অসহনীয় তাপ গোটা শহরটাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।সকাল থেকেই সূর্যের তেজ ক্রমশ ই ঊর্ধ্বমুখি।বৃষ্টির দেখা নেই, শরীর জুড়ানো ঠান্ডা বাতাস ও বইছে না ।অসহনীয় তাপপ্রবাহ সহ্য করতে না পেরে আমরা নানারকম নিদান দি ,কিন্ত এই যে ভয়ংকর উষ্ণতা বৃদ্ধি আসলে যে প্রকৃতির প্রতিশোধ মানুষের প্রতি সে কথা মানতে আমাদের কষ্ট হয় ।আমরা স্বীকার করি না মানুষের মুনাফার লালসার কারনেই ধ্বংস হয়েছে অরন্য তারই কুফল ভোগ করছি আমরা।তাত্ত্বিক রা নানাভাবে ব্যাখা করছেন এই পরিস্থিতির কিন্ত যেই পুঁজিপতি ব্যবস্থার ভয়ংকর আগ্রাসনের কারনে প্রকৃতির রুদ্ররোষের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এই প্রজন্ম কে সেই বিষয়ে নীরব তাত্ত্বিকেরা।

     পুঁজিবাদের সীমাহীন লোভের কারণে যে একদিন প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস হবে সে বিষয়ে বহু কাল আগেই মার্কস এঙ্গেলস থেকে রবীন্দ্রনাথ  আমাদের সচেতন করে গেছেন। 

  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের    ‘রক্তকরবী’ নাটকটিতে মানুষের সর্বনাশা লোভ আর  পুঁজিবাদের চরিত্র ফুটে  উঠেছে। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কতোটা অমানবিক আর দুর্বল হয়ে পড়ে রাজা মকররাজ তার উদাহরণ। রাজা মকররাজ তার ‘যক্ষপুরী’ কারাগারে মাটির তল খুঁড়ে একদল ক্রীতদাস দিয়ে সোনা আহরণে মগ্ন। রাজার এই সোনা আহরণের নেশায় প্রকৃতি হতে থাকে ক্ষতবিক্ষত। চলে প্রকৃতির প্রতি অন্যায় অবিচার। রাজার নাগপাশে বন্দী একদল লোক। খুবই লোভী রাজার লোভের আগুনে পুড়ে মরছে তার নিযুক্ত সোনার খনির শ্রমিকরা। পুঁজিবাদী সমাজের অসহায় প্রতিনিধি তারাই রাজার স্বর্ণলাভের একমাত্র মাধ্যম। পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী থাবা যেভাবে খনি খুঁড়ে, শিল্পায়ন আর নগরায়নের নামে প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে সে বিষয়ে কবি বহু আগেই আমাদের সচেতন করে গেছেন ।

“প্রকৃতির ওপরে দখলদারি নিয়ে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এই প্রতিটি বিজয়ের প্রতিশোধ প্রকৃতি আমাদের থেকে নেয়। অবশ্যই প্রথমে এই জয় আমাদের প্রত্যাশিত ফল দেয়, কিন্তু ক্রমশঃ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্তরে পৌঁছে এই জয়ের ফলটা অন্যরকম হতে থাকে যা আমাদের কল্পনার বাইরে এবং তা সহজেই আমাদের প্রথম জয়ের সব সুফলকে কেড়ে নেয়। মেসোপটেমিয়া, গ্রীস, এশিয়া মাইনরের যে মানুষেরা জঙ্গল কেটে কৃষিক্ষেত্র বানাচ্ছিলেন তারা স্বপ্নেও ভাবেননি যে এর ফলে তারা আদতে কোন খণ্ডহর তৈরি করছেন।…….তাই প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বহিরাগত আক্রমণকারীর মত প্রকৃতিকে জয় করা সম্ভব নয়, কারণ আমরা আমাদের রক্ত, মাংস, মস্তিস্ক নিয়ে প্রকৃতির অংশ হিসেবেই বাঁচি। বড়জোর বলা চলে যে আমাদের এটুকু ক্ষমতা আছে প্রকৃতির নিয়মাবলীগুলো বোঝার ও তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার।“ ফ্রেডরিক এঙ্গেলস(পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি)

