বেআইনি বাজি কারখানা বলে গত২৭শে আগষ্ট তারিখে দত্তপুকুরে মোচপোল গ্রামে বিস্ফোরণের ঘটনাটিকে যতই লঘু করে দেখানো হোক, বিস্ফোরণ যে বাড়িতে ঘটেছে তার পিছনে বাঁশবাগানে ত্রিপল ঢাকা বড়ো একটি জায়গায় স্তুপাকৃতি পাথরকুচি এবং রাসায়নিক প্রমাণ করছে, সেখানে বোমা তৈরি হতো। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষায় “এখানে আলুবাজি তৈরি হোত। সাত আটটা আলুবাজি একসঙ্গে বেঁধে বোমা বানানো যায়!” সেই রবিবার দুপুরে যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছিল সেখানে বাজির প‍্যাকিং করা হোত কিন্তু পিছনের বাঁশবাগানে ছিল আসল কারখানা। ল‍্যাবরেটরির মত এই কারখানার সোডিয়াম নাইট্রেট,বেরিয়াম এবং পটাশিয়াম ক্লোরেটের সঙ্গে পাওয়া গেছে পাথরকুচি। সরকারি ও সংবাদ মাধ‍্যমে প্রচারিত পরিসংখ্যান যাই হোক কমবেশি একশো বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। না বলে দিলে দেখে মনে হবে,প্রবল ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ২৮শে আগষ্ট ঘটনাস্থলে গিয়ে সিপিআই(এম) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্যকমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন,”তিনমাস আগে এগরার বিস্ফোরণকাণ্ডের পরে মুখ‍্যমন্থ্রী মমতা ব‍্যানার্জী বলেছিলেন,আমাদের চোখ খুলে গেছে। কিন্তু এই ঘটনা প্রমাণ করছে উনি চোখে ঠুলি পরে আছেন।

” মহম্মদ সেলিম যথার্থভাবেই অভিযোগ করেছেন পুলিশ সুপারের অফিসের তিন কিলোমিটার দূরে এই ঘটনা ঘটল কেমন করে? এতদিন কি পুলিশ প্রশাসন ঘুমোচ্ছিল?


শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং পুলিশ প্রশাসনের যোগসাজশে বহুদিন ধরে দত্তপুকুর থানার অধীনে বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলে বাজি কারখানা। প্রকাশ‍্যে আসছে পুশ ও নেতাদের জন‍্য বরাদ্দ মাসোহারার লেনদেনের কদা। মাঝেমাঝেই ছোটখাটো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, আহত শ্রমিকদের দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কোন কোন শ্রমিক মারাও যান, সেই মৃতদেহ কোথায় যায় সে খবর জানেন না মোচপোল গ্রামের বাসিন্দারা। কেননা বেশিরভাগ শ্রমিকই অন্যজেলা থেকে কাজ করতে আসেন। রবিবারের বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে নয়জনের জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সংখ‍্যাটা বাড়তে পারে। গুরুতর আহতদের মধ‍্যে তিনজন মহিলা ও তিনজন শিশু রয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে,এগরায় বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন এগারোজন।

