স্বাধীনতার পচাত্তর বছরে এসেও ৯৯ শতাংশ মানুষের স্বার্থ একদিকে, ১ শতাংশ মানুষের স্বার্থ আর একদিকে। এই ১ শতাংশ মানুষ সম্পদের চূড়ায় বসে আছে, আর অন্যদিকে থাকা ৯৯ শতাংশ মানুষ জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত, অবসন্ন বোধ করছে । এমন তো হবার কথা ছিল না, অনেকেই তো বলেছিলেন ব্রিটিশ তাড়িয়ে স্বাধীনতা এলেই দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে । কী থেকে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম সেটাও বোধহয় অনেকেই আমরা তলিয়ে ভেবে দেখি নি । আগে ইংরেজ তাড়াই তো তারপরে বাকিটা ভেবে দেখা যাবে এমন মনোভাব অনেকের মধ্যেই ছিল। জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, ধনবৈষম্য, মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ থেকেও মুক্তি দরকার – এই উপলব্ধি নিয়ে আলোড়ন ছিল একেবারেই মৃদু প্রকৃতির। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই দেশের মানুষের হাতেই ‘জাতির জনক’ গান্ধীজির মৃত্যুর ঘটনার লজ্জাতো আজো কাটানো গেল না মন থেকে । যে আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের হাতে গান্ধীজির মৃত্যু হয়, তাদের উত্তরসূরিদেরকেই ‘ক্ষমতার বেদীতে আসন দেবার’ ব্যবস্থা কয়েক বছর আগে হয়ে গেছে। এমনকি গান্ধীর হত্যাকারীদের রাজনৈতিক আদর্শের উত্তরসূরি মানুষরা এখন ‘দেশপ্রেমিক কে’ সেই সার্টিফিকেট দিচ্ছেন ।
গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও অর্ন্তজলি যাত্রা – পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের বাসিন্দা আমরা। কথাগুলো শুনতে তো মিষ্টিই লাগে। সেই গৌরবের গণতন্ত্রের এমন হাল যে ভোটের আগে সবার কাছে যায় ভোট প্রার্থীরা, ভোটের পরে জনগণকে ভুলে গেলেও হয় – এটাই দস্তুর। সংবিধানে লেখা ‘সমাজতন্ত্র’, ‘গণতন্ত্র’ শব্দগুলো কি শুধু সৌন্দর্য বাড়ানোর শব্দই থেকে যাবে! সংবিধানে লেখা রইল ‘সমাজতন্ত্র’, অথচ দেশ বেঁচতে বাকি আছে শুধু! সংবিধানে লেখা রইল ‘গণতন্ত্র’, অথচ গণতন্ত্রের এমন আকাল এদেশে আসেনি কখনো। এই কথার বিরুদ্ধে কেউ বলতেই পারেন- ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার আছে, ভোটে নিজের পছন্দের প্রার্থীর হয়ে প্রচারের অধিকার আছে, ভোট দেবার অধিকার আছে। বাস্তবে গণতন্ত্রের খোলস নিয়ে এক্কা-দোক্কায় ব্যস্ত ৯৯ শতাংশ আর গণতন্ত্রের উপরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কিন্তু পুঁজির মালিক ঐ এক শতাংশ মানুষের । এক শতাংশের জমিদারি কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বা পর্দার আড়ালে। 
শিক্ষা ব্যবস্থা – রাষ্ট্র বলেছিল সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করবে । পরাধীন মানুষরাও নিশ্চয় সেই স্বপ্নের দিকে এগোবার ভাবনা নিয়েই জীবনকে বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীন রাষ্ট্র সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করার কথা বলে ছিল ঠিকই, কিন্তু রাখল কোথায় কথা! ৭৫ বছর তো কেটে গেল, কেউ কথা রাখল না । বরং অনেকদিন থেকেই তো বলে যাচ্ছে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা- সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যেই তো এক সময় সরকারের তহবিল থেকে হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল জেলায় জেলায় । সেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ এতটাই ভেঙ্গে পড়ার মুখে যে, মানুষ কোবিদ-১৯ পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত নাজেহাল হয়ে পড়ল । প্রচার যাই থাক, বাস্তবের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বুঝতে শুরু করেছে- দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল একেবারেই তলানীতে ঠেকেছে।
