দ্বিতীয় পর্বে শেষ করেছিলাম দেশের আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি মাননীয়া দ্রৌপদী মুর্মু কি পারবেন দেওচা পাঁচামী কয়লাখনি খোলা মুখ প্রকল্পে আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, বনাঞ্চলের অধিকার – রক্ষা করতে? পূর্বসুরী রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিত্ব। তিনি কি পেরেছিলেন দলিতদের উপর আক্রমণ, জমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করতে? না, পারেন নি। মাননীয়া দ্রৌপদী মুর্মুও পারবেন না। মাননীয়া মুর্মুর ব্যক্তিজীবন খুবই মর্মান্তিক এবং কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে প্রবেশ এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে উত্থান। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের ৪০০০ আদিবাসী পরিবারকে যখন শিল্প গড়ার নামে হঠানো হয়েছিল, কিংবা তাঁদের নিরস্ত্র অহিংস প্রতিবাদ আন্দোলনের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে ওড়িশা পুলিশ নিরীহ ১৪ জন আদিবাসীকে মেরে ফেলল, তখন তিনি তাঁদের রক্ষা করতে পারেন নি। পারেননি, আদিবাসীদের দাবী বা স্বার্থ রক্ষা করতেও।
দেওচা-পাঁচামী কয়লা খনির খোলামুখে আদিবাসীরা যে বিপদের সম্মুখীন, মাননীয়া রাষ্ট্রপতি তা থেকে রক্ষা করতে পারবেন না। আসলে, যে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি রাজনীতি করেন, মোদি ও অমিত শাহও একই পথের পথিক। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর শ্রেণিস্বার্থকে বাদ দিয়ে আদিবাসী সমাজের স্বার্থরক্ষা করবেন, এটা ভাবাও বাতুলতা। আসলে মোদী-অমিত শাহ দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করে পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতিকে উষ্কে দিয়ে আদিবাসীদের আবেগকে, দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। আদিবাসী রাষ্ট্রপ্রধান হলেই যে সেই সমাজের স্বার্থরক্ষা হবে, চূড়ান্ত মানোন্নয়ন ঘটবে এমন কথা ইতিহাস সমর্থন করে না। শ্রেণি আন্দোলন ব্যতিরেকে পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি কোনদিনই অগ্রসর হতে পারে না। আসল কথা হল, আদিবাসীদের জমি, মজুরি ও বনাঞ্চলের অধিকার রক্ষা করা। মোদী-শাহ, দ্রৌপদী মুর্মুকে তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করে হাজার হাজার আদিবাসীদের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনতে চেয়েছেন।
আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ব্যতিক্রম নন। কারণ, তিনিও বলেছেন যে, দ্রৌপদী মুর্মু প্রার্থী হবেন একথা বিজেপি আগে জানালে, আমিও তাঁকে সমর্থনের কথা ভেবে দেখতাম। এঁরা সহায় আছেন বলেই তো আর.এস.এস-এর নামাঙ্কিত ‘দুর্গা’, দেওচা-পাঁচামি খনি প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিতে পেরেছেন।


বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, নিউজপোর্টাল, সরকারি সূত্রে যা জানা যাচ্ছে, তা হল, বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের ৩৪০০ একর এলাকা নিয়ে এই কয়লা ব্লক চিহ্নিত হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১৯টি গ্রামের ৪৩০০টি পরিবারের ২১০০০ এর বেশী মানুষ বাস্তুচ্যুত হবেন। ৫৩টি জনপদের ৭০,০০০ মানুষের জীবন-জীবিকায় এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। খনি প্রকল্পের জন্য যেগুলি স্বাভাবিক প্রয়োজন তা হল, ওভার বার্ডেন ডাম্পিং ইয়ার্ড, বাফার জোন ও পুনর্বাসনের জন্য জমি। সব মিলিয়ে প্রায় ১১,২২৩ একর জমি লাগবে। এর মধ্যে সরকারি জমি আছে ২০০০ একর। প্রায় ৯০০০ একর জমি সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হবে। তার মধ্যে আছে বনাঞ্চল, যা কিনা আদিবাসীদের অন্যতম জীবিকাস্থল। এই জমির বড়ো অংশ আদিবাসীদের। বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, জোর পূর্বক জমি নেওয়া হবে না।
২০১৯-এর ডিসেম্বরে দেওচা-পাঁচামির কয়লা প্রকল্পের উদ্বোধন হবার কথা ছিল রাজ্যের মুখ্যসচিবের উপস্থিতিতে। উদ্বোধন কর্মসূচী কী কারণে বাতিল হয়ে গেল, তা কি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলবেন? উনি বলবেন না। তাই আমাদের তথা জনগণের উপলব্ধির কথাই বলছি যে, সেই সময়ে আদিবাসী সমাজের হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিবাদ ও প্রবল বিক্ষোভ। তাঁর আন্দোলনের চাপের ফলে উদ্বোধন বন্ধ করে দিতে হয়। বড়ো বড়ো সংবাদ মাধ্যম কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেনি কোনো এক অবোধ্য কারণে। ঐ এলাকায় এখন বলা যায় একপ্রকার অঘোষিত কার্ফু জারি রয়েছে। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে বিশিষ্ট জনের একটি দল ঐ এলাকায় মানুষদের বোঝানের জন্য গেছেন এবং তাঁরা কাজও করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা কারা এবং তাঁরা কী কাজ করছেন? প্রকৃত ঘটনা হল, ওখানে বাইকবাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ, সমাজবিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ – যাঁরা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তাদেরকে ওখানে যেতে দেওয়া হচ্ছেনা। ইতিমধ্যে মিথ্যে মামলা দেওয়া শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ধরণের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। এমনকি, ইউ.এ.পি.এ. (রাষ্ট্রদ্রোহ আইন) এর ভয় দেখানো হচ্ছে। এককথায় বলা যায়, ধমকানো, চমকানো রীতিমতো ভাবে চলছে। নবান্ন থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘শ্রেষ্ঠতম প্যাকেজ’। রাজ্য সরকার-এর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন পাওয়া মিডিয়াগুলি উন্নয়নের পক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি বদান্যতা দেখানোর জন্য আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে। এই উন্নয়ন কাদের স্বার্থ রক্ষা করবে?


আদিবাসীদের বাস্ত, জমি, জীবিকা, পরিবেশ ও বনাঞ্চল রক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিশিষ্ট জনেরা দেওচা পাঁচামি কয়লা খনি বন্ধের ডাক দিয়েছেন। “বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চ” নামে একটি সংগঠন এই বিষয়ে আন্দোলনে নেমেছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্থানীয় কয়েকটি নিউজ পোর্টালে, প্রকল্প এলাকায় বাস্তবে কী ঘটছে, তারা তা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। প্রকল্প অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে আদিবাসীভূক্ত গ্রামগুলি সমন্বয় রেখে মরণ-বাঁচন লড়াইয়ে নেমেছেন। আওয়াজ উঠেছে, দেওচা-পাঁচামি কয়লাখনি বন্ধ হোক’, ‘কোনো গ্রামবাসীকে উচ্ছেদ করা চলবে না”। এই আর্ত চিৎকার তথা দাবী কি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শুনতে পাচ্ছেন? শোনার একটু চেষ্টাতো করুন। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে যেসমস্ত প্রতিশ্রুতি আপনি দিয়েছেন, তা কি আপনি রক্ষা করতে পারবেন?


শেষ পর্বে রাজ্য সরকারের ‘শ্রেষ্ঠতম প্যাকেজ’ কী, এবং এই প্রকল্পের ক্ষতিকারক দিকগুলি বিশেষজ্ঞদের মতামতসহ তুলে ধরার চেষ্টা করব। তথ্য সংগৃহীত -12/10/2022