ইছাপুর নীলগঞ্জ পঞ্চায়েতের অধীন মোচপোল গ্রামের এই বাজি কারখানার দুই মালিক তৃণমূল নেতা শামসুল আলি ও তার ভাই কেরামত আলি এবং কেরামতের ছেলে রবিউল আলি তিনজনেই বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে। বাজির কারবারের অন‍্যতম প্রধান মাথা আজিবর রহমান পলাতক। আহত হয়েছে কেরামতের পরিবারের কয়েকজন সদস্যও। তাদের বাড়ির আশেপাশের ছ টি বাড়ি রীতিমতো ক্ষতিগ্রস্ত। এগরা কাণ্ডের পর এই বাজি কারখানা তল্লাশি করে পুলিশ কেরামতকে গ্রেপ্তার করেছিল অস্ত্র আইনে কিন্তু কিছুদিন পরেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে আবার কারবার চালু করে। দত্তপুকুর সংলগ্ন নারায়ণপুর হলো এই অবৈধ বাজি কারখানার মূলঘাঁটি তাকে কেন্দ্র করেই মোচপোল,কাথুরিয়া,সাহেবায়ানা,জালসুখায় রমরমিয়ে চলে অসংখ্য বেআইনি বাজি কারখানা। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নারায়ণপুরের একটি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটার কারণে বাজি কারখানাগুলি পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছিল।কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরেই দত্তপুকুরের বিধায়ক তথা পশ্চিমবঙ্গের খাদ‍্য মন্ত্রী রথীন ঘোষ,তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ‍্যসভার সাংসদ দোলা সেন নারায়ণপুর চৌরাস্তায় রীতিমতো সভা করে বাজি কারখানা চালু করার পক্ষে জোর সওয়াল করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চালু হয়ে যায় বাজির কারখানা। রবিবারের বিস্ফোরণকাণ্ডের পর দত্তপুকুর থানার আইসি এবং নীলগঞ্জ ফাঁড়ির ও সিকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু রাজনৈতিক দলের রাঘব বোয়ালদের গায়ে আঁচ লাগবে কি? এ বছর মার্চ মাসে মহেশতলায় বিস্ফোরণ ঘটার পর সারা রাজ‍্যে বিভিন্ন বাজির কারখানায় তল্লাশি করা হলেও আজিবর রহমানকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয় গত রবিবার বিস্ফোরণের পর সপরিবারে পালিয়ে যাওয়ার পরে আজিবর রহমানের বাড়ি ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা ভাঙচুর চালালে দেখা যায় প্রচুর বাজি ও বাজির মশলা মজুত রয়েছে। দত্তপুকুর থানা কি কিছুই জানত না? বেআইনি বাজি কারবারের সঙ্গে যুক্ত ব‍্যক্তিরা চটপট জামিন পেয়ে যায় কেমন করে, সেই রহস্যও ভেদ করতেও খুব বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন নেই।

স্বয়ং মুখ‍্যমন্ত্রী সহ পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানেন গোটা পশ্চিমবঙ্গে মাত্র চব্বিশটি বাজি কারখানা বৈধভাবে চলে। শিশুশ্রমিকদের ব‍্যবহার করা কমিয়ে দেওয়া হলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। কিন্তু সমস‍্যাটা অন‍্য জায়গায়। নগদ টাকা মোটা লাভের জন‍্য বেআইনি বাজি কারখানার সংখ‍্যা বেড়েই চলেছে। তার ওপর গত ২৩শে আগষ্ট সরকারি অনুষ্ঠান থেকে বাজি ক্লাস্টার এবং লাইসেন্স পাওয়ার জন‍্য ওয়েবসাইট চালু করার ঘোষণা করার পর থেকে অনেকর মনেই ধারণা হয়েছে সহজে লাইসেন্স পাওয়া যাবে। ফলে অতি উৎসাহে তাঁরা পুজোর মরশুম শুরু হওয়ার আগে একশ্রেণীর অতি উৎসাহী ব‍্যবসায়ী উৎপাদন শুরু করে দিতে চাইছেন। শুধু তাই নয় কয়েক লক্ষ গরিব মানুষ এই বেআইনি কাজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুক্ত থাকেন তাঁদের জীবন জীবিকার নিরাপত্তা নিয়েও সেই ব‍্যবসায়ীদের মত সরকার ও উদাসীন।

পরিবেশ আকাদেমি নামে যে সংগঠন চলতি সপ্তাহে এই বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে গ্রীণ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জানাতে চলেছেন,সেই সংগঠনের নেতা বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ‍্যায় জাতীয় পরিবেশ আদালতে ২০১৫ সালের নভেম্বর এবং ২০১৬ মাসের আগষ্ট মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিলেন সেই দুটি মামলার রায়েই স্পষ্ট বলা হয়েছিল, প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রায় প্রতিটি বেআইনি বাজি কারখানার আড়ালেই বোমা তৈরি হয়।

২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য শুরু হওয়া এবং বেআইনি বাজি কারখানা ছড়িয়ে পড়া প্রায় একইসঙ্গে ঘটেছিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাসের মধ‍্যে ২৭টি বিস্ফোরণের ঘটনায় ৯০জন নিহত হয়েছেন তার মধ‍্যে বর্তমান সরকারের আমলে নিহত হয়েছেন ৭৬ জন।


দত্তপুকুর প্রমাণ করছে শাসক দলের মদত থাকলে জনবহুল এলাকায় ও বোমবাজির কারখানা চালু রাখা যায়। গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরা মরলে ওদের কিছু যায় আসে না। সরকারি কোষাগার থেকে কিছু টাকা দিয়ে দরদী সাজা যাবে।


এইসব অপরাধী দের বিরুদ্ধে রুখে না দা়ঁড়ালে আমাদের আগামী প্রজন্ম বিপদে পড়বে।