 ক্যাপিটালের তৃতীয় খণ্ডে মার্কসের পরিবেশ ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় এখানে তিনি উল্লেখ  করলেন, ‘..এমনকি একটা গোটা সমাজ, একটা জাতি, অথবা বিদ্যমান সমস্ত সমাজ সামগ্রিকভাবেও এই ধরিত্রীর প্রভু নয়, তারা এতে বসবাসের অধিকারী আর উপভোক্তামাত্র। এক দায়িত্ববান গৃহকর্তা হিসেবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই ধরিত্রীকে এক উন্নততর অবস্থায় পৌঁছে দিতে হবে।”

পুঁজিবাদে মানুষের অগ্রগতি যে পরিবেশকে শোষণ করেই হয়েছে, তা মার্কসের বক্তব্যে সুস্পষ্ট। মানবিক মূল্যবোধ ও সম্পর্কের বিপরীতে পুঁজিবাদী সমাজের মুনাফাসর্বস্বতা প্রতিষ্ঠা করে বাজারের নিয়ন্ত্রণ। মুনাফার তাড়নায় পুঁজিবাদ ধ্বংসাত্মক শোষণ চালিয়ে পরিবেশকেও পণ্য করে তোলে। জল, মাটি, অরণ্যও মুনাফা লাভের উপাদানে পরিণত হয়। মানুষ হয়ে পড়ে আত্মবিক্রিত, আত্মচ্যূত। বিচ্ছিন্নতা (Alienation) সম্পর্কে বলতে গিয়ে মার্কস এমন এক অবস্থার কথা বলেছেন, ‘যেখানে মানুষের নিজের কাজই তার বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায় এবং মানুষ হয়ে ওঠে ভিনগ্রহের।’ পুঁজিবাদ মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির, এমনকি নিজের সঙ্গে নিজের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। শ্রমিক নিজের শ্রম থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রকৃতিজগৎ ও মানবসমাজের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার কথা ভেবে মার্কস উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রত্যয়-সাম্যবাদই পারে এই বিচ্ছিন্নতা কাটাতে এবং সংঘাতের অবসান ঘটাতে। তিনি প্রকৃতির মানবায়নের কথা বলেছেন। সাম্যবাদী সমাজের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রকৃতির মানবায়ন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। মার্কস লিখেছেন, ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজির আধিপত্য প্রকৃতিকে কলুষিত করছে। প্রকৃতির প্রতি এই আচরণ অত্যন্ত ঘৃণ্য। জলের মাছ, আকাশের পাখি, মৃত্তিকার উপরের উদ্ভিদ-সব কিছুকেই পরিণত করা হচ্ছে সম্পত্তিতে। এটা অসহনীয়। সমস্ত জীবকে এই বন্ধন থেকে মুক্ত করা চাই।’

            প্রকৃতির পালা এখন প্রতিশোধ নেওয়ার, নির্বিচারে গাছ কেটে কংক্রিটের এই শহর থেকে সবুজ বিদায় দেওয়ার খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই তাপমাত্রা গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে।নগরায়নের নামে জলাভূমি বুজিয়ে বহুতল নির্মাণ চলছে,ক্রমশই কমছে শহরের জলস্তর কিন্ত হুঁশ নেই প্রশাসনের। কিছুদিন আগেও উন্নয়নের নামে যশোর রোডের পাশের গাছগুলি নির্বিচারে কেটে ফেলা হলো একই রকম ভাবে টালিগঞ্জের করুনাময়ী খালের পাশের বহু পুরনো গাছ কেটে ফেলা হলো কোনও প্রভাব শালী মন্ত্রীর পরাপরের জন্য ব্রিজ বানাতে।পূর্ব কলকাতার জলাভূমি পর্যন্ত জমি মাফিয়াদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।

 প্রকৃতির রুদ্ররোষের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই রাস্তা  পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তাকে শ্রেণী আন্দোলনে পরিনত করা ।