আমাদের দেশ যার নাম ভারত না ইন্ডিয়া তা নিয়ে শোরগোল লেগেছে তার ৭৫তম সাধারণতন্ত্র দিবস পার হল। দেশের সংবিধান রচনায় এটি একটি মাইলফলক। সেই সংবিধানে শুরুর বাক্য “ইন্ডিয়া যা ভারত” । তাই শোরগোলটা মেকি এবং বানানো। আমাদের দেশ ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল, তা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। সেই উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আধুনিক স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই পথে চলবার জন্যই এই সংবিধান রচনা করা হয়েছিল।আমাদের সংবিধানে সব রাজ্যের ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষাকেও রাখা হয়েছিল দেশের ভাষা হিসেবে। বিভিন্ন ভাষাভাষীর দেশে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন ইংরেজি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিল। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ অংশের সাথে উত্তর এবং পুর্ব ভারতের যোগাযোগের মাধ্যম ইংরেজি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে বি আর আম্বেদকর ইন্ডিয়া যা ভারত বিভিন্ন রাজ্যের ঐক্যবদ্ধ দেশ বলে সংবিধানের প্রথম ধারায় সংশোধনী যোগ করেন।বহু আলোচনা এবং তর্কের পর স্বাধীন দেশের নাম দ্বিভাষায় লেখা হয় শুধুমাত্র আধুনিক ভারত গড়ার লক্ষ্যে। এই আধুনিক ভারত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল ঐতিহাসিক ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার অবসানের পরে।
স্বাধীন ভারত, ইন্ডিয়া আর ভারতবর্ষের মধ্যে ফারাক আছে। দেশের অন্য একটি নাম নিয়েও সেদিন আলোচনা হয়েছিল। তা হল হিন্দুস্তান। কবি ইকবালের “সারে যাহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা” এই গানের মধ্যেও হিন্দুস্তান কথাটি রয়েছে। কিন্তু স্বাধীন ভারতের সংবিধান আলোচনার সময়ে আলোচনা করেই হিন্দুস্তান শব্দটি বাতিল করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ স্থলভাগ ছিল স্বাধীনতার আগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নিয়ে স্থলভাগ। তাই ভারত আর ভারতবর্ষের মধ্যে পার্থক্য আছে। দেশের নামকে হিন্দুস্তান বলতে নারাজ ছিলেন এক বড় অংশের মানুষ কারণ দেশে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষজন, ওদিকে হিন্দুস্তান বলতে শুধুমাত্র হিন্দুদের বোঝায়। বাতিল হয়েছিল সেদিন, কিন্তু আজ ২০২৩-২৪ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ হিন্দুদের দেশ হিসেবে ভারতকে প্রতিপন্ন করতে চাইছে। কেন সেদিন ইন্ডিয়া যা ভারত-এমন শব্দকে স্বাধীন দেশের নাম হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল। এমন কেন ভাবা হয়েছিল যে এই দেশ বিভিন্ন রাজ্যের ঐক্যবদ্ধ স্থলভাগ বা union of states? তার কারণ স্পষ্ট করা আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে। জন গণ মন সঙ্গীতের দ্বিতীয় স্তবকে কবি লিখেছেন
“ অহরহ তব আহবান প্রচারিত
শুনি তব উদার বাণী
হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃষ্টানী
পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন পাশে
প্রেমহার হয় গাঁথা
জনগণ ঐক্য বিধায়ক জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা “
এই ঐক্যই স্বাধীনোত্তর দেশের মূল ভিত্তি। আর এই ঐক্য বোঝানোর জন্যই দ্বিভাষায় দেশের নাম। শোনা যায় যে অন্য কয়েকটি মুক্তিপ্রাপ্ত উপনিবেশের স্বাধীন দেশে রূপান্তরের সময়েও এই ভাবে নামকরণ হয়েছিল।

