জে ভি স্তালিন। দুনিয়ার বুকে প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার সফল বিপ্লবী সংগঠন রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টি তথা বলশেভিক পার্টির অন্যতম নেতা, রুশ বিপ্লবের অবিসংবাদী নেতা কমরেড ভি আই লেনিনের শিষ্য ও সহযোদ্ধা। যে শিষ্য তাঁর নেতা ও শিক্ষক লেনিনকে কোনওদিন অস্বীকার করেন নি, বরং মার্কসবাদী তত্ত্বধারায় কমরেড লেনিনের অবদানগুলিকে সযত্নে রক্ষা করার ও আরও বিকশিত করার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন।
লেনিনের সমস্ত প্রবন্ধ ও অভিজ্ঞতাকে সূত্রায়িত করে স্তালিনই লেনিনবাদ প্রচার করেন। তাঁর লেখা ‘লেনিনবাদের ভিত্তি ও সমস্যা’ শীর্ষক পুস্তক এর সাক্ষ্য বহন করে। লেনিনবাদ হল সাম্রাজ্যবাদী ও শ্রমিক বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। সাধারণভাবে লেনিনবাদ হল শ্রমিক বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল। আবার বিশেষভাবে এ হল শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের মতবাদ ও রণকৌশল। কেন একনায়কত্ব? কার একনায়কত্ব? বিপ্লবোত্তর পর্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন শ্রেণি হিসাবে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের কথাই লেনিন বলেছিলেন। কারণ এতাবৎকাল ব্যাপী বিদ্যমান পূর্বতন রাষ্ট্রব্যবস্থায় মালিকশ্রেণির একনায়কত্বই বজায় থেকেছে। শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরেও বিপ্লবকে রক্ষা করা ও প্রতিবিপ্লবকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা লেনিন বলেছিলেন। কিন্তু স্তালিনের পরে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির গুরুতর বিচ্যুতিতে শ্রেণির একনায়কত্ব ক্রমান্বয়ে পার্টির, গোষ্ঠীর ও নেতার একনায়কত্বে পর্যবসিত হওয়ায় পুঁজিবাদী শিবিরের বিরূপ সমালোচনার মুখে অনেক দেশের কমিউনিস্ট পার্টিই শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের মূল নির্যাস অক্ষুণ্ণ রেখে ‘একনায়কত্ব’ পরিভাষাটিকে পরিহার করেছে।
কার্ল মার্কসের মৃত্যুর পরে এক সময় বার্নস্তাইন সহ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্যান্য তাত্ত্বিকরা মার্কসবাদের এক অবিপ্লবী ও সংস্কারবাদী ব্যাখ্যা হাজির করে মার্কসবাদকে ‘ভদ্রস্থ’ করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে কাউটস্কিও একই পথ গ্রহণ করেছিলেন। কমরেড লেনিন সমালোচনার তীব্র কশাঘাতে তাদের এই প্রচেষ্টার স্বরূপ উন্মোচন করে মার্কসবাদের বিপ্লবী চরিত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। লেনিনের মৃত্যুর পর এক নতুন কায়দায় লেনিনবাদকে বিকৃত করার চেষ্টা চলে ট্রটস্কিবাদের নামে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক নেতা লিও ট্রটস্কি বিশ্ববিপ্লবের, স্থায়ী তথা ধারাবাহিক বিপ্লবের তত্ত্ব আমদানি করে বলেন কেবল একটি দেশে বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। রাশিয়ার বিপ্লবকে রক্ষা করতে গেলে পশ্চিম ইউরোপে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভবপর হবে।
এই তত্ত্ব আসলে লেনিনের বিরোধিতা। জাতীয় রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্যের সম্ভাব্যতাকে অস্বীকার করার অপচেষ্টা। এই তত্ত্বের মধ্যে ছিল নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়ী রুশ শ্রমিকশ্রেণির ওপর অনাস্থা এবং বিপ্লবের প্রাণশক্তির প্রতি অবিশ্বাস। একই সঙ্গে ছিল রাশিয়ার কৃষকদের প্রতি চরম অবজ্ঞা। প্যারি কমিউনের ব্যর্থতা থেকে মার্কস যে শিক্ষা হাজির করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্যারির কমিউনার্ডদের সঙ্গে প্যারির বাইরের গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের মৈত্রী গড়ে না ওঠার ব্যর্থতা। তাদের বিপ্লবের পক্ষে সামিল করতে না পারার ব্যর্থতা। একইভাবে