আমি কলোনি অঞ্চলের মানুষ। কলোনিগুলি ছিল অলক্ষ্মীর আতুর ঘর। বিধান রায়ের পুলিশের সাথে লড়াই চালিয়ে তৈরী হয়েছে এই অঞ্চলের প্রতিকটা রাস্তা, স্কুল, কলেজ, বাজার। ক্ষুধা ছিল কলোনির মানুষগুলির নিত্যদিনের সঙ্গী। অনিশ্চয়তায় মোড়া জীবনে ঠাকুমা-দিদিমার মুখে সুখ পাখি আর ব্যঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্পই ছিল ছুলেপুলেদের ডিজনিল্যান্ড। দুপুর হলেই বস্তা বিছিয়ে গাছ তলায় শুয়ে তালপাতার পাখা নেড়ে চলত হাড়-হাড়ির গল্প। সমস্ত পাড়াটা যেন একটা পরিবার। প্রকৃত অর্থেই এক পরিবার।


তিতুমিঁয়া করেছিলেন বাঁশের কেল্লা, আর বিধান রায়ের পুলিশের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে কলোনি অঞ্চলের মানুষগুলি হোগলা পাতার বেড়া দিয়ে তৈরী করেছিলেন কলোনির দুর্গ। বিজয়গড়, নেতাজী নগর, নিঃস্ব কলোনি, আজাদগড়ে গড়ে উঠেছিল সেই সব দুর্গগুলি। 
আজকে এই সব অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। স্পেন্সার, রিলায়েন্স এখানে খুলছে তাদের রিটেল শপ্। হুন্ডাই কম্পানির গাড়ির শো-রুম। একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায় সবকটা কোয়াপারেটিভ। সরকারি স্কুলে এখন আর কলোনি অঞ্চলের ছাত্র ছাত্রীরা ভর্তি হয়না। বাঁশদ্রোনীর ট্রাফিক জ্যাম সর্বজনবিদিত। ছয় নম্বর রুটে অমিল হয়েছে ছয় নম্বর বাস। তার বদলে চলে বাতানুকূল AC6। কি আরাম! কে আর চড়ে ঐ 228 কিংবা 80A’তে। আশির এ’ আছে কিন্তু কবেই বন্ধ হয়ে গেছে আশি নম্বর বাস। এই অঞ্চলের সবথেকে পুরনো বাসরুট। মেট্রো চালু হওয়ার পর দ্রুত বদলে গিয়েছে গড়িয়া পর্যন্ত N.S.C. BOSE  রোডের দুধার ধরে সমস্ত অঞ্চলের চালচিত্র। 

ছেলেবেলায় বড়লোকদের বাড়ি বলতে আমরা বুঝতাম প্রখ্যাত শিল্পী ছবি বিশ্বাসের বাঁশদ্রোনীর বাড়িটা। কি সুন্দর সাজানো গোছানো! এখন, N.S.C BOSE রোডের শুরুতেই ইন্দ্রপুরী স্টুডিওর ঠিক উল্টো দিকে তৈরী হয়েছে চার্নক সিটি। সিংহ দুয়ারে চব্বিশ ঘণ্টা মোতায়েন রয়েছে গার্ড। সেই ‘সিটি’তে অঞ্চলের মানুষের প্রবেশ নিষেধ। কলোনির মানুষের রক্ত-ঘাম দিয়ে তৈরী বাজারগুলিতে আজ কলোনির মানুষেরাই বাজার করতে যায় না। আগরওয়াল, কিরমানি, মোদী, টোডিদের একাধিপত্য বহাল হয়েছে সেখানে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে টাঙানো হয়েছে বিশাল বিশাল হোডিং…”টালিগঞ্জের নয়া রূপকার…”। নিচে মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে যাঁর অনুপ্রেরণায় এই পরিবর্তন হয়েছে তার নাম। আজাদগড় জিডি বিড়লা স্কুল মোড়ে যেখানে আজ হুন্ডাই গাড়ির ঝকঝকে শো-রুমটা তৈরী হয়েছে… এই পরিবর্তনের রূপকারের হাত ধরে…ঠিক সেই মোড় থেকেই আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল কলোনি আন্দোলনের নেতা ইন্দু গাঙ্গুলীকে। এই মোড় থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে আজাদগড় বাজার। একাত্তরে প্রশান্ত শূরকে লক্ষ্য করে যেখানে গুলি চালিয়েছিল কংগ্রেসের ঘাতক বাহিনী। জাম্প করে সে গুলি নিজের বুকে নিয়ে শহীদের মৃত্যু বরণ করেছিলেন বাবু দত্ত রায়। প্রশান্ত শূর আজ আর নেই। আজাদগড় বাজারে তৈরী হয়েছে স্পেন্সারের রিটেল শপ্। গত বিশ তিরিশ বছরের মধ্যে তৈরী হওয়া ফ্লাটের অধিবাসীরা যাঁরা আজ ঐ রিটেল শপে শপিং করতে আসেন তাঁরা বাবু দত্ত রায়ের আত্মবলিদানের কথা শোনেননি কোনও দিন। কিন্তু ঐ ঘাতক বাহিনীর উত্তরসূরিরা… যাঁরা আজ পরিবর্তিত টালিগঞ্জের নয়া রূপকারের ডান হাত-বাঁ হাত…দন্ডমুন্ডের কর্তা…তাদের বিলক্ষণ চেনেন এই নয়া টালিগঞ্জবাসীরা। ছেলে-মেয়ের অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে বিয়ে, উপনয়নে তারা আমন্ত্রিত হন। তাঁরা ডাক পান সেই সব ঠাকুমা-ঠাকুরদার শ্রাদ্ধশান্তিতে যাদের একদিন এদের পূর্বসূরিরা ঘরছাড়া করেছিলেন। পুলিশ-CRP ডেকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অথবা বস্তাবন্দী করে চালিয়েছিলেন বেদম প্রহার। কাঁচা নোখ উপরে ফেলেছিলেন। সিগারেটের ছ্যাঁকায় টসটসে ফোসকা ফেলেদিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন। স্পেন্সারের রিটেল শপটা বাতানুকূল। কি আরাম! কি দরকার ঐসব ফোসকা পড়া লোকগুলোর কথা ভাবার? তাদের মধ্যে যাঁরা ঘাতক বাহিনীর অত্যাচারে চিরদিনের জন্য কুঁজো হয়ে গিয়েছিলেন…বাকি জীবনে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি? -তাদের কথা ভেবে তো  আর “তাহাদের কথা” সিনেমা তৈরী হবে না…সুতরাং তাদের কথা ভেবে সময় নষ্ট করার মতো সময় কোথায়! তাই রাস্তার ধারে মলিন হয়ে আসা শহীদ বেদীর গায়ে খোদাই করা নামগুলি আজ টালিগঞ্জের নয়া অধিবাসীদের কাছে অজানাই থেকে গিয়েছে। ঠাকুমা দিদিমারা বৃদ্ধাশ্রমে অথবা সিঁড়ির তলায় ছোট্ট একটা একচিলতে ঘরে একা একাই দিন গুনছেন। ছেলেপুলেরা আমেরিকায়, লন্ডনে। 


