শীতের সময় রোদ পোহানোর জন্য সমুদ্রের পাড়ে অনেক লাল কাঁকড়ারা এসে হাজির হয়, ঠিক তেমনই নির্বাচন এলেই নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে একদল শ্বেত বিপ্লবীদের দেখা যায়, যারা নৈরাজ্য মূলক ও কিছু ব্যক্তিগত এজেন্ডা নিয়ে প্রচারের লাইট পোষ্টে ল্যাজ ঝুলিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। Good for nothing এই সব শ্বেত বিপ্লবীরা শাসকদলের হয়েই ভাড়ায় খাটে। মূলত বামপন্থীদেরকেই এরা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে। কেননা একমাত্র বামপন্থীরাই পারে শাসকের বিরুদ্ধে মূল লড়াইতে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষকে সঙ্গবদ্ধ করতে এবং তাদেরকে সমস্ত শোষন বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে। সমুদ্রের পাড়ের লাল কাঁকড়ারা যেমন বিষাক্ত, তেমনই বিষাক্ত এই শ্বেত বিপ্লবীরা।

লাল কাঁকড়ারা তবু বায়োটার্বেশনের মাধ্যমে মাটির ভৌত ও জৈব-রাসায়নিক গুণাগুণের বা বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটিয়ে খাদ্য সার্কেলের বিভিন্ন জীব-অনুজীব ও উদ্ভিদের বেঁচে থাকার মত পরিবেশ তৈরি করে। সৈকতের মাটির লবণাক্ততাও হ্রাস করে। কিন্তু এই শ্বেত বিপ্লবীরা শাসক বিরোধী সমস্ত বিক্ষোভ-আন্দোলের নেতিবাচক সমালোচনার মাধ্যমে সেসব আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে। বৈপ্লবিক কথাবার্তা বলে বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণিরকে এরা বিভ্রান্ত করে। তাদেরকে বিপথে চালিত করে। শাসকের হয়েই তারা এই কাজ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্যেই হলো নৈরাজ্যকে বজায় রাখা এবং নিজেদের আধিপত্য কায়েম রাখা। যতদিন সমাজে অসমতা, নৈরাজ্য বজায় থাকে ততদিন ruling class-এর পরগাছা হয়ে এরাও টিকে থাকে।

যেহেতু নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বামপন্থীরা অংশগ্রহণ করেন মূলত তাদের মতাদর্শগত যে ভিত্তি তার প্রচার করতে তাই বামপন্থী মতাদর্শগত ভিত্তিকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই শাসক শ্রেণী এই শ্বেত বিপ্লবীদের ভাড়ায় খাটায়। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষদের মধ্যে থেকে এই সব শ্বেত বিপ্লবীদের pick and choose করা হয়। তবে নেতৃত্বে থাকে মূলত প্রাক্তন আমলারা, প্রাক্তন সেনাবাহিনীর বা পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্তা ব্যক্তিরা আর সাহিত্যক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন সমাজ কর্মীরা। কর্মীদের এমন ভাবেই নির্বাচন করা হয় যেন তাদের সরাসরি ভাবে পচাগলা রাষ্ট্রের অংশ বলে মনে না হয়। তারমধ্যে তাদের গায়ে যদি একটু বামপন্থী গন্ধ থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। রাষ্ট্র শক্তির সাথে যতই বিযুক্ত বলে জনগণের সামনে এরা নিজেদের মেলে ধরতে পারবেন, নেতা হিসেবে ততই এদের TRP বাড়বে।

আমাদের দেশে বর্তমান সময়ের ফ্যাসিবাদের এই রমরমা বাজারে সব থেকে বেশি হিংসাত্বক আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে বামপন্থীরা। কেননা একমাত্র বামপন্থীদের হাতেই ফ্যাসিবাদের মারণাস্ত্র রয়েছে। একথা ফ্যাসিস্টরা ভাল ভাবেই জানে। তাই শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতী মানুষের পার্টির উপর এই সর্বগ্রাসী আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে আক্রমণে অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে এই শ্বেত বিপ্লবীরা। এরা মূলত মৃদু সরকার বিরোধীতায় অবতীর্ণ হয়ে সরকার বিরোধী একটা মুখোশ পরে থাকে। কয়েকটা সরকার বিরোধী প্রচার প্রপাগান্ডায় নিজস্ব অবস্থানে অনমনীয় থেকে তাতে অংশগ্রহণও করে। সেখানে গিয়েও তারা নানান বিতর্কের সৃষ্টি করে, এবং আন্দোলনরতদের বিভাজিত করে। তাদেরকে ভুল বোঝায়। নেতৃত্বের সম্পর্ক নানান কুৎসা রটায়। যেনতেন প্রকারে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করে। ঘরের মধ্যে ঘর তৈরি করে। এভাবে তারা প্রতিবাদীদের কিছু অংশের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করে। তাদেরকে নিয়ে ছোট ছোট উপদল ঘঠন করে মূল লড়াই থেকে দূরত্ব তৈরি করে। কখনও কখনও ধান্দা পুঁজির মদতে নানান NGO গঠন করে। বিপ্লবের নাম করেই বিপ্লবকে হত্যা করে।

পরিবর্তন একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সব থেকে অগ্রনী অংশের একটি নিজস্ব মতবাদ রয়েছে। মার্ক্সবাদই হলো সেই মতবাদ। কিন্তু মার্ক্সবাদ কোনো ডগমা নয়। তাই মার্ক্সবাদীদের অনেক বেশি নমনীয় হতে হয়। আবার, যেহেতু মার্ক্সবাদীরা ‘আদর্শ রাষ্ট্র’-এ বিশ্বাসী নয় তাই নানান বাস্তবচিত কর্মসূচি হাজির করতে হয়। এভাবেই লড়াই সংগ্রাম গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু এই পথ মখমল বিছানো নয়। নিশ্চিত ভাবেই নানান বাঁক ও মোড়ের সম্মুখীন হতে হয়। চলার পথে নানান বাঁক ও মোড়ে নানান অন্তরবর্তীকালীণ শ্লোগান হাজির করতে হয়, তা কখনোই কপিবুক না। কপিবুক হতেও পারে না। কিন্তু শ্বেত বিপ্লবীরা এসব নিয়েই চিলচিৎকার জুড়ে দেয়।

ইতিহাস শিক্ষা দিয়েছে, শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই হলো ফ্যাসিবাদ বিরোধী দূর্গ। সমস্ত বাধা বিপত্তিকে পায়ের ভৃত্য করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। এই লড়াই জারি থাকবে…যত দিন না পর্যন্ত নতুন সমাজ গঠন হচ্ছে। আর এই লড়াইতে শ্রমিক শ্রেণীর একমাত্র শৃঙ্খল ছাড়া হারবার কিছু নেই, জয় করবার জন্য আছে গোটা দুনিয়া।