জয় জগদীশ হরে! যিনি জগৎ তিনিই ঈশ, একাধারে জগদীশ। এক অবতারে যিনি জগদীশ কুমার নামে জে এন ইউ-নাচানো উপাচার্য, অন্য অবতারে তিনিই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্তা। নয়া শিক্ষানীতির অনুসরণে তাঁর অধীনস্থ কমিশন স্নাতকস্তরের পঠনপাঠনের সংস্কারের উদ্দেশ্যে Curriculum and Credit Framework-শীর্ষক এক দলিল বানিয়েছে। দলিলের কপিসহ তা কার্যকরী করার বার্তা গত ৩১ জানুয়ারি কমিশনের সচিব-মারফৎ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাদফতরে পৌঁছায় । মাসদেড়েক বাদে (১৭/৩/২৩) এরাজ্যের সরকারের কোনো অবর সচিব দলিলটি নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন সরকার-পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মহানিবন্ধকদের কাছে। তিনি সঠিক কাজই করেছেন; কারণ দুএকটি বিশ্ববিদ্যালয় বা অটোনমাস কলেজে স্নাতকোত্তর শিক্ষার পাশাপাশি স্নাতকস্তরের শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও এখনো পশ্চিমবঙ্গে পাঠক্রম, পরীক্ষা এবং ডিগ্রিপ্রদানের ব্যাপারে স্নাতকস্তরের কলেজগুলির পক্ষে কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্তি আবশ্যিক।  

তবে অবর সচিবটি নথি পড়ে দেখলে নিশ্চয়ই খেয়াল করতেন যে পুরো নথিতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ কথাটি এসেছে কুল্যে একবার বা দুবার। তাও যে পড়ুয়া তার চূড়ান্ত সেমেস্টারে গবেষণার কাজ করবে সে কার কাছে কাজ করবে সেই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়ের’ কোনো শিক্ষকের কাছে। কলেজগুলিতে পাঠক্রমের প্রস্তুতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামতের কোনো জায়গা নেই; এমনকী পড়ুয়ার গুণমান যাচাই বা assessment সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে নানাবিধ পদ্ধতির কথা বলার পরেও কোথাও একথা বলা নেই যে, যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে ডিগ্রিটি পাবে এই যাচাই-প্রক্রিয়ায় তাদের ভূমিকা কী হবে।

 সেই যে ২০২০ র জাতীয় শিক্ষানীতির দলিলে বলা আছে (অনুচ্ছেদ ১০.৩গ, ১০.১২, ১০.১৩), ক্রমে সব স্নাতকস্তরের কলেজই স্বশাসিত হবে এবং ডিগ্রি-প্রদানের অধিকারী হবে দলিল-প্রণেতারা বোধ হচ্ছে সেই আগামী ‘অচ্ছে দিনে’র স্বপ্নে মগ্ন থেকে এটি তৈরি করেছেন। নাকি এই নতুন ধাঁচা লাগু করার মধ্য দিয়েই তার প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে? অন্তত পশ্চিমবঙ্গে স্নাতকস্তরের কলেজগুলির বিশ্ববিদ্যালয়-সংযোগের কথা অগ্রাহ্য করেই এদলিল তৈরি হয়েছে এসন্দেহ খুব সঙ্গত। প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাদপ্তরও কি সেকথা ভুলে গিয়েছেন যে মঞ্জুরি কমিশন বলামাত্রই দলিল কার্যকরী করার ফতোয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর চাপাতে উঠে পড়ে লেগেছেন?

