বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবার পর গত প্রায় এক দশকে এ দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তার রীতিনীতি পুরোদস্তুর বিপন্ন বলা যেতে পারে। অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মত দেশের নির্বাচন কমিশনও এখন সম্পূর্ণ ওদের নিয়ন্ত্রণে আনবার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালিয়ে  সফল হয়েছে বলা যেতে পারে। প্রতিরক্ষা, শিক্ষা সংস্কৃতি ও গবেষণা সংস্থা, বিচার ব্যবস্থার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন পরিচালনাতেও সঙ্ঘ পরিবার তাদের আধিপত্য কায়েম করেছে। ২০১৬-২০১৭ সালে ফিন্যান্স এক্টের মাধ্যমে দেশের চারটি চালু আইনের (জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ১৯৫১, কোম্পানি আইন ২০১৩, আয়কর আইন ১৯৬১ ও বৈদেশিক অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১০) প্রয়োজনীয় সংশোধন করে বিজেপি সরকার নির্বাচনী বন্ড চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এদেশের লোকসভা বা বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা এখন গুরুতর প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। কারণ, নির্বাচকমন্ডলী অর্থাৎ সাধারণ জনগণের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নির্বাচনী বন্ডের ক্রেতাগণ, যারা এর মাধ্যমে পছন্দের রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনবার জন্য যাবতীয় বন্দোবস্ত আগে থেকেই সেরে রাখছেন। আমি আপনি যতই ভাবি না কেন, কেন্দ্রে বা রাজ্যে সরকার আমরা তৈরি করছি, আসল  কারিগর কিন্তু এই কর্পোরেট বণিককুল, যারা জনগণকে লুট করবার নিজস্ব পরিকল্পনা কার্যকর করতে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে আড়াল থেকে পছন্দের রাজনৈতিক দলকে বিশাল অংকের অর্থ দিয়ে নির্বাচনী লড়াইএ এগিয়ে থাকতে সাহায্য করছে। ‘দেবে আর  নেবে’– এই শর্তে তৈরি হচ্ছে আগাম বোঝাপড়া। অসম লড়াইয়ে হারিয়ে যাচ্ছে জনপ্রতিনিধিত্বের আসল  লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি। দেশের সম্পদ লুট হচ্ছে, আমজনতার দুর্ভোগ বাড়ছে।

এদেশে পার্লামেন্ট বা বিধানসভার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অর্থ ও পেশি শক্তির আস্ফালন অতীতে ছিল না এমনটা দাবি করা যাবে না। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে, সিপিআইএম সহ বামপন্থীরা আগাগোড়া সংসদীয় গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে সংসদের ভেতরে ও বাইরে জনগণকে সচেতন করবার ধারাবাহিক লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তবু এই বিপদকে এড়ানো যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলিকে, ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় নিয়মিত দান হিসেবে টাকা দিত। তবে নিয়ম ছিল কুড়ি হাজার টাকার বেশি কেউ দান করলে রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্যে তা জানাতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে জানতে পারে কে কোন ধান্দায় টাকা জোগাচ্ছে। নিয়ম ছিল, কোনো কোম্পানি তার মোট আয়ের দশ শতাংশ  বা মোট মুনাফার সাড়ে সাত শতাংশের বেশি এই উদ্দেশ্যে কোনো রাজনৈতিক দলকে দান করতে পারবেনা। এর সবটাই এখন তামাদি হয়ে গেছে। এখন যে কেউ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে কোনো রাজনৈতিক দলকে যথেচ্ছ অর্থ জোগাতে পারে। ১০০০ টাকার গুণিতকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বিনা সুদের বন্ড যথেচ্ছ কিনে দান করা যেতে পারে। যে বা যারা এই বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলের তহবিলে অর্থ যোগান দিচ্ছে, তাদের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখার বন্দোবস্ত করেছে বিজেপি সরকার। যদিও শাসক দল ও সরকার কে কোন দলে টাকা দিচ্ছে তার সবটাই জানতে পারছে। তবু কর্পোরেট মালিকরা খানিকটা বেপরোয়া হয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ মুনাফা সুনিশ্চিত করতে ও জনগণকে প্রকাশ্যে লুটের সরকারি স্বীকৃতি বা লাইসেন্স পেতে এই বন্ড কিনছে। দেদার কালো টাকা নির্বাচনী বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে সাদা  হয়েছে গত পাঁচ বছরে। যেহেতু সবটাই গোপনে হচ্ছে তাই আমার আপনার জানবার সুযোগ নেই এই বাড়তি সুবিধাভোগী কর্পোরেট মালিকদের নামধাম ও তাদের লুটের সামগ্রিক পরিকল্পনা। সিপিআইএম প্রথম থেকেই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে এভাবে অর্থ যোগানের নিয়মের বিরোধিতা করেছে। আরো একাধিক বামপন্থী দল এর বিরোধিতা করেছে। সর্বোচ্চ আদালতে এ নিয়ে করা মামলার শুনানিও সম্প্রতি শেষ হয়েছে। এখন কি রায় হয় তা জানবার অপেক্ষায় আছে সারা দেশের মানুষ। মধ্যবর্তী সময়ে  গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনগুলির আগে এই বন্ড বিক্রির উপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করলেও সর্বোচ্চ আদালত তা মঞ্জুর করেনি। ফলে সমগ্র নির্বাচনী ব্যবস্থায় কর্পোরেট মালিকদের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ বেঞ্চের সাম্প্রতিক শুনানিতে উভয়পক্ষের আইনজীবী ও প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে নির্বাচনী বন্ড, এর যৌক্তিকতা, বিপদ ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা উঠে এসেছে যা আমাদের নজরে থাকা দরকার। কেন আমরা প্রথম দিন থেকে এই বন্ডের বিরোধিতা করে আসছি তা বোঝা সম্ভব হবে। আদালতের চূড়ান্ত রায় যাই হোক না কেন, জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে এগুলি জানা ও বোঝা অত্যন্ত জরুরী।