দুনিয়ার প্রথম ও শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ঘরে-বাইরের প্রতিক্রিয়ার শক্তির মোকাবিলা করার লক্ষ্যে লেনিনের নির্দেশিকা ছিল, সাময়িকভাবে পুঁজিপতিদের সাহায্য ও প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। ইউরোপের ‘পিছনের উঠোন’ বলে কথিত অতি পশ্চাৎপদ রাশিয়ায় চাই বিদ্যুত। তাই গৃহীত হয়েছিল ‘নেপ’ ( নিউ ইকোনমিক পলিসি)। বিপ্লবকে রক্ষা করার লক্ষ্যে কৃষকদের সঙ্গে দৃঢ় মৈত্রীর আহ্বান জানিয়েছিল সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টি। তাই ট্রটস্কির স্থায়ী বিপ্লবের নীতির সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কোনও সংশ্রব নেই। মার্কসবাদ কখনওই অবিচ্ছিন্ন, অবিরল ধারায় বিশ্বাস করে না। মার্কসবাদে গতির ছন্দ হল, গতি ও উল্টো গতি এবং পুনরায় গতি ও উল্টো গতি। মার্কসবাদী ধারণায় অগ্রগমন সরলরেখায় হয় না, হয় ক্রমবর্ধমান চক্রাকারে।
একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখা অসম্ভব, ট্রটস্কির এই মতবাদকে পরাজিত করে কমরেড লেনিন, স্তালিন সহ সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির নেতারা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কঠিন কাজে ব্রতী হন। তাঁরা তাঁদের কাজে সফল হন, ট্রটস্কিবাদের পরাজয় ঘটে। ট্রটস্কি পার্টি থেকে বিতাড়িত হয়ে সুদূর মার্কিন মুলুকে পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে গোপনে রাশিয়ার কয়েকজন প্রবীণ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা চালান। কিন্তু সে চেষ্টা ধোপে টেকে নি। এই গোটা পর্বে ট্রটস্কিবাদের পরাজয় সাধন ও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারায় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অগ্রসর ঘটানোর কঠিন কাজের জন্য কমরেড স্তালিন বিশ্বের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের কর্মীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
রুশ বিপ্লবের প্রধান নেতা কমরেড লেনিনের মৃত্যুর পর কমরেড স্তালিন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বিকাশ সাধনে মহান দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একথা সবারই জানা। যার পরিণামে বিপ্লবের কয়েক বছর পর থেকেই ক্রমান্বয়ে সোভিয়েত দেশের বিপুল অগ্রগতি বিশ্বের উন্নত পুঁজিবাদী দেশের সমকক্ষ বা কিছু ক্ষেত্রে অতিক্রমের অবস্থানে পৌঁছে যায়। এই ক্ষেত্রে স্তালিন জোর দিয়েছিলেন ‘সমাজতান্ত্রিক মানুষ ‘ তৈরির ওপর। অর্থাৎ দেশের আপামর শ্রমিক শ্রেণি সহ কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক চেতনা গড়ে তোলার ওপর। এককথায় সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্যে সবাইকে জাগিয়ে তোলার ওপর। যার স্বীকৃতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাশিয়ার চিঠি’তে রয়েছে। কবি উপলব্ধি করেছিলেন, ‘অন্য কোনো দেশের মতো নয়, একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলেছে।’ স্তালিন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিকাশসাধনের পাশাপাশি তাকে রক্ষার কাজেও ঐতিহাসিক নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে দুর্ধর্ষ দুষমণ হিটলারের ফ্যাসিস্ট নাৎসি বাহিনীকে পরাস্ত করে কেবলমাত্র সোভিয়েত দেশকে রক্ষা করেছিলেন তাই নয়, রক্ষা পেয়েছিল সারা বিশ্বের মানুষ। ফ্যাসিস্ট হিটলারের পরাজয়ে খুলে গিয়েছিল দেশে দেশে মুক্তি সংগ্রামের ও স্বাধীনতা অর্জনের দুয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন স্তালিন হিটলারের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন, যা নিয়েও তাঁকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিল পুঁজিবাদী মহল। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল পশ্চিমের পুঁজিবাদী শিবিরের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সোভিয়েতকে আগেভাগে হিটলারের বাহিনীর আক্রমণের মুখে ফেলে ধ্বংস ও বিধ্বস্ত হবার সুযোগ দেননি স্তালিন। নাৎসি বাহিনীর আক্রমণ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য সময় নিতে চেয়েছিলেন তিনি। স্তালিনের এহেন কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশলের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শেষমেষ হিটলারের বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ গৌরবজনক যুদ্ধে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত জয়যুক্ত হয়েছিল বিপুল আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। সে দেশের দুই কোটি মানুষ ওই যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। এমন কোনও পরিবার ছিলনা যাদের অন্তত একজন সদস্যকে যুদ্ধে হারাতে হয় নি! ‘সমাজতান্ত্রিক মানুষ’ ব্যতিরেকে এই আত্মত্যাগ কোনও জাতি করতে পারে? ওই যুদ্ধে স্তালিনের দুই ছেলেও যোগ দিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে একজনকে নাৎসিরা মেরে ফেলে। যুদ্ধবন্দি অবস্থায় তার জন্য স্তালিনের কাছে নাৎসিদের পক্ষ থেকে মুচলেকা দেবার প্রস্তাব এলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ‘লৌহমানব’ অভিধা তিনি এমনি পাননি! এই আত্মত্যাগের মহিমা আমাদের দেশের মুচলেকা দেওয়া ‘কমিউনিষ্ট ইকোসিস্টেম’-এ আতংকিত হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশসাধন ও তাকে রক্ষায় স্তালিনের ভূমিকা তাঁকে ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
কমরেড লেনিন প্রদর্শিত শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার পথেই নিষ্ঠ থেকেছেন স্তালিন। আন্তর্জাতিকতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই স্তালিনের পরামর্শে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সাম্রাজ্যবাদের ‘নয়া উপনিবেশবাদী’ রূপ প্রসঙ্গে সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ‘যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক রিপোর্ট ‘ রচনা করেন কমরেড ঝানভ। স্তালিন নিজে শেষ জীবনে ভাষা সম্পর্কে প্রবন্ধ (অন লিঙ্গুয়িস্টিক) রচনা করেন। তাঁর সাহায্যেই সোভিয়েত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর রূপরেখা’ রচিত হয়। স্তালিনের উদ্যোগেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ (ডব্লিউ পি সি) গঠিত হয়। তাঁর আমলেই গঠিত হয় বিশ্ব শ্রমিক সংঘ, বিশ্ব নারী সংঘ, বিশ্ব ছাত্র ও যুব সংস্থা প্রভৃতি সংগঠন। যেগুলি আজও সারা বিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর উদ্ভূত বিজয়ের পরিবেশে অনেক নতুন ও তরুণ কর্মী সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টিতে আসে। তাদের রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য স্তালিনের পরামর্শে কমরেড কালিনিন কমিউনিষ্ট শিক্ষার ওপর পুস্তক ‘অন কমিউনিষ্ট এডুকেশন’ রচনা করেন। কমরেড স্তালিনের সমুদয় রচনাবলী ও কার্যাবলী কেবল সোভিয়েত দেশের কমিউনিস্ট কর্মীদের নয়, সমগ্র বিশ্বের কমিউনিষ্ট কর্মী ও মানুষের প্রয়োজনে কার্যকরী অবদান। এই অবদানসমূহ তাঁকে বিশ্ব কমিউনিষ্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব পদে আসীন করেছে।