এব্যাপারে শিক্ষাবিদ্‌, শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির  মতামত নেওয়া রাজ্যসরকার দরকার মনে করবে এ প্রত্যাশা তাদের কাছে কেউ করে না। তবু প্রশ্ন উঠেছে পরিকাঠামো নিয়ে। চারবছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন গুরুত্বের নানা সাইজের স্নাতক কোর্স নিতে গেলে ঘর দরকার , ল্যাবরেটরি দরকার, শিক্ষক দরকার। আবার গবেষণার পরিবেশও দরকার। কমিশনের দলিলেও ন্যূনতম পরিকাঠামো সুনিশ্চিত করার কথা বলা আছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং না ভেবেচিন্তে নতুন ব্যবস্থা চালু করার বিপক্ষে সঙ্গত যুক্তিও বটে। কিন্তু সেটাই একমাত্র কথা নয়। আসল কথা, প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটিই অযৌক্তিক ও অসংগতিতে ভরা। এটা প্রকৃত একুশশতকী শিক্ষা, সুসভ্য মার্কিন দেশে এমন শিক্ষাই চালু আছে ইত্যাদি ভাঁওতাপূর্ণ বচনের গঙ্গাজল ছিটিয়ে তার অন্তঃসারশূন্যতাকে চাপা দেওয়া যাবে না। দুনিয়ার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাধারণত নানাধরনের পড়ুয়ার কথা মাথায় রেখে ছোটখাট স্বল্পমেয়াদী কিছু পাঠক্রম থাকে, কিন্তু যারা সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে স্নাতকস্তরের শিক্ষা নেবার জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসেছে তাদের বিভাগীয় বিদ্যায় দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় জল মিশিয়ে পড়ুয়ার ‘ইচ্ছাকে’ অজুহাত করে খণ্ডিত পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে গোড়া থেকেই বিভাজন তৈরির এই আজগুবি প্রচেষ্টা কোথাও দেখা যায় না।

আমি এখানে ২০২০তে মোদীসরকারের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাব না; কিন্তু এতে সন্দেহ নেই যে তার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য উচ্চশিক্ষার বাজারীকরণ এবং সরকার-পোষিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সম্পূর্ণ কেন্দ্রীকরণ। তৃণমূলের জমানায় পশ্চিমবঙ্গ যে এনীতি তৈরি হবার আগে থেকেই তার অন্যতম গবেষণাগারের কাজ করেছে স্কুলশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা উভয়ক্ষেত্রেই তার অনেক প্রমাণ দেওয়া যায়। এখানে আমরা বিশেষত উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের কথাই বলছি। যখন রাজ্যসরকার বলেকয়ে  স্নাতকস্তরে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির প্রয়োগ শুরু করতে যাচ্ছে তখন এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মমতার কোনো এক সময়ে উচ্চারিত আস্ফালনকে পাত্তা দিয়ে লাভ নেই। বরং এটাই মনে রাখা দরকার যে বকলমে এই নীতিই তৃণমূল সরকার প্রয়োগ করে চলেছে কেন্দ্রীয়স্তরে তা তৈরি হবার আগে থেকেই।

বর্তমান আলোচ্য দলিলটির সম্বন্ধে প্রথম যে কথাটি বলেছি তা হল স্নাতকস্তরের শিক্ষাব্যবস্থা তার উপজীব্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী যোগের কথা দলিলে অনুক্ত রয়েছে। এটা অনবধানে ঘটে গেছে এমন মনে করার কারণ নেই। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি সরকার-পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেন্দ্রের বর্তমান কর্তাদের কাছে যেমন, তেমন আমাদের রাজ্যের শাসকদলের কাছেও গলার কাঁটাবিশেষ। বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার জগতে তাদের মধ্যেকার অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান নানা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়ে যে উন্নত মান, আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং স্বাধিকারের আসন দখল করে আছে সেটাই কর্তাদের নাপসন্দ। তাদের কোমর ভেঙ্গে দেবার উদ্যোগ চলেছে যেমন জে এন ইউ বা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তেমন এরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও। এরাজ্যে ২০১৭ সালে আগেকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আইনগুলির পরিবর্তে যে নতুন সামগ্রিক আইন আনা হয়েছে তাকে খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে আর্থিক বিষয়সংক্রান্ত ধারা এবং প্রশাসনিক শৃংখলাসংক্রান্ত ধারাগুলির মূল লক্ষ্য অভ্যন্তরীণ স্বাধিকারের প্রসঙ্গকে মোটামুটি নিকেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় বিষয়ে সরকার তথা শাসকদলের একচ্ছত্র ক্ষমতা বহাল করা। তদুপরি স্ট্যাটুট তৈরির বিষয়টিকে দীর্ঘদিন মুলতুবি রেখে সামান্যতম কাজের জন্যও বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারের তথা শাসকদলের মুখাপেক্ষী করে রাখা। 