প্রথমত, নির্বাচনী বন্ডের এই আইনে যে গোপনীয়তার কথা বলা হয়েছে তা আদতে সংবিধানের আর্টিকেল ১৯(১) ধারা অনুযায়ী তথ্য জানার মৌলিক অধিকারের মূল মর্মবস্তুর বিরোধী। সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপি সংবিধানকে মান্যতা দেয় না তাই সংবিধানে উল্লিখিত জনগণের মৌলিক অধিকার কে এভাবে নস্যাৎ করতে চেয়েছে। তাছাড়া প্রধান বিচারপতি সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করেছেন, এই গোপনীয়তা শুধু দেশবাসীর জন্য, শাসক দল সবটাই জানতে পারছে। কারণ স্টেট ব্যাংক ছাড়া এই বন্ড অন্য কোথাও বিক্রি হয় না যা সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন। ফলে স্বার্থের সংঘাত বাধতে বাধ্য। কে কোন দলকে টাকা দিচ্ছে তা জানতে পেরে শাসক দল প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতিতে অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি হয় যা কার্যকর করে বড় পুঁজির মালিকরা বন্ড কেনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে টাকা জুগিয়ে। সুপ্রিম কোর্ট যদি গত পাঁচ বছরের এই বন্ড সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য প্রকাশ্যে আনবার নির্দেশ দেন তাহলেই এই অনুমান সত্য বলে প্রমাণিত হবে। বোঝা যাবে কিভাবে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে।

তৃতীয়ত, এই পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে পারে বা ইতিমধ্যে লাগিয়েছে বহু ফেক কোম্পানি। বিশেষ করে হিসাব বহির্ভূত অর্থাৎ কালো টাকাকে সাদা করবার জন্য ফেক কোম্পানির নামে বন্ড কিনে তারা রাজনৈতিক দলের তহবিল জমা দিলেও তার তদন্ত হওয়া বা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে না যেহেতু পুরো বিষয়টাই গোপনে সম্পন্ন হয়। এই ব্যবস্থা টিকে থাকলে দেশ জুড়ে কালো টাকার পরিমাণ আরও  বাড়তে থাকবে। চতুর্থত, বন্ডের মাধ্যমে পাওয়া এই টাকা রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যেও খরচকরতে পারে। যেহেতু বন্ড  ভাঙ্গিয়ে নেয়ার পর তার থেকে পাওয়া টাকা কোন কোন খাতে খরচ হচ্ছে তা বলবার কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, তাই গোপনে পাওয়া এই বিপুল অর্থ জনস্বার্থ বিরোধী কোনো অসৎ উদ্দেশ্যেও খরচ হতে পারে। বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের সামগ্রিক কার্যকলাপ লক্ষ্য করলে এ বিষয়ে অনুমান করা সম্ভব। পঞ্চমত, এই পদ্ধতি সরাসরি দুর্নীতিকে মদত দেয়। সমাজবিরোধীরা অর্থবলে এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধ সংগঠিত করেও আইনী সুরক্ষা কবচ পেয়ে যেতে পারে, যা সামাজিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।