দেওচা-পাঁচামি খোলামুখের কয়লাখনির রাজ্য সরকারের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য শ্রেষ্ঠতম প্যাকেজ ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি — গত ৩১।০১।২২ তারিখে নবান্নে  মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত হয়েছে তা হলো, জমিদাতাদের পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়া হবে । 

 সেই লক্ষ্যপূরণে ৫১০০ নতুন পদ তৈরিতে মন্ত্রীসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী এও জানিয়েছেন, যাঁরা জমি দেবেন, তাদের পরিবারের একজনকে সিনিয়ার বা জুনিয়র কনস্টেবল পদে নিয়োগ করবে সরকার।*জমির বদলে জমিসহ পাট্টা ও ক্ষতিপুরণ পাবেন। সব আদিবাসীদের জন্য ঘর করে দেবে সরকার।*বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, জমির জন্য বিঘা প্রতি ১০- ১৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপুরণ দেওয়া হবে।* স্থানান্তরকরণের জন্য ৫ লক্ষ টাকা পাবেন প্রত্যেক পরিবার। *কলোণিতে পাবেন ৬০০ বর্গফুটের বাড়ি।* মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, প্রায় তিন হাজার জন ক্র্যাশার লেবার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পাবেন।* ঐ এলাকায় ১৬০ জন কৃষি শ্রমিক ৫০ হাজার টাকা করে পাবেন।*৫০০ দিনের জন্য রেগার কাজ পাবেন।** ২৮৫ জন ক্র্যাশার মালিক তাঁদের জমি-বাড়ির দাম এবং ৫০ হাজার টাকা শিফ্টিং অ্যালাউন্স পাবেন এবং ছয় মাস ধরে ১০ ট্রাক ব্যাসল্ট বিনামূল্যে পাবেন।*চাঁদা মৌজায় ব্যাসল্ট শিল্প উদ্যানের পুনর্গঠন হবে। ২৭ জন খাদান মালিক জমি ও বাড়ির দাম পাবেন।২০২১ এর নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ ঐ খনি প্রকল্প বিষয়ে সিউড়ির রবীন্দ্র সদনে জমি মালিক ও আদিবাসী সংগঠনগুলির সাথে বৈঠক হয় জেলা প্রশাসনের উচ্চস্তরে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেলা শাসক বিধান রায়, জেলা পুলিশ সুপার নগেন্দ্র ত্রিপাঠী, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী প্রমুখ। এই বৈঠক থেকেই পুনর্বাসন প্যাকেজের শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। বৈঠক শেষে বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, “অধিগ্রহণ নয়, সরকারি নিয়মে জমি কেনা হবে। আজ শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হল তিনটি ভাষায়। জমি মালিকদের বুঝিয়ে আলোচনা করে তবেই জমি নেওয়া হবে।যে পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা খুবই ভালো।”  আদিবাসী নেতৃত্বরা বলে দেন, তাঁরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন জমি দেওয়া হবে কি না।এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, আদিবাসী নেতৃত্ব সরকারকে কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। আগের লেখাগুলিতে বেসরকারী সুত্রে কয়লা খনির এলাকা, বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যার তথ্য দিয়েছিলাম। আজকে জানাই সরকারি তথ্য ও হিসাব :- **দেওচা-পাঁচামি হল বীরভূমের মহম্মদবাজার হরিণসিং কোল ব্লক। দেওচা-পাঁচামি তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতকে নিয়ে গঠিত। হিংলো, ভাঁড়কাটা ও দেউচা গ্রাম পঞ্চায়েত। হিংলো জিপিতে ২১টি গ্রাম, ভাঁড়কাটা জিপিতে ৩৪টি এবং দেওচা জিপিতে ২৮টি গ্রাম আছে। মোট ৮৩টির মধ্যে দেওয়ানগঞ্জ ও হরিণসিং এলাকা থেকেই কয়লা উত্তোলন শুরু হবে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এই এলাকায় আপাতত ১২টি গ্রামকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ৪৩১৪টি বাড়িতে ২১ হাজারের বেশী মানুষ বসবাস করেন। তার মধ্যে ৩৬০০ জন তফশিলি জাতিভুক্ত এবং ৯০৩৪ জন তফশিলি উপজাতিভুক্ত। এই প্রকল্পে রাজ্য সরকার ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা পুনর্বাসন প্যাকেজে খরচ হবে। সরকারী ঘোষণা যা তা হল :-সরকারের নিজস্ব জমি (খাস) এক হাজার একর। এই জমি দেওয়ানগঞ্জ এলাকায়। প্রথম পর্যায়ে এখান থেকে কাজ শুরু হবে।


ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে নানান জটিলতা দেখা দিয়েছে।
o রাজ্য সরকার এখনও জমি অধিগ্রহণ শুরু করতে পারেনি। জমি অধিগ্রহণ কেন রাজ্য সরকার এখনও শুরু করেনি, এবিষয়ে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ কোন্ রহস্যজনক কারণে উষ্মা প্রকাশ করেছেন? * সরকারি প্যাকেজ নিয়ে এলাকার আদিবাসীরা সন্তুষ্ট নন। জমি বাড়ি ছেড়ে দেবার পর তাঁরা আদৌ বাড়ি জমি সরকারিভাবে পাবে কিনা সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত নয় ।তার জন্য তাঁরা জমি রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন ।প্রশ্ন উঠেছে প্যাকেজে যা ঘোষণা করা হয়েছে, তা কি আদৌ কার্যকরী করা হবে? নানান সংশয়—আশঙ্কা নিয়ে ঐ এলাকার মানুষজন আছেন। ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়’। অতীতে যে সমস্ত প্রকল্প হয়েছে, সেখানে যে প্যাকেজ ছিল, তা কোনটারই পূর্ণাঙ্গ রূপায়ন হয়নি। যেমন — **সর্দার সরোবর বাঁধ, স্ট্যাচু অব ইউনিটি নির্মাণে, নর্মদা বাঁধ, ডিভিসি বাঁধ ইত্যাদি প্রায়  সবই কয়েক শত করে আদিবাসী এবং তাঁদের পরিবার ও অন্যান্যদের উৎখাত করা এবং তাদের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ কিছুই তাঁরা পাননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে। ইতিমধ্যেই রাজ্যে বসবাসকারী আদিবাসীদের জীবন-যন্ত্রণার ছবি এবং এদের প্রতি রাজ্য সরকারের বঞ্চনা সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে মা-মাটি-মানুষের সরকারের মধ্যমণি মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় পোস্টম্যাট্রিক স্কলারশিপ তিন বছরে কমেছে ৪৯ হাজার। শিক্ষাশ্রীতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। রেগায় কাজ পেয়েছেন ১০ শতাংশ আদিবাসী।

বনাঞ্চলে গত পাঁচ বছর পাট্টা দেওয়া বন্ধ আছে। আদিবাসী হোস্টেলগুলির দুর্দশা ভয়ঙ্কর। বেশীর ভাগ হোস্টেলই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।  *আদিবাসীদের শিক্ষা, কাজ, জমি ,স্বাস্থ্য, মাথার উপর ছাদ — –এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের  বঞ্চনা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা বিষয়গুলি ঐ এলাকার আদিবাসীদের ভাবাচ্ছে। যার জন্যই তারা এখনও কোনো মতামত দেননি কয়লাখনি প্রকল্পে জমি দেবার প্রশ্নে।আর একটি প্রশ্নও প্রকল্প এলাকায় উঠেছে এবং রাজনীতিকদের মধ্যেও আলোচিত হচ্ছে, তা হল এবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিল্প সম্মেলন হল। শিল্পপতিরা ৩,৪২,৩৭৫ কোটি টাকার মৌ স্বাক্ষর করলেও সেখানে কিন্তু এই খনি প্রকল্পের নাম উচ্চরণ করা হয়নি। অথচ, মুখ্যমন্ত্রী নবান্ন ও বিধানসভাতে ঘোষণা করেছেন, “রাজ্যে শিল্পতালুক হতে চলেছে দেওচা-পাঁচামি খনি প্রকল্প। তাঁর ঘোষণা, প্রতিশ্রুতি ও প্রকাশিত শ্বেতপত্রের মধ্যে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া এই শিল্পতালুকে কর্মসংস্থান কত হবে তাও নিশ্চিত করে রাজ্য সরকার বলছে না। *বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ দের অভিমত*:- কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।গণশুনানী না করেই প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে এবং প্রকল্পের কাজ চলছে। **খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্পে পরিবেশ দুষণের ব্যাপকতা বেশি হবে, ফলে বাস্তুতন্ত্র আঘাতপ্রাপ্ত হবে। কয়লা  উত্তোলন কোন শিল্প নয়, বরং এটি যন্ত্রনির্ভর কাজ। স্থানীয় বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে। প্রকল্পের এখনো পর্যন্ত কোনো টেকনোলজি পার্টনার নেই। এই প্রকল্প বাস্তবে রূপ দিতে গেলে যে ধরণের প্রযুক্তিগত দক্ষতা দরকার, তা আমাদের দেশে নেই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো সংস্থার সাথে এখনও রাজ্য সরকার যোগাযোগ করেনি।


** দেওচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পের খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর পরিবেশ দূষণে মারাত্মক প্রভাব পড়বে – এই বলে ইংল্যাণ্ড ও জার্মানি ভারতে তাদের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত-এর মাধ্যমে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে।* প্রকল্পটি আদৌ লাভজনক নয়।* বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী বলেছেন, ‘কয়লা ব্লক থেকে প্রচুর কার্বন নির্গত হয়, যা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক তো বটেই, পাশাপাশি গোটা পরিবেশের পক্ষেও ক্ষতিকর। প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট করে এই প্রকল্প না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সমস্ত দিক খতিয়ে দেখা দরকার।’
**পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, ‘দেওচা-পাঁচামিতে যে কয়লা খনি হচ্ছে, তা খোলামুখ খনি। তাই এলাকায় ব্যাপক দূষণ হবে। এছাড়াও এলাকায় এই কয়লা নিতে হাজার হাজার ট্রাক আসবে। প্রতিদিন যা ধুলো ওড়াবে, সেটাতেও দূষণ বাড়বে। সবথেকে মারাত্মক হল ঐ এলাকায় প্রচুর গাছ কাটা পড়বে।সবটাই খেয়াল রাখা দরকার।যে সরকার রাজ্যের সরকারী কর্মীদের বেতন, ডি.এ, পেনশন, অন্যান্য বরাদ্দ, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে পারে না, সেই সরকার  মাথার উপর ৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশী খরচ করে খনি– শিল্পতালুক ঘোষণা করে দেয়, সেটা আদৌ যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত কিনা তাও যেমন ভাবা দরকার, আবার এক বা দু জন ব্যক্তির খামখেয়ালিপনার উপরও ছেড়ে দেওয়া যায় না। জমিই অধিগ্রহণ হল না, বিশেষজ্ঞোর কোনো মতামতের ধার ধারল না, অথচ প্রকল্প এলাকায় প্রোজেক্ট অফিস তৈরীর কাজ শুরু করে দেওয়া হল। বীরভূমের সিউড়ির আবদারপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে কোল ব্লকের প্রোজেক্ট অফিস।প্রকল্পটি কি আদৌ বিজ্ঞানসম্মত, লাভজনক, মুখ্যমন্ত্রী আদৌ কি ঘোষিত প্যাকেজ কার্যকরী করবার ব্যাপারে আন্তরিক? আদিবাসীসহ এলাকার মানুষ কিন্তু এ বিষয়ে সংশয়ান্বিত। তাই তাঁরা এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তীব্র করবার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। তাঁরা কি তাদের ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দেবেন? সময় ও ভবিষ্যৎ পরিবেশ পরিস্থিতিই বলবে প্রকল্পের দিশা কোন দিকে যাবে।

তথ্য সংগৃহীত