ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধানতম অলংকার সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থার মহিমা বোঝানোর জনপ্রিয়তম ভাষ্য হল, এখানে টাটা বিড়লা আম্বানিদেরও মাথা পিছু একটা করে ভোট আর হতদরিদ্র মানুষেরও মাথাপিছু একটা ভোট! রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বহুদিন আগেই এ কথা বলতে গিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক গ্রামের সাইকেল ভ্যান চালকের ধমক খেয়েছিলাম,”দূর ,কি যে বলেন, ঐ মান্যিগণ্যি লোকজনের খিদে মেটানোর জন্য যেমন এলাহি বন্দোবস্ত ,আমাদের জন্য কি একই বন্দোবস্ত? এক পিস ভোটে আর কি উদ্ধার হবে? টাকার জোরে তেনারা মন্ত্রী পুলিশ কিনে নেবে! “

ভুল কিছু বলেন নি বছর পঞ্চাশের ঐ ভ্যান চালক। এই একসপ্তাহ আগেই তো শুনলাম, প্রত্যন্ত গ্রামে টাকা দিয়ে ভোট করানো হয় ! কখনও শহরাঞ্চলে গরীব এলাকায় রড়লোক রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ভোট কেনার চেষ্টা চলে বলে শোনা যায়। কোথাও কোনও প্রমাণ রাখা হয়না বলে নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয় না । অবশ্য কিংবদন্তি উৎ পল দত্ত নাটকীয়ভাবে সংলাপ উচ্চারণ করতেন,” প্রমাণেবও প্রমাণ চাই!” ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীর বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ নিয়ে পুনর্নির্বাচনের দাবি সহ নির্বাচন কমিশনে যাওয়া হয়েছিল সিপিআই (এম) এর পক্ষ থেকে। বলাবাহুল্য মানা হয়নি সেই দাবি । ভোটের ফলপ্রকাশের পর রেকর্ড ভোটে জয়ী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর বিভিন্ন বুথে পাওয়া ভোটের সঙ্গে বিরোধীদের অস্বাভাবিক ব্যবধানের অঙ্ক যখন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন শাসকদলের পক্ষ থেকে কৈফিয়ৎ আসছে এসব “বিপুল উন্নয়নের ফসল ‘! ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের জনগণ হাড়ে হাড়ে জানেন,এর অন্তর্নিহিত অর্থ। আর জানেন ফলতার ত্রাস তৃণমূল কংগ্রেস নেতা জাহাঙ্গীর, যাঁর দাপটে বেশ কিছু এলাকায় কার্যত প্রচার করতে পারেননি সিপিআই (এম) প্রার্থী প্রতিক উর রহমান। উলুবেড়িয়াতেও এমন অস্বাভাবিক ভোটদানের কাহিনী উঠে আসছে। আপাত নিরুপদ্রব ও সংবাদ মাধ্যমের বিবেচনায় মোটামুটি ঝামেলাবিহীন নির্বাচনের এমন ফলের পিছনে অবশ্যই গোপন সন্ত্রাসের আভাস থাকছেই উন্নয়নের বাণীর রঙিন পর্দা টাঙানো থাকলেও।

ক্ষমতার সঙ্গে পুঁজির নিবিড় যোগ সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে বলেই সংবাদ মাধ্যম ‘হয় মোদি নয়ত মমতা” বাইনারি তৈরি করে । পিছনে চলে যায় কর্মসংস্থানের সংকট, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমস্যা, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার ইস্যু পিছু হটে যায়। ঘোষিত” ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ” অবস্থান থেকে সরে এসে আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছে। নরেন্দ্র মোদির মতো গণহত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র গৌতম আদানিকে বৃহৎ শিল্পপতি হিসাবে তুলে এনে শেয়ার বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার জোরে কর্পোরেট সংস্থার আস্থা অর্জন করেছেন। একই কারণে বিপুল সংখ্যক সস্তার শ্রমিক সরবরাহ করে এবং কৃষক শ্রমিক আন্দোলনের ওপর বুলডোজার চালিয়ে কর্পোরেট সংস্থার আস্থা অর্জন করায়
তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং বিভিন্ন অভিযোগে তাদের জেলযাত্রাও ভোটে প্রভাব ফেলে না। আমরা দেখি নির্ভীক সাংবাদিক বিজেপির চিত্রনাট্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেন। নির্বাচন কমিশন নরেন্দ্র মোদির এবং মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ শুনেও শোনেন না দেখেও দেখেন নি। কর্পোরেট সংস্থার বিজ্ঞাপন নিয়ে দিব্যি সম্প্রচারিত হয় তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির চিত্রতারকাদের রিয়েলিটি শো এবং ছায়াছবি । এবং চতুর্থ পর্বের নির্বাচনের পর থেকে বাম কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারের সংবাদ টেলিভিশন চ্যানেল একরকম ব্ল্যাক আউট করে । কর্পোরেট বান্ধব প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ভোটের শেষে বুথ ফেরত সমীক্ষায় কল্পনায় বিজেপির চারশোর বেশি আসন পেয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস শেয়ার বাজারকে কৃত্রিমভাবে চাঙ্গা করে দেয়। মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া হয় বিজেপির মত তৃণমূল কংগ্রেসও নির্বাচনী বণ্ডের টাকা হজম করেছে। কর্পোরেট দৈত্যরা স্বার্থে ঘা বিলকুল হজম করে না। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের পরিণতি কর্পোরেটরা নিশ্চিত করে দিয়েছিল যখন নির্বাচনী বণ্ড নিয়ে সিপিআই (এম ) এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির করা মামলায় শীর্ষ আদালত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে দেওয়া অর্থের যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ কারণেই
বাংলার রাজনীতির সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক না থাকা দুই প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান ও কীর্তি আজাদ বাংলা থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে গেলেও আমাদের অবাক হতে নেই।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি বলে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ উদ্বিগ্ন এই রাজ‍্য থেকে বিজেপি ৩৮.৭৩ শতাংশ ভোট পাওয়ায়। গোষ্ঠী কোন্দলে দীর্ণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৃণমূল কংগ্রেস থেকে রফতানি করা নেতা কর্মীদের ওপর ভর করে দাঁড়ানো টিভির পর্দা ছাড়া জোরালো রাজনৈতিক প্রমাণ করতে না পারলেও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে টিকে আছে হিন্দী ও হিন্দুত্বের মেলবন্ধনে ধর্মীয় উৎসবের উন্মাদনার ভরসায়। বাকিটা কর্পোরেটের টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা ‘মোদি ম্যাজিকে”র আকর্ষণে। কর্পোরেট সংস্থা নিজেদের মুনাফার স্বার্থেই বামপন্থীদের সংসদে বেশি সংখ্যক উপস্থিতি চাইছে না।