১৯৪৮-৪৯ সালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রাধাকৃষ্ণণ কমিশনের বক্তব্য ছিলঃ নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, কিন্তু রাষ্ট্রের অনুদানের সঙ্গে একাকার করা যাবে না শিক্ষানীতি ও বিদ্যাচর্চার ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে। বর্তমানে এরাজ্যের যে শিক্ষামন্ত্রীটি জেলে আছেন তিনি কিন্তু একসময়ে এই স্পর্ধিত উক্তিই করেছিলেন যে, সরকার যখন টাকা দেয় তখন আধিকারিক, শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষাকর্মী সবাইকে তাদের ফতোয়াই মেনে চলতে হবে। আমরা যদি ২০২০র জাতীয় শিক্ষানীতির ১৭ এবং ১৮নম্বর ধারাগুলির দিকে তাকাই তাহলে দেখব সরকারপোষিত উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় প্রশাসনের সম্পূর্ণ কেন্দ্রীকরণ এবং শিক্ষক-ছাত্র-শিক্ষাকর্মীদের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারহরণের নকশাটি পূর্ণতা পেয়েছে সেখানেই।

এইসব ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের ভিতরে তার পরিচালনায় থাকবে কর্পোরেট ঢঙে তৈরি এক গভর্নিং বোর্ড যার কোনো সদস্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়, হয়তো তার বৃহদংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকও নয়; স্বাধিকার মানে হবে তাদেরই স্বাধিকার। আর সার্বিকভাবে সর্বোচ্চ স্তরে উচ্চশিক্ষার লাগাম থাকবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে National Higher Education Regulatory Authorityর হাতে। রাজ্যস্তরেও অনুরূপ এক ব্যবস্থার দিকেই কি আমরা বেশ কয়েক ধাপ এগোইনি? কী কেন্দ্রে কী এরাজ্যে উপাচার্যের সম্মানিত পদে নিয়োগের বিশ্বাসযোগ্য রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করে শাসকের পেটোয়াদের বসানোর উদ্দেশ্যও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বমর্যাদার হানি করা। এতগুলো বেড়ি পরানোর ফলে যে তার চাহিদায় ভাটার টান আসছে তার প্রমাণ এত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়াসত্ত্বেও সমর্থ পড়ুয়াদের অন্য রাজ্যমুখী ঢল।

বর্তমান দলিলটি যদি রাজ্যে কার্যকরী করতে হয় তাহলে এখনই কলেজগুলির বিভিন্ন বিভাগে সেমেস্টার-ভিত্তিক অন্তত চার বা পাঁচরকম পাঠক্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। এই পাঠক্রমের মধ্যে নানা পর্যায়ের বিভিন্ন কোর্স থাকবে, যেগুলিতে অংশগ্রহণ করে পড়ুয়ার জমার ঘরে ধনাত্মক বৃদ্ধি ঘটবে। স্নাতকস্তরের তকমা মিলবে সঞ্চিত ন্যূনতম ‘credit’এর ভিত্তিতে। পাঠক্রমের কোনোটি একবছরের (২ সেমেস্টার), কোনোটি দুবছরের (৪ সেমেস্টার), কোনোটি ৩ বছরের (৬ সেমেস্টার), কোনোটি চারবছরের (৮ সেমেস্টার)। একবছরে দুটি সেমেস্টারে নির্দিষ্ট ক্রেডিট অর্জন করার পরে পড়ুয়া চাইলে এবং বাড়তি একটি বৃত্তিমূলক কোর্স করা সাপেক্ষে সে একটি স্নাতকস্তরের সার্টিফিকেট নিয়ে উচ্চশিক্ষায় ইতি টানতে পারবে বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরে এসে আবার লেখাপড়া শুরু করতে পারবে। দুবছর বাদে পড়া সাঙ্গ করতে চাইলে তার প্রাপ্য হবে স্নাতকস্তরের একটি ডিপ্লোমা। ৩ বছরে সে পাবে সাধারণ স্নাতক ডিগ্রি। কিন্তু অনার্স-সহ বা অনার্স এবং গবেষণা-অভিজ্ঞতা সহ ডিগ্রি পেতে হলে তার জন্য সময় লাগবে চারবছর। সেক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সে একবছরেই করতে পারবে। এখানেও স্নাতকস্তরের শিক্ষার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পঠনপাঠন বা গবেষণার ঘনিষ্ঠ যোগের প্রয়োজনের উল্লেখই নেই। ভাবখানা এই যে, আমাদের বিধানে দিগ্‌গজ হয়েই ছাত্র নেহাৎ বেড়াতে বেড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকবে, এবার তোমরা তোমাদের মতো নিজেদের কেটেছেঁটে তার উপযোগী বানিয়ে নাও।