স্বাধীন দেশের সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনীতে দেশকে “সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র” থেকে “ সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র” হিসেবে বলা হল। এছাড়া ইন্ডিয়া যা ভারত বিভিন্ন রাজ্যের ঐক্য বলে বর্ণনায় বলা হল বিভিন্ন রাজ্যের “ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড স্থলভাগ” । এই সংশোধনী আধুনিক দেশ গড়ার স্বপ্ন। সেই দেশের নাম থেকে এই সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আর এস এস চালিত বিজেপির মোদী সরকার দেশকে অতীত ভারতবর্ষ, হিন্দুস্তানে ফেরাতে চায়। সেই অতীতে ছিল রাজতন্ত্র। পৌরাণিক কালের গল্পে ছিল অমৃতমন্থনের কথা।সেই স্থলভাগের পরিধি এবং মানচিত্রের সাথে আধুনিক ইন্ডিয়ার বা ভারতের একেবারেই মিল নেই। সেই পৌরাণিক গল্পকথার ভিত্তিতে দেশের ৭৫তম স্বাধীনতার বছরে দেশে মানুষের অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের ভোটে জিতে আসা রাজনৈতিক দল সংসদে দাঁড়িয়ে ‘অমৃতকাল’ এসে গেছে বলে ঘোষণা করেছিল।বিশ্বের কোন দেশ আধুনিক সময়কে পৌরাণিক কথকতা দিয়ে বর্ণনা করে না।এখানে তাই হল।
এইভাবে শুরু দেশের মানুষকে পিছনে ফেরানোর প্রক্রিয়া যেখানে ছিল রাজতন্ত্র। ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই সময়ে যখন দেশের শাসকের সাথে দেশের মানুষের সম্পর্ক রাজা আর প্রজার মত। লোপ পেতে চলেছে সাধারণতন্ত্র! এ কি সম্ভব? তাই তো প্রশ্ন- এ কি ভাবে সম্ভব? সারা পৃথিবী থেকে উপনিবেশ উঠে গেছে এবং তারও আগে উঠে গেছে রাজতন্ত্র। গত ২২শে জানুয়ারি অর্থাৎ অতীতে স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার দিনেই স্বাধীন আধুনিক দেশ যা চন্দ্রযান পাঠানোর গর্ব করে সেই দেশকে অতীতের রাজতন্ত্রে প্রায় নিয়ে যাওয়া হল। সাধারণতন্ত্রে মানুষের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী , হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, পারসি, শিখ সমস্ত ধর্ম, জাত পাতের মানুষকে নিয়ে, বিভিন্ন ভাষাবাষী মানুষের যে ঐক্যবদ্ধ , অখণ্ড দেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে গরুপালন করে, ব্রতকথা পাঠ করে নিজেকে দেশের হিন্দু রাজা, রাজরাজেশ্বর বলে দেশের মানুষের সামনে নিজেকে হাজির করলেন। যখন রামমন্দির উদ্বোধন করলেন ১৯৯২ সালের পুরনো ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পড় আইনসভার রায়ের মাধ্যমে, যখন অর্ধনির্মিত সেই মন্দিরে পুরোপুরি হিন্দু রাজবেশে হাজির হয়ে উদ্বোধন করলেন ভারতের সাধারণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী, সেদিন মুখ পুড়ল দেশের সাংবিধানিক ভিত্তির, সেদিন মুখ পুড়ল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের যা আধুনিক সার্বভৌম দেশ হিসেবে ভারতকে দেখতে চেয়েছিল। আধুনিক সে দেশের নাম একাধারে ভারত ছিল , একাধারে ছিল ইন্ডিয়া। বিশ্বের দরবারে ইন্ডিয়া নামে খ্যাত ছিল সেই আধুনিক দেশ।

রাজা তো ঈশ্বর; তাই সব প্রজারা প্রভুরূপে বরণ করবেন তাঁকে। রাজার চেহারা বড় করে থাকে। তাই অযোধ্যার পথে পথে মোদীর কাট-আউট আর রামলালার কাট-আউট। গল্পে আছে রাম ছিলেন আযোধ্যার রাজা। সেই রাজার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পারেন এখনকার রাজা! এই রচিত গল্প কিভাবে শোনাবে আধুনিক দেশের মানুষকে? একমাত্র উপায় হল ধর্মের সুড়সুড়ি এবং তার সাথে ফ্যাসিস্টধর্মী একনায়কতন্ত্র। রাজা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনিই রাজত্ব করবেন। রাজা প্রতিষ্ঠিত কিভাবে হবেন? রাজত্ব তো যুদ্ধ জয়ের উপর নির্ভর। তাই গল্পের রাম চরিত্রকে, পৌরাণিক রাম চরিত্রকে ভর করে, ভরতের পাদুকার মত গল্পের রাজা চলে এলেন-তিনি সাধারণতন্ত্রের ভোটে জেতা প্রধানমন্ত্রী!মুহূর্তে সাধারণতন্ত্র, গণতন্ত্র বদল করার চেষ্টা হল ধর্মতন্ত্র, রাজতন্ত্রে। আধুনিক দেশ কি এমনটাই চেয়েছিল?