এখন মাঝেমাঝে ভাবি, আমাদের এই রাস্তাটা, রাস্তার মোড়টা, রানিকুঠির পুকুরটা, পুকুর পাড়ের আম গাছটা একদিন যাদেরকে খুব খুব কাছের মনে হয়েছিল সেগুলি কি সত্যিই খুব কাছের ছিল? নাকি শুধুই ছেলেবেলার কল্পনা? আমাদের এই পাড়াটা…পাড়ার সমস্ত মানুষেরা…একদিন যাঁদের নিজের পরিবারের সদস্য বলে মনে হতো আজ তাঁরা সব কোথায়? আজকাল দরজার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া অর্ধেকের বেশিজনকেই চিনি না। কারা ওরা? এই পাড়াটা কি সত্যি সত্যিই আমাদের ছিল? আমরা কি এই পাড়াতেই বেড়ে উঠেছি? নাকি সাময়িক কিছু দিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম এখানে? এখন সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাই একে একে বদলে গেছে সমস্ত অঞ্চলটা। পরিচিত মানুষগুলি চলে গেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। WhatsApp, Facebook- এ মাঝে মাঝে তাদের ছবি দেখতে পাই। কমেন্টসে লিখি- ভালো থেকো। আমার কমেন্টসে লাভ চিহ্ন পড়ে। সেও পাল্টা লেখে, তুমিও ভালো থেকো। এক ঝলকে মনে পরে যায়, পুকুরে স্নান করতে যাওয়ার আগে আম, তেঁতুল পাড়ার কথা…। চোখ বুঁজে আসে। গিন্নি ডাকে, কিগো…চা খাবে না? অসময়ে ওভাবে ঘুমাচ্ছো কেন? ওকে কি করে বোঝাই সেই তেঁতুল দিয়ে কাঁচা আম মাখার কথা! ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুরে স্নান করার কথা! লক্ষ্মী পুজোর পরে কলাগাছ বেঁধে ভেলা তৈরী করে ভেসে বেড়ানোর কথা! মধুবনে প্রথম দিনের প্রথম শো দেখার কথা! খবরের কাগজটা খুলে নিই তাড়াতাড়ি। গিন্নি কি বুঝে ফেললো আমার মনের কথা? নাঃ। ও কি করে বুঝবে? কি করে বুঝবে অলক্ষ্মীর আতুর ঘরের এই অতি সাধারণ এক ব্যক্তির মনের কথা? -এই বলে নিজেকে নিজেই আশ্বস্ত করি। ছেলেবেলার ডিজনিল্যান্ড ছেড়ে দ্রুত ফিরে আসি নয়া টালিগঞ্জের মাটিতে। স্বাভাবিক ভাবেই বলি, চা দাও…বিস্কুট আর দিও না।