যারা তিনচার বছর বা ৬-৮ সেমেস্টার কলেজশিক্ষা গ্রহণ করবে তাদের অবশ্যই কোনো একটি বিভাগীয় বিষয়কে ‘major’ হিসাবে নিতে হবে যদিও প্রস্তাবিত সামগ্রিক পাঠক্রমে ‘মেজরে’র গুরুত্ব  ৭৫% থেকে কমে দাঁড়াবে ৫০%এর মতো। প্রথম বছরে তার গুরুত্ব খুবই কম থাকবে, নানাধরনের ‘ইন্টারডিসিপ্লিনারি’, ‘মালটিডিসিপ্লিনারি’ কোর্স চাখতে চাখতে সেবছরের শেষে এসে পড়ুয়া চাইলে ‘মেজর’ বিষয়টি বদলাতেও পারবে, পাঠক্রম থেকে বেরিয়ে যেতেও পারবে। পরের সেমেস্টারগুলিতে ক্রমে ‘মেজরের’ ওপর জোর পড়বে। বিষয়ের গুরুত্বকে খণ্ডন করে মাপসই পুরিয়া আকারে পরিবেশনের দিকে ঝোঁক এখানেও খুব স্পষ্ট। নয়া শিক্ষানীতির দলিলের একেবারে গোড়ার দিকেই (পৃ ৫) কলা ও বিজ্ঞানের মধ্যে, বৃত্তিধর্মী ও চিন্তনধর্মী শিক্ষার মধ্যে বিভাজন দূর করার উদ্দেশ্যে বিষয়গত জ্ঞানের ‘ভাণ্ড’গুলিকে ভেঙ্গে ফেলে আন্তঃবিভাগীয় বিদ্যাচর্চার ওপর জোর দেবার অভিনব পরিকল্পনার ভিতরের কথাটা এখানে বেরিয়ে আসছে।

‘পাঠক্রমের নমনীয়তা’, ‘পড়ুয়ার বেছে নেবার অধিকার’, ‘প্রবেশ ও প্রস্থানের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি ঢ্যাঁড়া পেটানোর আড়ালে নয়া শিক্ষানীতি আসলে আমাদের দেশে বহু সাধনার মধ্য দিয়ে অর্জিত জ্ঞানবিজ্ঞানের পরম্পরাগুলিকে অস্বীকার করে পড়ুয়াকে প্রলুব্ধ করছে খণ্ডিত ওপরচালাকির শূন্যগর্ভ খেলনা নিয়ে খুশি থাকতে। বিভাগীয় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অগ্রগতির জন্য অনবরত তার স্বনির্দিষ্ট ধারণার গণ্ডিকে ভাঙতে হয় বই কী। কিন্তু আগে তো সেই বিষয়ে বিদ্যাচর্চা যেপর্যন্ত পৌঁছেছে তার নিবিড় অধ্যয়ন করতে হবে। আন্তঃবিভাগীয় জ্ঞানচর্চার এক আবশ্যক শর্তই তো আগে বিভাগীয় জ্ঞানের মূলসূত্রগুলিকে আয়ত্ত্ব করা। নয়া শিক্ষানীতি পড়ুয়াকে সেসুযোগ থেকেই বঞ্চিত করছে। সঠিকভাবেই অনেকে বলেছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে টিঁকে থাকার মতো আর্থিক ক্ষমতা যাদের নেই তাদের এর আওতা থেকে বহিষ্কার করাই এই নীতির উদ্দেশ্য। সেটা একটা দিক। কিন্তু যারা টিঁকে যাবে তারাই বা কী শিখবে? ক্রেডিট-অর্জন করলেই কি তারা জ্ঞানার্জন করবে?     নয়া পাঠক্রমের পল্লবগ্রাহিতা বরং তাদের ফাঁকি দিয়ে স্বর্গলাভের রাস্তাই দেখাবে।      

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য স্নাতকস্তরের পড়ুয়াদের  ‘চাহিদামাফিক ক্রেডিট-সঞ্চয়ে’র ব্যবস্থা এরাজ্যে ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে। এর সত্যতা স্নাতকস্তরের কলেজশিক্ষকদের কাছে গেলেই যাচাই করা যাবে। পড়ুয়া তার প্রয়োজন বা রুচিমাফিক নানা বিভাগে নানা কোর্স করে আন্তঃবিভাগীয় জ্ঞানের ঘরে সত্যি কিছু ‘জমা’ দিতে পারছে না যা জমছে তা শুধুই খাস্তা কাগজ, নাকি পুরনো পাসকোর্সেরই কিছু অদলবদল করে তাকে ‘choice-based credit system’ বলে চালানো হচ্ছে, তার হাড়হদ্দ তাঁদেরই জানা আছে সবচেয়ে বেশি। মুশকিল হল তাঁদের বেশির ভাগই ‘যাক মান থাক প্রাণ’ বলে এক অসম্ভব পঠনপাঠনের ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু পরিকাঠামোর ঘাটতির কথা বলাটাই আজ যথেষ্ট নয়। এই পদ্ধতি যদি তাঁরা অবলম্বন করে থাকেন তার মধ্য দিয়ে পড়ুয়াদের জানাশোনার মানকে তাঁরা কতোটা উন্নত করতে পারছেন, তার মননশক্তি, ধারণশক্তি, প্রয়োগশক্তিকে কতোটা বাড়িয়ে তুলতে পারছেন তার সত্যিকারের খতিয়ান শিক্ষকদেরই রাখঢাক না করে প্রকাশ্যে আনতে হবে।

এ খতিয়ান শিক্ষকদের করতেই হবে, কারণ উল্লিখিত দলিলের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে দলিল-প্রণেতারা এই পদ্ধতি কার্যকরী করার মধ্যে দিয়ে যে ফলাফল বা ‘outcome’এর প্রত্যাশা করছেন তার দায়  শিক্ষকদেরই বহন করতে হবে। দলিল বলছে,  যারা স্নাতকস্তরে উঠবে তাদের ‘বিষয়গত’ এবং ‘আন্তঃবিষয়’ ‘সামগ্রিক’ জ্ঞান অর্জন করতে হবে ‘বহুমুখী’ জ্ঞানের পটভূমিতে। নিজ বিষয়ে বাস্তবমুখী উচ্চ দক্ষতা লাভ করতে হবে। সমস্যাসমাধানের কৌশল তাদের আয়ত্ত্ব করতে হবে। বিশ্লেষণমূলক চিন্তায় পারদর্শী হতে হবে; আবার উচ্চ সৃজনশীলতাও তাদের থাকবে। ভাষার দক্ষতা, গবেষণার মেধা তারা অর্জন করবে। নেতৃত্বের গুণ, সমন্বয়ী ক্ষমতা ও মূল্যবোধ তাদের অধিগত হবে। কিঞ্চিৎ উদাহরণ দিলাম। ‘মানুষ-গড়ার কারিগরেরা’ বলুন, ফ্রেম-ওয়ার্ক’ বর্ণিত পদ্ধতিতে এমন সব তিলোত্তমাদের গড়ে তোলার কাজে জান লড়িয়ে দিতে রাজি আছেন তো?

‘জানা যাচ্ছে, নানাদিক থেকে সোচ্চার প্রতিবাদের ফলে শিক্ষা দফতর একটু পিছু হটেছে। মঞ্জুরি কমিশনের দলিল খতিয়ে দেখতে উপাচার্য দের নিয়ে একটি কমিটি তৈরির কথা বলছে। কিন্তু শাসকদলের তৈরি কোনো কমিটির কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা কি অবশিষ্ট আছে? তাই ‘নয়া শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে’ এই দাবি থেকে আজ কোনো শর্তেই পিছানো যাবে না।’