা হতাশাজনক ঘটনা। কিন্তু এখানে জনগণের পার্টি সমাধান খুঁজে পাবে। উচ্চবিত্ত শ্রেণি অধিকার ও সুযোগসুবিধার জন্য লড়াই করছে, তখন উভয় সম্প্রদায়ের জনগণের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিন্নতা রয়েছে। তা হল শোষণ। হিন্দু ও মুসলিম শ্রমিকরা একই কারখানায় ঘাম ঝরায়। হিন্দু ও মুসলিম কৃষক পাশাপাশি জমিতে শ্রম দেয়, জমিদার, মহাজন, সাম্রাজ্যবাদের এজন্টরা তা চুরি করে। মুসলিম মালিক মুসলিম শ্রমিককে বেশি নজুরি দেয় না। হিন্দু জমিদার মুসলিম কৃষকের তুলনায় হিন্দু কৃষকের কাছ থেকে কম খাজনা নেয় না। 
‘‘শোষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিগুলির ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই নিয়ম খাটে ( ছোট বুদ্ধিবৃত্তির মানুষ, ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর প্রমুখ)। শোষণের বন্ধনে আবদ্ধ ৯৮ শতাংশ মানুষের সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। তাঁদের অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে তাঁদের সাহায্য করুন, অভিন্ন শত্রু শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহসী নেতৃত্ব দিন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাধানোর প্ররোচনামূলক নীতির ভিত্তিই ধসে যাবে। এটা ঠিক যে রাতারাতি তা করা যাবে না। কিন্তু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জীবনীশক্তি ক্ষয় করা সাম্প্রদায়িকতার দুষ্টক্ষতের মোকাবিলার অন্য কোনো উপায় নেই।’’
ধর্মনিরপেক্ষতা
কমিউনিস্টদের নীতিগত অবস্থান হল: ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করা। এর অর্থ হলো রাষ্ট্র ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস বেছে নেবার অধিকারকে দৃঢ়ভাবে সুরক্ষা দেবে কিন্তু রাষ্ট্র কোনো একটি ধর্মের প্রচার করবে না, অগ্রাধিকার দেবে না। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে সব ধর্মের সমতা। এর মধ্যে সংখ্যাগুরুর ধর্মের প্রতি পক্ষপাত অন্তর্নিহিত রয়ে গেছে। বস্তুত এর ফলে আজকের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলির প্রচারে জ্বালানি যোগাড় হয়। 
সুতরাং কমিউনিস্টদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র রক্ষা শুধুমাত্র ভারতের সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় সংবিধানকে রক্ষার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের অধিকার ও সমতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তাকে বাস্তবায়নের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এসবই গণতন্ত্রের মর্মবস্তু। কিন্তু এই সঙ্গেই সবচেয়ে শোষিত শ্রেণিগুলির শ্রেণি ঐক্য জোরদার করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে যা জরুরী। সাম্প্রদায়িকতা এই ঐক্যকেই বিপর্যস্ত করে।
দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখবার ক্ষেত্রে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কস বাদীর)দায়বদ্ধতা কতখানি আর বিজেপিকে কেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় চরিত্রের পক্ষে সবথেকে বড় বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তা বোঝার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)র ২০০০-সালের পার্টি কর্মসূচির দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে।যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে আরএসএস এবং বিজেপি-র তরফে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘‘সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ত ধাঁচের আরএসএস পরিচালিত জোটের শক্তিবৃদ্ধি ও কেন্দ্রে তাদের ক্ষমতাদখলের ফলে ধর্মনিপেক্ষতার ভিত্তির বিপদ গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যমের সাম্প্রদায়িকীকরণের পরিকল্পিত প্রয়াস চলছে।’’ (প্যারা ৫.৭)
পার্টির কর্তব্য হিসাবে কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল: ‘‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ওপরে ভর করে যে ফ্যাসিস্ত প্রবণতা বিস্তারলাভ করছে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সর্বস্তরে দডঢ়তার সঙ্গে লড়াই চালাতে হবে।’’ (প্যারা ৫.৮)
বিজেপি সরকারে থাকলে ভারতের সাংবিধানিক ব্যবস্থার কী গুরুতর বিপদ হতে পারে, তার উল্লেখ করে বলা হয়েছিল: ‘‘বিভেদকামী ও সাম্প্রদায়িক মঞ্চের ভারতীয় জনতা পার্টি একটি প্রতিক্রিয়াশীল দল। তাদের প্রতিক্রিয়াশীল মর্মবস্তুর ভিত্তি হল অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদী জাত্যভিমান। বিজেপি কোনো সাধারণ বুর্জোয়া দল নয়, কেননা ফ্যাসিস্ত ধাঁচের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক শঙ্গ তাদের পরিচালনা করে, আধিপত্য করে। বিজেপি ক্ষমতায় আসায় রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সংস্থায় প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে আরএসএস। হিন্দুত্ব মতাদর্শ পুনরুত্থানবাদকে মদত দেয়, হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারতের মিশ্র সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে।’’ (প্যারা ৭.১৪)
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৭২বছর আগে কমিউনিস্ট পার্টির সূচনালগ্নেই পার্টি সাম্প্রদায়িকতাকে ভারতবর্ষের জনগননের অন্যতম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আর এই সাম্প্রদায়িক হানাহানি ২০র দশক থেকে তো হয়ে এসেছে বিজেপি তথা সংঘপরিবারের প্রতিষ্ঠাতাদের মদতেই।কাজেই সিপিআই এমের বিজেপির বিরুদ্ধেও মনোভাব(বিজেপি আদপে একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন)বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে তৈরি হয়নি জন্মলগ্ন থেকেই তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরোধী।