বর্ধমানের সোমনাথ ফুলমালি- বয়স আট। পড়ে ক্লাস টু-তে। শরীরের গড়নে পেট ফোলা, মাথা ছোট, পাঁজর গুনে নেওয়া যায় চামড়ার ওপর দিয়ে। আগাপাশতলা অপুষ্ট। গরমের ছুটি বেড়ে গেল, তাই স্কুলে আসা হবে না। তাহলে? গোটা দুপুর বেলাটা রোদে রোদে টো টো। রেগার কাজও বন্ধ তাই মা শাক আর গুগলি তোলার কাজ করে। রোজ দুপুরে মায়ের শাকের ঝাঁকার পাশে বসে পয়সার হিসেব করে। মায়ের আজকাল খুব মাথা ঘোরে ঝাঁকা তোলা নামানোর সময়। হাসপাতালে বলেছে রক্ত নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বেশ কিছুদিন হল আর আয়রন ট্যাবলেট এসে পৌঁছায় না।

পুরুলিয়ার বাসন্তী সোরেন। বয়স এগারো। গরমের ছুটি বেড়ে গেল বলে দুপুরে বাবার সাথে যায় মাংসের দোকান থেকে ‘ছাঁট’ আর চামড়া আনতে।
হাড়ি-বাউড়ি পাড়ায় বিক্রি হয় তারপর চামড়া, ছাঁট বিক্রি হয় মাছের ভেড়িতে।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ইসমত আরা সিদ্দিকী। বয়স ১৩। স্কুল বন্ধ। মেয়ে “ধিঙ্গি” হয়েছে বটে। পাড়ার ডেপো ছোকরারা ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে, স্কুলের বালাই নেই তাদেরও। আইন ১৮, আর শরিয়ত ১৪-তে বিয়ে জায়েজ বললেও বাপ-মায়ের ভয় লাগে এমন মেয়ে ঘরে বসিয়ে রাখতে। ‘কিছু’ হলে? কে শুনবে? মেয়েকে ‘নচ্ছার’ বানাতে পাড়া-প্রতিবেশি, সমাজ, প্রশাসন, এমনকি নেতা মন্ত্রীদেরও কয়েক ঘন্টা লাগবে। তাই বয়সে তিনগুণ বড় পাত্রের সঙ্গে বিয়ে। ফল বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হওয়া, রক্তাল্পতার শরীরে আরও – পীড়ন এবং রক্তক্ষরণ। কয়েকবার হাসপাতাল ঘুরে এসে এখন পনেরো বছরে গর্ভবতী। বাড়ির মুরুব্বিরা বলেছে এমনটা হয়েই থাকে। ঠিক সইয়ে নেবে!

পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির গল্প যে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে তা কমবেশি সকলেই আগে থেকে বেশ বুঝতে পারছিল। কেউ ভাবছিল- সইয়ে নিয়ে নিয়ে কোনমতে নিজেরটা ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে, কেউ প্রাণপণে বিশ্বাস করতে চাইছিল লঙ্কায় যে-ই যায় সে-ই তো রাবণ নিশ্চিত, এমনটা আগেও হত – অন্তত হওয়াটা কিছু অসম্ভব না, কারো যুক্তি এসবে আমার কিছু ক্ষতি তো নেই। টাকার বহর আমাদের অনেককেই চমকে দিয়েছে। সব কটা মাইকে বলা কথা মিথ্যা না ও হতে পারে এমন ভাবতে শুরু করেছেন হয়ত। মুশকিল এটা শুধু টাকার একটা পিঠ। ধর্মতলায় গান্ধী মূর্তির নিচে অনশন সাড়ে পাঁচশ দিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চার বছরের বাচ্চা কোলে মা বসে আছেন বাচ্চাটাকে সাথে করে, ফুটপাতেই চার বছরের জীবনের মধ্যে পাঁচশ’র বেশি দিন সে নাওয়া খাওয়া করে, এভাবেই বেড়ে উঠছে। মায়ের নাম অন্যায় ভাবে প্যানেলে থাকা সত্ত্বেও বাদ গেছে, বাকি অনেকের মতই। চাকরি পেয়েছে সেখানে চূড়ান্ত অযোগ্য কোন নেতার আত্মীয়। মা সহজে ফোঁকড় গলে কোন মন্ত্রীসান্ত্রীর সাথে দেখা করে নিজেরটুকু বাগিয়ে নিতে যাননি। (নিতে গিয়েও ফল হাতে রইল পেন্সিল’। লড়াই থেকে বিভ্রান্ত হওয়া, আর বিকাল পাঁচটার পর ন্যায্য ঢাকরির দাবি জানালে পুলিশ দিয়ে চোরের মার খাওয়া ছাড়া
খুব একটা কিছু দেননি হুজুরেরা আশ্বাসের পরিণামে) তিনি শিক্ষক। বাকিদের সাথেই ন্যায়ের লড়াই বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। সন্তানকে শেখাচ্ছেন ভীষণ অসম লড়াইতেও হার না মানার গল্প। বাচ্চা শিখছে নতুন এক গান্ধীর গল্প – এই দেশপ্রেমিকের একটা মূর্তি আছে ধর্মতলায়, যার তলায় তার মা বসে নিজের প্রাপ্য চাকরির দাবিতে শত শত দিন অনশন করত!
যারা সত্যিই এর মধ্যে যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন এই ডামাডোলের বাজারে ‘ট্রোল’ হচ্ছেন তাঁরাও, চোর-ডাকাতের কান্ডের জেরে। সত্যিকারের শিক্ষকদের কি এই অসম্মান, অপমানগুলো পাওনা ছিল!
সারদার ব্যাপক কেলেঙ্কারি অপরাধের সব বিষয় মাথায় রেখেও বলা যায় মানুষ এদের কথায় বিভ্রান্ত হয়েছিলেন কিছু পাওনার অতিরিক্ত অল্প দিনে পাবার আশায়, কিন্তু এখানে! পরীক্ষায় পাশ করে কাতারে কাতারে ছেলেমেয়ে দিন গুনছে হকের চাকরির জন্য।

চেয়ার মোছা “কবি”, “শিক্ষক’ কবিতা লিখতেন এককালে পবিত্র সরকারকে টিপ্পনী কেটে ‘রূপমকে একটা চাকরি দিন, এম-এ পাশ, বাবা নেই আছে প্রেমিকা!’ ইত্যাদি ইত্যাদি। না না, রূপম এসএসসি বা টেট পাশ করে বসেছিল, এমনটা না! তবে কবিতা ছাপা হত। তারপর উনি উঁচু স্টেজে উঠে গেলেন! তাই কবিতা লেখার জন্য ধর্মতলার গান্ধী মূর্তি দেখতে পান হয়ত, তার পায়ের নিচের ফুটপাতটা আর দেখতে পান না।

যা হোক এই শিক্ষক নিয়োগের ‘হিমালয়ান ডিজাস্টার’-এর সাথে ঘটে যাচ্ছে সোমনাথ, বাসন্তী, ইসমতের ঘটনা। এডুকেশনাল অ্যাপ, অনলাইন পরীক্ষা একদিকে গরিব ছেলেমেয়েদের থেকে শিক্ষাকে দূরে করছে, দ্বিতীয়ত অসততার জন্ম দিয়ে মেধা মেরে ফেলছে। রাক্ষসখালি দ্বীপের ছেলেটা বা তারাকোষিতে গোপালধারা চা বাগানের ছেলেটার বাড়ি থেকে ফোনের কানেকশন পেতে হাঁটতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। তাই অনলাইনে ক্লাস বন্ধ। স্কুল বন্ধ। লেখাপড়া বন্ধ। চিয়া বাগানে কাজে গিয়ে নাইনে পড়া তাবাকোষির মেয়েটি একদিন আর ফিরল না। মা বাপ দৌড়াল বিস্তর, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার পরিকাঠামো সরকারি স্কুলের ৭৮ শতাংশ ছেলেমেয়েদের সঠিক ভাবে জোগাড় করা সম্ভব না। বেসরকারি ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেপিলে সেন্ট্রাল এসি থাকা সত্ত্বেও গরমে ক্লাস করতে পারছে না নাকি শহর কলকাতায় বাচ্চাদের ঘাড়ে এই বন্দুক রেখে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। এর আগে গরম আসেনি কখনো শহরে। তার ফলে গোটা রাজ্যজুড়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্কুলছুট বাড়ল ব্যাপকভাবে। তীব্র দাবদাহে স্কুলবাড়ির ছাদটুকু ছিল, বন্ধুদের পাশে বসে ক্লাস ছিল, সেটাও রইল না। রোদে রোদে চড়ে বেড়ানো, খাবারের খোঁজে দৌড়।

একটা ভাই একটা বোন থাকলে বাড়িতে নিম্নবিত্ত ঘরে আগে লেখাপড়া বন্ধ হচ্ছে মেয়েটির। কোন প্রকল্প তা রদ করতে পারছে না। বাড়ছে নারী পাচার, বাল্যবিবাহ, অপরিণত গর্ভধারণ।

ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভে পড়া ছেলেগুলি বেশিরভাগ যুক্ত হচ্ছে রাজমিস্ত্রীর জোগানের কাজে, মোটর গ্যারেজে, বা সোনার কারিগর হয়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে। আবার মহামারী এলে সেই রাজ্য তাদের পরিযায়ী শ্রমিক বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে, কীটনাশক দিয়ে নাইয়ে চামড়া তুলে নেবে! মানুষ যায় কোথায়!

“আকাশে বসত মড়া ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।”

অপচয় হওয়া টাকার পাহাড় দেখা যায়, অপচয় হওয়া জীবনের সংখ্যা চোখে দেখা যায় না। গেলে তৃণমূলের নেতাদের বাড়ি থেকে যত অবৈধ টাকা উদ্ধার হয়েছে, আর রাজ্য জুড়ে ছোট বড় মেজ মেজ নেতাদের (ভাইপো, পিসি, বিজেপিতে গিয়ে সাধু সাজা নেতা সহ) বাড়ি থেকে আরও যত উদ্ধার হবে তার সবের চাইতে কয়েকশ গুণ বেশি হত! মিড-ডে মিল বন্ধ। সবার সাথে সাথে অপুষ্টির ব্যাপকতম প্রভাব পড়ছে অঙ্গনওয়ারি স্কুলের শিশু থেকে দশ বছর পর্যন্ত শিশুদের। বাড়ছে যক্ষার মত রোগ। বাড়িতে দুধ, ফল আনার অবস্থা নেই। প্রায়ই রাতে ফ্যানা ভাত খাওয়ার আগেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যায় একরত্তিগুলো। রোজ একটু খিঁচুড়ি একটা ডিম শরীরে যেত। বাড়িতে খাওয়ার একটা পেটও কমত। সেটুকুও চুরি! চুরির টাকা কোথায় জমা হয়েছে দেখলেন তো সবাই টিভিতে! পরিণাম – গাঁ-গল্পে অংসখ্য পেট-ফোলা, হলদে চোখের, পাঁজর গোনা শিশু।

আর অপুষ্টির ব্যাপক প্রভাব ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ এ পড়া মেয়েদের, অপুষ্টি আর রক্তাল্পতা। দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেয়েদের রক্তাল্পতাযুক্ত অঞ্চল। সেই মুকুটে আরও পালক যোগ করছে এরাজ্য। এই বয়সকালীন মেয়েরা ঋতুচক্র শুরুর কারণে রক্তাল্পতায় ভুগতে থাকে। স্কুলের খাবার গরিব পরিবারে তা কমাতে সাহায্য করত। তা বন্ধ!

প্রশাসনের সচেতন হওয়ার সময় বয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েতের ভাঙা পাঁচিল নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতে করতে ভুলে যাবেন না ভুখা- কোণঠাসা মানুষ দুনিয়ার সবসময়, সবখানে একইরকম আচরণ করে। তা অতীতে সোভিয়েত গঠনের সময়েই হোক বা বর্তমানে কলম্বোতে। ১৭৯৩ সালের ১৬ অক্টোবর এখনো ফ্রান্স মনে রাখে। ফ্রান্স সম্রাট ষোড়শ লুই-এর স্ত্রী অভুক্ত জনতাকে দিনের পর দিন কটূক্তি করে যেতেন, সেদিন ফরাসি বিপ্লব চলাকালীন রাজপ্রাসাদ থেকে টেনে-হিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে তাদের শেষ হক বুঝে নিয়েছিল উন্মত্ত জনতা। পরিস্থিতি তেমন হোক কেউ চাই না কেউ না! তবে যিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে আছেন তিনি মনে রাখুন

“রহম করুন,
আমার মাতৃভূমি আমায় ফিরিয়ে দিন।
ফিরিয়ে দিন আমি মরিয়া হয়ে ওঠবার আগেই।”