কোনদিন চায় নি দেশ এরকম ঈশ্বর ভাবের রাজতন্ত্র এবং মহাকাব্য রামায়ণের প্রাণ প্রতিষ্ঠা। দেশের অনেক মানুষকে এরকম চাওয়ান হল। কথায় বলে ভয় পেলে ভীত মানুষ রামনাম জপে। তাই মানুষকে ভয় দেখানো শুরু হয়েছে আর এস এস চালিত মোদী আমলে। একটার পড় একটা ঘোষণায় শুধু মানুষকে ভয় দেখিয়েছে, ব্যতিব্যস্ত করেছে এই সরকার। মনে করে দেখুন নোটবন্দীর দিনগুলি।কি লাভ হয়েছে, কাড় লাভ হয়েছে নোটবন্দীতে? কেউ জানে না। আজও জানে না। সরকার যা যা কারণ বলেছিল, তা একটাও খাটে নি। তারপর চলে এল পণ্য-পরিষেবা কর। মানুষের হেনস্থা বাড়ল। তারপর চলে এল পেট্রল-ডিজেলের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি।বেকারত্ব ছুঁল সর্বকালীন রেকর্ড। অনাহার বাড়ল। বাড়ল মাটিতে মিশিয়ে যাওয়া মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা। কিন্তু কোনভাবেই সরকার বিরোধী কথা, ভাষ্য থাকা চলবে না। মানুষকে ভয় দেখানো হল যখন একের পর এক মানুষ যারা সরকারকে প্রশ্ন করছেন, লিখছেন, বলছেন তাঁদের জেলবন্দী করা হল।কে কি খাবে তা নিয়ে ফতোয়া জারি করা হল। দেশের সংসদ থেকে সব বিরোধীদের বহিষ্কার করে দেওয়া হল। এই ভাবে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে তাঁকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। স্বাভাবিক ভাবেই জীবন জীবিকা সামাল দিতে বিপর্যস্ত দেশের বেশির ভাগ মানুষ আজ ভীত, সন্ত্রস্ত। মেনে না নিলেও, না মানার ফল কি হবে তা নিয়ে তারা আতঙ্কিত। চাপা আতঙ্কের পরিবেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক নয়া রূপে আবির্ভূত ধর্মীয় আখ্যান- উদ্ধত হিন্দুত্ব। এই হিন্দুত্ব অতীত, সুদূর অতীতের স্থলভাগ, যার সাথে এখনকার দেশের মানচিত্র মেলে না, সেই অতীতের বর্ণাশ্রম মানে, মনুস্মৃতি মানে, রাজতন্ত্র মানে। এই হিন্দুত্ব উচ্চবর্ণের পুরুষালি রাজতন্ত্র। এই রাজত্ব কায়েম হলে চলবে বহুযুগ।
এইভাবে চলে আসছে অমৃতকালের কথা। এইভাবে চলে আসছে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট বৈতরণী পার হওয়ার কথা। তাই শাসকের মুখে আছে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা! এরকম হয় নাকি? সাধারণতন্ত্রের নির্বাচনের নিয়ম ঘুরিয়ে অযোধ্যার রাজার হাত ধরে রাজতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা চলছে।ভোট সামনে বলেই তো অর্ধনির্মিত মন্দিরেই যা করার করতে হবে। রাজার হাতে সময় বড় কম।
ধর্ম তো রাজনীতির সাথে শুরুতেই মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তো ২২ শে জানুয়ারি তেত্রিশ কোটি দেব দেবীর সব মন্দিরকেই রামমন্দির বলে দেওয়া হয়েছে। অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষজন যারা সুদূর অতীত থেকেই ধীরে ধীরে মিলে মিশে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন জেলায় নিজস্ব, সংস্কৃতি, রীতি আচার অনুষ্ঠান, উৎসবের ঐতিহ্য বহন করছে, তার বদলে ২০২৪ সালে নয়া রূপে নয়া ধর্ম, নয়া রাজার প্রতিষ্ঠা হল। কোন অতীত নয়, এই প্রতিষ্ঠা ফ্যাসিস্টধর্মী অবয়বের প্রতিষ্ঠা। এই রাজতন্ত্র ফ্যাসিস্টধর্মীর কথা। এই প্রাণ প্রতিষ্ঠা সাধারণতন্ত্র রাষ্ট্রের গলা টিপে ফ্যাসিস্টধর্মীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা।
এই মেকি গল্প আমাদের দেশের গল্প নয়। এরকম একনায়ক তন্ত্রের দেশ, এক রাজার দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে এখানে। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্ন আজ আক্রান্ত। দেশের জ্ঞানচর্চা আক্রান্ত। দেশে প্রশ্ন তোলা দেশে সত্য বলা আজ আক্রান্ত। আক্রান্ত এত আত্মত্যাগে গঠিত সাধারণতন্ত্র, আমাদের সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক ইন্ডিয়া যা ভারত এই ৭৫ তম বছরে।