খাদ্যের অধিকার – দেশের সংবিধানের ২১ নং ধারায় জীবনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে । এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে মানুষের খাদ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন । যদিও এই কথাটা দেশের সরকারের মনে নেই নিশ্চয়। তাই দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়কে মানুষের খাদ্যের অধিকারের কথাটা নির্লিপ্ত সরকারকে বারেবারে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। 
‘আত্মনির্ভর ভারত’র স্বপ্ন বিলি ও বাস্তব – দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যা ৬.৩ কোটি। তার ২৫ শতাংশ ক্ষুদ্র, ছোট শিল্প চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে । অনেক বছরের পরিকল্পনা, অনেকের ত্যাগ ও পরিশ্রমের বিনিময়ে গড়ে ওঠা পাবলিক সেক্টর ঠকঠক করে কাঁপছে – কে কখন বিক্রি হয়ে যায় কোনো ঠিক নেই। এ যেন হাঁড়িকাঠের সামনে ছাগলের দলের মত অবস্থা। ছাগলগুলোর সবার গলা কাটবে জানে সবাই, কিন্তু কখন কাটবে সেই অপেক্ষায় কেঁপে অস্থির। 
সম্প্রীতির স্বপ্ন চুরমার- কেমন দেশের স্বপ্ন ছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের? তাদের স্বপ্ন ছিল এমন দেশের যেখানে থাকবে না সাম্প্রদায়িকতা, থাকবে না জাতপাতের বিভেদ। থাকবে সম্প্রীতি, থাকবে ধর্মনিরপেক্ষতা । বাস্তবে আক্রান্ত ধর্মনিরপেক্ষতা। সব ক্ষেত্রেই ‘সংখ্যালঘু’দের সামনে আতঙ্কের খাড়া ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে । শাসকের সমর্থকদের, হিংসার কারবারিদের আকাশ-বাতাস কাপানো আতঙ্ক জাগানো চিৎকারে সুস্থ ভাবে বাঁচাই দায় হয়ে উঠছে । আর রাজার আসনের গভীর নীরবতা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াল ও ভয়ঙ্কর করে তুলছে দিন কে দিন। 
ধনবৈষম্য – ধনবৈষম্যহীন দেশ হবে এমন স্বপ্নেই মানুষ নিশ্চয় দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে । অথচ স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরেও দেশের এক অতি ক্ষুদ্র অংশের ব্যবসায়ীদের লোভ-লালসা সরকারের একাংশের প্রশ্রয়ে ও ভালবাসায় চূড়ান্ত নগ্ন ও হিংস্র আকার ধারণ করেছে । সরকারের ভালোবাসার ফসল  হিসাবে মাত্র এক শতাংশ মানুষের কোষাগার এই মুহূর্তে উপচে পড়ছে, আর বাকিরা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় দিন কাটিয়ে চলেছে।
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে ধীরে ধীরে হলেও স্বাভাবিকভাবেই একটা অপ্রাপ্তির উপলব্ধি দানা বাঁধতে শুরু করেছে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে। তাদের পিতৃপুরুষরা কি চেয়েছিলেন আর স্বাধীনতার প্ল্যাটিনাম জুবিলির বছরে এসে কি পেলেন উত্তরাধিকারীরা- তার কোন সমন্বয় করতে পারছেন না। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণতন্ত্রের হাল একেবারে বেহাল সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না – উপরটা চকচক করলেও অযত্নে, অবহেলায় ভিতরটা একেবারে ফোঁপড়া হয়ে গেছে ।