নিবন্ধে ইতি টানব ‘ডিস্ট্যালিনাইজেশন’ বা স্তালিনকে নস্যাৎ করার প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে আলোচনা করে। স্তালিনের মৃত্যুর পর এই কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তাঁর উত্তরসূরী সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির ও সরকারের প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ। এর সাথে অবশ্যই ছিল বিশ্ব পুঁজিবাদী মহলের জোরালো কনসার্ট। একদা স্তালিনের বিশ্বস্ত, অনুগত সহযোদ্ধা সর্বোচ্চ ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেই স্তালিনকে নস্যাৎ করতে শুরু করলেন। সোভিয়েত পার্টি ও সরকারে তাঁর সকল অবদান মুছে ফেলা হল। শেষ জীবনে স্তালিনের কিছু ভুল প্রবণতা ও কাজকেই সর্বস্ব বিবেচনায় চলল তাঁকে নস্যাতের কাজ। এমন কি রুশ মুসোলিয়ামে লেনিনের দেহের পাশে শায়িত তাঁর মরদেহ মাটি খুঁড়ে কবর দেওয়া হল। ক্রুশ্চেভের ‘ডিস্ট্যালিনাইজেশন’ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য গল্প কথিত আছে। সোভিয়েত পার্লামেন্টে ক্রুশ্চেভ যখন স্তালিনের সম্পর্কে ব্যাপক গালমন্দ করে বক্তৃতা করছিলেন, তখন জনৈক সাংসদ মুখ ফস্কে ক্রুশ্চেভের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন, স্তালিনের জীবদ্দশায় এইসব সমালোচনা করেন নি কেন? সেদিন কোথায় ছিলেন? কথাটা কানে যেতেই ক্রুশ্চেভ বলে ওঠেন, কে কথাটা বললেন? উঠে দাঁড়ান। কিন্তু কেউ কথার দায় স্বীকার করে উঠে না দাঁড়ালে ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন, আজ আপনি যেখানে, সেদিন আমি ওখানেই ছিলাম। এই ঘটনায় ক্রুশ্চেভের স্তাবকতা ও বিশ্বাসঘাতকতার নগ্ন রূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই দৃষ্টান্তের বিপরীত রূপ আমরা দেখতে পাই স্তালিনের ক্ষেত্রে যিনি লেনিনের মৃত্যুর পরে লেনিনের অবদানসমূহ আরও বিকশিত করেন লেনিনবাদের প্রচারের মধ্য দিয়ে।
ক্রুশ্চেভের এই বিশ্বাসঘাতকতার উৎস সংশোধনবাদী বিচ্যুতি। তাই সোভিয়েত পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে পুঁজিবাদের সঙ্গে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা, শান্তিপূর্ণ উত্তরণ’-এর শোধনবাদী রাজনৈতিক লাইন গৃহীত হয়। এই রাজনৈতিক লাইনের সুদূরপ্রসারী ফলাফলের কারণে গত ১৯৯১ সালে গর্বাচভ ও ইয়েলেৎসিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে গেল ও পার্টিটাই উঠে গেল। লেনিন-স্তালিনের নেতৃত্বে হাজার প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান না হয়ে বিকাশসাধন ঘটেছিল, আর ক্রুশ্চেভের শোধনবাদী তথা পুঁজিবাদের সঙ্গে শ্রেণি সহযোগিতার লাইন মহাবিপর্যয় সাধন করল।
তাই একথা বলাই যায় ‘ডিস্ট্যালিনাইজেশন’ পুঁজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণের নীতি।
কমরেড স্তালিন কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ছিলেন না। ছিলেন বিশ্ব কমিউনিষ্ট আন্দোলনের নেতা। তিনিই লেনিনের সঙ্গে একযোগে কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনাল গড়ে তুলেছিলেন। লেনিনের মৃত্যুর পর অন্যদের সঙ্গে নিয়ে এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের দেশে দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে যেতে নেতৃত্ব ও পরামর্শ প্রদান করেছিল। এহেন স্তালিনেরও শেষ জীবনে কিছু ভুল হয়েছিল। তাঁকে ঘিরে সোভিয়েত পার্টির অভ্যন্তরে ব্যক্তিপুজোর প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। কমিউনিষ্ট পার্টিতে ব্যক্তিপুজো একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রবণতা। এই প্রসঙ্গে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন স্বরূপ দলিলগুলি আজও এই প্রশ্নে দিকনির্দেশকারী তথ্য। যার মূল কথা হল কারো মূল্যায়ন করতে হবে তাঁর চরিত্রের ভালোমন্দ সবটা মিলিয়ে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায়। এই ক্ষেত্রে কমরেড স্তালিনের বিরাট সাফল্য ও মারাত্মক দুর্বলতার বাস্তব মূল্যায়ন করা দরকার। সেটাই করা হয়েছিল ওই দলিলগুলিতে। এর বাইরে গিয়ে স্তালিনকে খুনী,
দানব হিসাবে দেখানো অতিরঞ্জিতমাত্র। এই অতিরঞ্জনে সুবিধা হয়েছে বিশ্ব পুঁজিবাদী মহলের। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য স্তালিন প্রসঙ্গে স্বনামখ্যাত কমিউনিষ্ট চিন্তাবিদ ও সাংসদ হীরেন মুখার্জীর ভাষ্য : হাতির দাঁতে খুঁত, তবুও হাতির দাঁত।